মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন, নিপীড়নের ছবি দেখলে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন না নেয় স্যান লুইন৷ জার্মানিতে নির্বাসিত এই ব্লগার স্বজাতির দুর্ভোগের কথা গোটা বিশ্বকে জানানোর চেষ্টা করেন৷
বিজ্ঞাপন
তবে প্রবাসে থাকলেও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত তিনি৷
স্নিকার, জিনস, শার্ট এবং জ্যাকেটের সঙ্গে ফ্যাশনেবল চশমাও পরেন তিনি৷ ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রেন স্টেশনে আরো হাজারো মানুষ থেকে তাঁকে আলাদা করা মুশকিল৷ জার্মানির অন্যতম ব্যস্ত এই শহরে বসবাসরত অসংখ্য চাকুরিজীবীর ভিড়ে তিনিও হারিয়ে যেতে পারেন অনায়াসে৷ রোহিঙ্গা ব্লগার নেয় স্যান লুইনকে সাদা চোখে দেখলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে তাঁর কোন মিল খুঁজে পাবেন না৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি তাদেরই একজন৷
রোহিঙ্গাদের দিকে বাংলাদেশের সাহায্যের হাত
গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ তাঁদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি নানান সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷ ছবিঘরে তারই কিছু নমুনা...
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে দীর্ঘ লাইন
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জন্য রোহিঙ্গাদের লাইন৷ কুতুপালং ছাড়াও টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি কেন্দ্রে চলছে এই নিবন্ধন কার্যক্রম৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
নিবন্ধনে বিজিবি
কতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে কাজ করছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা৷ একেকটি কেন্দ্রে দিনে গড়ে ৭০০ জনের মতো রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
নিবন্ধিত
বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের পর দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী হারুনুর রশীদ ও মোহাম্মদ দিনার৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
সরকারি ত্রাণ
রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে নানাভাবে এগিয়ে এসেছে বাংলদেশ সরকার৷ উখিয়ার কুতুপালংয়ে ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী৷
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী৷ ৪৬টি দেশের কূটনীতিকরাও ছিলেন তাঁর সঙ্গে৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
কূটনীতিকদের আশ্বাস
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে গিয়ে শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন কূটনীতিকরা৷ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সহায়তার ঘোষণাও দেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
শিশুসেবা
টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন বয়সের শিশুদের টিকা দেয়া হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
নতুন শিবির
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বালুখালীতে দুই হাজার একর জায়গায় শিবির গড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
তাঁবুর রাজ্য
শরণার্থীর চাপে এরইমধ্যে বালুখালীর এই অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রের সীমানা কয়েকগুণ বড় হয়েছে৷ উখিয়ার পাহাড়-টিলার সবখানেই এখন শরণার্থীদের অস্থায়ী তাঁবু৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
নতুন বসতি
নতুন নতুন পাহাড়ের গাছপালা কেটে প্রতিদিনই নিজেদের বসতি গড়ছেন রোহিঙ্গারা৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
11 ছবি1 | 11
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ১৯৭৮ সালে জন্ম নেয়া লুইন'এর ছোটবেলা কেটেছে ইয়াঙ্গুনে৷ যে সময় তাঁর জন্ম, তখন মিয়ানমার সরকার অনেক রোহিঙ্গাকে নিজের দেশের মানুষ মনে করতো৷ নেয় সেই দলের একজন৷ মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সেদেশের পাসপোর্ট ছিল তাঁর৷ সুযোগ পেয়েছেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের৷ তবে ১৯৮২ সালের পর থেকে তাঁর স্বজাতির প্রতি যে বৈষম্য করা হচ্ছে সেটাও উপলব্ধি করেছেন তিনি৷
মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বসবাস কয়েক শতক ধরে, যদিও সেদেশের সরকার সেটা মানতে রাজি নয়৷ বৌদ্ধপ্রধান দেশটিতে তাই রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন, বাঙালি অভিবাসী হিসেবে বিবেচিত৷ অথচ ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি এখনকার মতো ছিল না৷ লুইন এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘১৯৮২ সালে মিয়ানমার যে নাগরিকত্ব আইন অনুমোদন করে সেখানে নয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়৷ সেই সম্প্রদায়গুলোর একটি রোহিঙ্গা৷''
ষোল বছর ধরে নির্বাসনে:
ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি পড়ার সময় থেকেই রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হন লুইন৷ লেখাপড়া শেষে ২০০১ সালে সেদেশের পাসপোর্ট নিয়েই চাকুরি করতে চলে যান সৌদি আরবে৷ সেখানে একটি নির্মাণ সংস্থায় ম্যানেজার হিসেবে চাকুরি নেন৷ পাশাপাশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের দাবিতে ইন্টারনেটে লেখালেখিও চালিয়ে যান৷ এক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা করেছেন তাঁর বাবা৷ ২০০৫ সালে তিনি চালু করেন রোহিঙ্গাব্লগার ডটকম নামের একটি ব্লগসাইট৷ রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের দমনপীড়ন এবং সিস্টেমেটিক নির্যাতনের কথা প্রকাশ করা হয় এই ব্লগসাইটে৷ এটি এখন বছরে এক কোটিবারের মতো পড়া হয়৷
নেয় স্যান লুইনের ব্লগার জীবন মিয়ানমারের সরকারের চোখে পড়তে বেশি সময় লাগেনি৷ ২০০৯ সালে নিজের পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে টের পান, সেদেশের সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছে৷ ফলে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের মতো লুইনও পরিণত হন রাষ্ট্রহীন এক মানুষে৷ এমন অবস্থায় সৌদি আরবে বসবাস দুরূহ হয়ে পড়ে তাঁর জন্য৷ ফলে ২০১১ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন জার্মানিতে৷
একটি ব্লগ, একটি দায়িত্ব
‘‘একশো'র বেশি ব্লগারের একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করি আমি৷ তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর হামলার খবর পেলে তা সঙ্গে সঙ্গে যাচাই করেন এবং ছবি, ভিডিও সংগ্রহ করে আমার কাছে পাঠান৷ এরপর আমি তা ইন্টারেনেট প্রকাশ করি,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন লুইন৷ তাঁর এই নেটওয়ার্কের অনেক সদস্যই বাস করেন মিয়ানমারে, বিশেষ করে রাখাইনে, যেখানে রোহিঙ্গাদের উপর সেদেশের সেনাবাহিনীর সর্বশেষ অভিযান চলছে৷ এই অভিযান থেকে বাঁচতে প্রায় পাঁচলাখের মতো রোহিঙ্গা গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন৷
বাংলাদেশগামী শরণার্থীদের ছবি দেখলে চোখের জল আটকে রাখতে পারেন না লুইন৷ তিনি বলেন, ‘‘রাখাইনে ছোট ছোট শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে বা জবাই করা হয়েছে, এমন রিপোর্টও প্রকাশ হয়েছে৷ এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে এক কাপড়েই বাংলাদেশের দিকে ছুটছেন আমার স্বজাতিরা৷ তারা আশা করেন, সেদেশে বেঁচে থাকতে পারবেন৷ কিন্তু তাদের ভবিষ্যত কেউ জানে না৷''
রোহিঙ্গাদের এই করুণ দশা সত্ত্বেও মিয়ানমারের শান্তির প্রতীক অং সান সু চি'র নীরবতা লুইনকে কষ্ট দেয়৷ সু চি'র ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি সচেতন৷ তা সত্ত্বেও একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে যেটুকু ক্ষমতা সু চি'র প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে তাও তিনি রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে করছেন না বলে মনে করেন লুইন৷
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ জার্মানিসহ নানা দেশে এই ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে দেখে সন্তুষ্ট লুইন৷ তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক স্তর থেকে চাপ দেয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসন সম্ভব হতে পারে৷ তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না দেয়া পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান হবে না বলে মনে করেন নির্বাসিত এই ব্লগার৷ প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার আদৌ কি তা করবে?
প্রতিবেদন: এস্থার ফেলডেন/আরাফাতুল ইসলাম
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশ যাত্রা
নিজের দেশে সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা৷ তবে জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও সীমান্তে কড়াকড়ি অব্যাহত রেখেছ বাংলাদেশ৷ আজও রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী মনে করে মিয়ানমার৷
আশ্রয়ের সন্ধান
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের পরিকল্পিত হামলার জের ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী৷ ফলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ছুটছেন রোহিঙ্গারা৷ সর্বশেষ অস্থিরতায় ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে একশ’র বেশি মানুষের৷
ব্যাপক উদ্বাসন
বাংলাদেশের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখান থেকে এক রোহিঙ্গা শিশুকে পার করছেন এক ব্যক্তি৷ মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা সাতটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, একটি চেকপোস্ট এবং এক শহরের দুই প্রান্তে হামলা করেছে৷
ছবি: Getty Images/R.Asad
বৌদ্ধ শরণার্থীরা ছুটছে দক্ষিণের দিকে
নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার বৌদ্ধরাও নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছেন৷ রোহিঙ্গা মুসলমান এবং রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ ২০১২ সালে সেখানে রক্তাক্ত দাঙ্গা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রবেশ নিষেধ
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা আশ্রয়প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ তবে এ সব বাধার মাঝেও তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন৷ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চারলাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
মানবিক সংকট
একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার কর্মী লিখেছেন: ‘‘অনেক রোহিঙ্গাকে আমরা অসুস্থ অবস্থায় পাচ্ছি৷ এর কারণ তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশের আগে দীর্ঘসময় সীমান্তে আটকে ছিলেন৷ অসুস্থদের মধ্যে নারী এবং শিশুদের সংখ্যা বেশি৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Alam
বাংলাদেশে স্বাগত নয়
কক্সবাজারের কুতুপালাং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া একদল রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের একটি দ্বীপে সরিয়ে নিতে চাচ্ছে যেটি বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
নো ম্যান’স ল্যান্ডের আটকে থাকা
পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা শিশুরা৷ এই মুহূর্তে ছ’হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
7 ছবি1 | 7
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷