‘আমরা না করলে প্রকৃতি আমাদের ‘ঘর’ পরিষ্কার করে দেবে’
১০ জুন ২০২০
আমাদের এই গ্রহকে রক্ষা করতে হলে কী করতে হবে? মার্কিন লেখক, পরিবেশবিদ, ডিপ গ্রিন রেজিসট্যান্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ডেরিক জেনসেন মনে করেন পৃথিবীকে পরিষ্কার করতে হবে এবং তা করতে প্রয়োজনে প্রস্তর যুগে ফিরে যেতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে :আপনি তো প্রচলিত ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান, তাহলে কি আপনি সভ্যতা-বিরোধী?
ডেরিক জেনসেন : একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আমি সভ্যতা-বিরোধী মানে কিন্তু এই নয় যে, আমি সংস্কৃতি-বিরোধী নই৷ এমন একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, সব সংস্কৃতিই সভ্যতা, আসলে কিন্তু তা সত্যি নয়৷
বলতে চাইছি, আমাদের জীবনযাপন প্রণালীর ভিত্তি হলো এই গ্রহটিকে একটা মেশিনের মতো করে তুলতে প্রকৃতির ক্ষতি করে যাওয়া৷ তাতে কিছু টেকসই হয় না, শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোনোদিনই হয়নি৷
আমি এখন উত্তর ক্যারোলাইনায় থাকি৷ কমপক্ষে ১২,৫০০ বছর এখানে টলোয়াই ইন্ডিয়ানরা বসবাস করেছে৷ ১৯০ বছর আগে এখানে যখন ইউরোপীয়রা এলো, জায়গাটা তখনও স্বর্গের মতো ছিল৷
এখান থেকে একটু দক্ষিণে ক্লামাথ নামের একটা নদী আছে৷ সেখানে কালো টলমলে জলে স্যামন মাছ ভেসে বেড়াতো৷ স্যামন মাছ নেই বলে সেখানে গত কয়েক বছর ধরে ইন্ডিয়ানরা আর স্যামন উৎসব করতে পারছে না৷
দৃষ্টিভঙ্গিটা রোমান্টিক হয়ে গেল না? প্রস্তর যুগে ফিরে যাওয়া মানে তো ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক জীবন, প্রতিনিয়ত অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম৷ সত্যিই তা চান আপনি?
কার্বন নিঃসরণের দায় কাদের
মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে দায়ীদের মধ্যে শীর্ষে মধ্যপ্রাচ্য আর শিল্পোন্নত দেশগুলো৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও বা হু), ইউনিসেফ এবং দ্য লেনসেট গঠিত একটি কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই ছবিঘরটি তৈরি৷
ছবি: Imago/CoverSpot/B. Lauter
মাথাপিছু ৪৯ কেজি কার্বন!
বিশ্বে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ কাতার৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির মানুষ বছরে গড়ে ৪৯ টন কার্বন ছড়ানোর জন্য দায়ী৷ ২০৩০ সালের বৈশ্বিক এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তাদের কার্বন ব্যবহার ১৭১৬ ভাগ বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Valat
দ্বীপপুঞ্জে কার্বন
ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের বেশ কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশ ত্রিনিদাদ ও টোবাগো৷ মাত্র ১৩ লাখ জনগোষ্ঠীর দেশটি কার্বন নিঃসরণে কম যায় না৷ মাথাপিছু ২৯ টনেরও বেশি কার্বন পোড়ায় তারা৷ ২০৩০ সালের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯৯৮ ভাগ পিছিয়ে তারা৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/Y. Levy
কুয়েতিরা তৃতীয়
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে বিশ্বে তৃতীয়৷ দেশটির মানুষ মাথাপিছু ২৫ টনের বেশি কার্বন ব্যবহার করেন প্রতিবছর৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
প্রথম দশের পাঁচটিই মধ্যপ্রাচ্যের
কুয়েতের পরই কার্বন ব্যবহারে এগিয়ে বাহরাইন৷ তাদের মাথাপিছু নিঃসরণের পরিমাণ ২৩ টন৷ এরপরের অবস্থানে সৌদি আরব৷ দেশটির মাথাপিছু কার্বন ব্যবহার ১৯ টন৷ সবমিলিয়ে প্রথম পাঁচটি দেশই মধ্যপ্রাচ্যের৷
ছবি: picture-alliance/Bildagentur-online/AGF
প্রথম দশে যুক্তরাষ্ট্র
মাথাপিছু কার্বন ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অষ্টম৷ দেশটির মানুষ গড়ে ১৬ টন কার্বন ব্যবহার করে৷ এসডিজি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তা ৫০০ ভাগ হ্রাস করতে হবে৷ যুক্তরাষ্ট্রের উপরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Camp
ইউরোপের শীর্ষে এস্তোনিয়া
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি কার্বন ব্যবহারকারী এস্তোনিয়া৷ শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে তাদের অবস্থান ১৩তম৷ ১৭তম অবস্থানে আছে রাশিয়া, ১৮তম আইসল্যান্ড আর ২০তম জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance / Uwe Gerig
পরিবেশবান্ধব আফ্রিকা
বিশ্বের সবচেয়ে পরিবাশবান্ধব দেশগুলোর অবস্থান আফ্রিকা মহাদেশে৷ সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ বুরুন্ডি৷ মাথাপিছু মাত্র দশমিক শূন্য-পাঁচ টন৷ একই পরিসংখ্যান চাদ কিংবা সোমালিয়ার ক্ষেত্রেও৷ সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরনকারী ১৯টি দেশই এই মহাদেশের৷
ছবি: imago images/imagebroker/F. Wagner
বাংলাদেশ ৩৯তম
সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৩৯তম৷ বছরে মাথাপিছু দশমিক ৫৩টন কার্বন ব্যবহার করে এই দেশের মানুষ৷ এসডিজিতে বেঁধে দেয়া মাত্রার চেয়েও যা আশিভাগ কম৷
ছবি: Imago/ZUMA Press
দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবেশবান্ধব নেপাল
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মাথাপিছু সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ নেপাল৷ তাদের অবস্থান ২৬তম৷ অন্যদিকে এই অঞ্চলে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ ভারত৷ দেশটির মানুষ গড়ে এক দশমিক আট-চার টন কার্বন ছড়ানোর জন্য দায়ী৷ তবে মাত্রাটি এখনও এসডিজি লক্ষ্যের চেয়ে বেশ খানিকটা কম৷
ছবি: picture-alliance/imagebroker/F. bienewald
9 ছবি1 | 9
আমি কী চাই সেটা কোনো ব্যাপার নয়৷ টেকসই ব্যাপারটা আসল৷ এ্মন জীবন যাপন বেশিদিন চলতে পারে না৷
তবে আমি মানুষের বিরুদ্ধে নই৷ এই গ্রহে মানুষ তো এক হিসেবে ৮০ হাজার থেকে দুই লাখ বছর টিকেছে৷ এর বেশিরভাগ সময়ই আমরা টেকসই উপায়ে বেঁচেছি৷ কিন্তু সভ্যতা সবসময়ই ধংসাত্মক৷ সেটাই সমস্যা৷
প্রাক-সভ্যতা যুগে ফিরে গেলে আমরা সমান্তরাল ধংসপ্রক্রিয়া দেখতে পাবো; যেমন ব্যবসা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হারিয়ে যাওয়া৷
আমার কাউন্টিতে এখন ৩৫ হাজার মানুষের বাস৷ সভ্যতা শুরুর আগে এখানে ১৮ হাজারের মতো মানুষ ছিল৷ তাদের কোনো রেফ্রিজারেটর ছিল না৷ আসলে রেফ্রিজারেটরের দরকারও ছিল না, কারণ, তাদের তো নদীভরা স্যামন মাছ ছিল৷ আমাদের নদী ভর্তি স্যামন মাছ নেই বলেই নিজেকে এক কোণে যতন করে এঁকে রেখেছি৷
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে মহাসাগর মাছশূন্য হয়ে যেতে পারে৷
কিন্ত আপনি যে সিস্টেমের কথা বলতে চাইছেন, তা তো সবাই যোগ না দিলে কার্যকর হবে না?
একটা গল্প বলি, তাহলে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট বোঝা যাবে৷
ছোট বেলায় মা সবসময় আমাকে ঘর পরিষ্কার করতে বলতেন৷ কিন্তু আমি করতাম না৷ বারবার বলেও কাজ না হওয়ায় মা একদিন বললেন, দেখো, হয় তুমি ঘর পরিস্কার করো, না হয় আমি করবো৷ আমি করলে কিন্তু তোমার পছন্দ হবে না, কারণ, তখন আমি তোমার সব জিনিস ফেলে দেবো৷
তাই আমাদের উচিত নিজেদের ঘরটা পরিষ্কার করতে শুরু করা. কারণ, আমরা যদি না করলে প্রকৃতি আমাদের হয়ে কাজটা শুরু করে দেবে এবং তখন প্রকৃতির কাজটা আমাদের পছন্দ হবে না৷
প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে যে ঘরটা সত্যিই নোংরা৷ তবে সমস্যা হলো, আমরা সিস্টেমে আসক্ত৷ তাই আমি যে পরিবর্তন চাই তা সবাই স্বেচ্ছায় গ্রহণ করবে না, কারণ, সিস্টেম তো কেউ ছাড়তে চায় না৷
নিল কিং, গাব্রিয়েল বোরুদ/এসিবি
সাগর উত্তপ্ত হওয়ার যে বিপদ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে বিশ্বের মহাসাগরগুলি৷ ধেয়ে আসছে নানান রকমের বিপদ৷
ছবি: Fotolia/st__iv
দক্ষিণ মেরুর অবস্থা
অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে অ্যামেরিকার গ্রীষ্মপ্রধান শহর লস এঞ্জেলেসের কাছাকাছি হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে৷ উত্তর অ্যান্টার্কটিকার আর্জেন্টিনিয়ান গবেষণা স্থল এসপেরেনজা বেসের তাপমাত্রা ছিল ১৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অ্যান্টার্কটিকায় গবেষকরা তাপমাত্রা মাপা শুরু করার পর থেকে আজ পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা৷ নাসা বলছে, তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বরফ গলে পুকুর সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: Earth Observatory/ NASA
বাড়বে ঘূর্ণিঝড়
মহাসাগরগুলি গরম হবার ফলে অতলান্ত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বাড়বে বলে নাসা জানাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Ho
সমুদ্রস্তরে যে বদল
উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলার কারণে বাড়ছে সমুদ্র স্তরের উচ্চতা৷ সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলে যেসব মানুষের বসবাস, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে তাদের জীবন৷ শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সার্বিক তাপমাত্রা বাড়ার ফলে এমন সব জায়গায় ঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে, যা আগে হয়তো সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না৷
চরম আবহাওয়ার ফলে শুধু সমুদ্রস্তরই বাড়ছে না, কিছু কিছু অঞ্চলে বাড়ছে শুষ্কতাও৷ নাসা জানাচ্ছে, খরা বাড়ার ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে চলবে দাবানল৷
ছবি: Reuters/AAP Image/D.
ইকোসিস্টেমের ওপর চাপ
সাগর উষ্ণ হলে সেখানে বাস করা প্রাণীদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে৷ মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জলের তাপমাত্রা বাড়ার ফলে নিজেদের বাসস্থান বদলাতে বাধ্য হচ্ছে৷
ছবি: by-nc-sa/Joachim S. Müller
পানিতে অ্যাসিড
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে জলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ে৷ এর ফলে, অ্যাসিডে ভরতে থাকে সাগর৷ এই বাড়ন্ত অ্যাসিডের জন্য মারা যাচ্ছে বেশ কিছু দুর্লভ প্রাণী, নানা প্রজাতির শ্যাওলা৷
কমছে অক্সিজেনের মাত্রা
জল গরম হলে সেখানকার অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে৷ উষ্ণায়নের ফলে বাড়ন্ত তাপমাত্রা বিশ্বজুড়ে সাগর, নদী ও হ্রদকে করে তুলছে বিষাক্ত, অ্যাসিডযুক্ত৷ সাথে অক্সিজেনের মাত্রা কমায় প্রাণীরা নিঃশ্বাস নেবার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Schmidt
বিষাক্ত শ্যাওলার ছড়াছড়ি
গরম, অক্সিজেনহীন জলে বিষাক্ত শ্যাওলা জন্ম নেয়৷ এর আগে চিলির উপকূলে লাল রঙের বিষাক্ত শ্যাওলা বাড়ার ফলে হাজার হাজার মাছ মারা যায়৷ এমন জিনিস ভবিষ্যতে অন্যান্য জায়গাতেও দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নাসার বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Marquez
বদলাচ্ছে ঢেউয়ের গতি
জলের তাপমাত্রা বদলের ফলে বদলে যায় ঢেউয়ের চলন পথ৷ এর ফলে কিছু কিছু প্রাণী সাগর থেকে অন্যত্র গিয়ে পড়ছে৷ একদিকে কিছু কিছু অঞ্চল আগের থেকে বেশি ঠান্ডা হচ্ছে, আরেকদিকে অন্যান্য অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ ভাঙছে সমস্ত রেকর্ড৷ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এমন ব্যাপক বদল পৃথিবীর প্রাণীবৈচিত্র্য বদলে দিচ্ছে৷ বিপদের সম্মুখীন অসংখ্য প্রাণীদের জীবন৷