প্যারিসের জলবায়ু চুক্তি ইতিমধ্যেই ‘ঐতিহাসিক' বলে সারা পৃথিবীতে প্রশংসা কুড়োচ্ছে৷ কিন্তু সেই প্রশংসা কি তার সত্যিই প্রাপ্য? গ্রেহেম লুকাস-এর সন্দেহ আছে৷
বিজ্ঞাপন
ভালো দিকটা দিয়েই শুরু করা যাক৷ পৃথিবী নামক গ্রহটিতে মানুষ নামক জীবটির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরে বিগত কয়েক বছরের ব্যর্থতার পর প্যারিস চুক্তিকে একটি সাফল্য বলে গণ্য করা চলে বৈকি৷ গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে যে বিতর্ক চলেছে, তা বিবেচনা করলে বলতে হয় যে, যারা জলবায়ু পরিবর্তন ও সেই পরিবর্তনে মানুষের দায়িত্বের কথা অস্বীকার করে থাকেন, তারা এখন হারতে বসেছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রে কিছু কিছু কট্টর রিপাবলিকান জলবায়ু পরিবর্তনের সত্যতা অস্বীকার করতে থাকবেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের যুক্তি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়বে, তা রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা নির্বাচনে জিতলে যতোই প্যারিস চুক্তি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার হুমকি দিন না কেন৷ চীন আর ভারত কার্বন নির্গমন সম্পর্কে তাদের সুর পালটেছে৷ অধিকাংশ পশ্চিমি দেশ ধীরে ধীরে দায়িত্ব নিতে শিখছে, নিম্ন কার্বন অর্থনীতির প্রতি তাদের আকর্ষণ বাড়ছে৷
জলবায়ু সংরক্ষণে আমরা কী অবদান রাখতে পারি?
গোটা বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশের উৎস কয়লা, তেল ও গ্যাস৷ বাকি এক-চতুর্থাংশের জন্য কৃষি ও কাঠ কাটার কাজ দায়ী৷ ১০টি উপায়ে আমরাও কার্বন নির্গমন এড়িয়ে চলতে পারি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কয়লা, তেল ও গ্যাসের কম ব্যবহার
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কল-কারখানা ও পরিবহণ ক্ষেত্রই মূলত কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী৷ শীতের দেশে ঘরবাড়ি গরম রাখতে প্রায় ৬ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করা হয়৷ তাই পরিবেশ সংরক্ষণ করতে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আরও দক্ষতার সঙ্গে জ্বালানি ব্যবহার করা উচিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘ক্লিন এনার্জি’ নিজেই উৎপাদন করুন
বিদ্যুতের জন্য আর কয়লা, তেল বা গ্যাস-ভিত্তিক জ্বালানি কেন্দ্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না৷ বিকল্প জ্বালানি ইতোমধ্যে আরও সস্তা হয়ে উঠেছে৷ নিজস্ব উদ্যোগে জ্বালানি উৎপাদন করে চাহিদা মিটিয়ে প্রায়ই কিছু উদ্বৃত্ত থেকে যায়৷ ছাদের উপর সৌর প্যানেলের জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে৷ এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটছে৷
ছবি: Mobisol
ভালো আইডিয়ার প্রতি সমর্থন চাই
পৌর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানি পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে ও ‘ক্লিন এনার্জি’ বিক্রি করছে৷ যেমন জার্মানির সাবেক শহরের সোলার পার্ক৷ জনসংখ্যা মাত্র ৭,২০০৷ চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আদর্শ হয়ে উঠেছে এই ছোট্ট শহরটি৷ এক মার্কিন প্রতিনিধিদল সেই সাফল্যের রহস্য বুঝতে এসেছে৷
ছবি: Gemeinde Saerbeck/Ulrich Gunka
জলবায়ুর ক্ষতি করলে কোম্পানির লোকসান
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিমা কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, পৌর কর্তৃপক্ষ – সবাই জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগের অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে৷ জার্মানির ম্যুনস্টার শহর কর্তৃপক্ষ সবার আগে এই ‘ডাইভেস্টমেন্ট’ আন্দোলনে শামিল হয়েছে৷ গোটা বিশ্বে মোট ৫৭টি পৌর কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত একই পথ বেছে নিয়েছে৷
ছবি: 350.org/Linda Choritz
গাড়ি ছেড়ে সাইকেল, ট্রাম-বাস, ট্রেন
সাইকেল, ট্রাম-বাস ও ট্রেন ব্যবহার করলে অনেক কার্বন সাশ্রয় করা যায়৷ গাড়ির তুলনায় বাস ৫ গুণ বেশি পরিবেশবান্ধব – ইলেকট্রিক ট্রেন ১৫ গুণ বেশি৷ আমস্টারডাম শহরের বেশিরভাগ মানুষই সাইকেল চালান৷ শহর কর্তৃপক্ষ সাইকেলের জন্য চওড়া পথ তৈরি করেছে৷
ছবি: DW/G. Rueter
বিমানযাত্রা এড়িয়ে চলুন
বিমানযাত্রা পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে৷ হিসেব অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে বছরে গড়ে ৫.৯ টনের বেশি কার্বন নির্গমন করলে চলবে না৷ অথচ বিমানে চেপে বার্লিন ও নিউ ইয়র্ক করলেই যাত্রী প্রতি ৬.৫ টন কার্বন নির্গমন করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Huguen
কম মাংস খান
পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রও সমস্যা সৃষ্টি করে৷ ধানচাষের ফলে এবং গরু, ভেড়া ও ছাগলের পেটের মধ্যে জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর মিথেন সৃষ্টি হয়৷ একদিকে সারা বিশ্বে মাংস খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ অন্যদিকে গবাদি পশুপালনের কারণে পশুখাদ্য হিসেবে সয়াবিনের চাহিদাও বেড়ে চলেছে৷
ছবি: Getty Images/J. Sullivan
অরগ্যানিক খাদ্য কিনুন
লাফিং গ্যাস জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷ গ্রিনহাউস এফেক্টের প্রায় ৬ শতাংশ এই গ্যাসের কারণে ঘটে৷ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ইঞ্জিনের পাশাপাশি বিশাল মাত্রার কৃষিকাজে কৃত্রিম সারের কারণে এই গ্যাস সৃষ্টি হয়৷ অরগ্যানিক খামারে এই বস্তুটি নিষিদ্ধ৷
ছবি: imago/R. Lueger
টেকসই নির্মাণ ও ভোগ
ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষেত্রেও প্রচুর কার্বন নির্গমন ঘটে৷ অন্যদিকে কাঠ ও বাঁশের ক্ষেত্রে সেই ক্ষতির আশঙ্কা নেই৷ নির্মাণের ক্ষেত্রে সঠিক উপকরণ বাছাই করে পরিবেশের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব৷ ভোক্তা হিসেবেও সবার মনে রাখা উচিত, যে প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করলে পরিবেশের কত ক্ষতি হয়৷
ছবি: Oliver Ristau
দায়িত্বশীল হবার পালা
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে গ্রিনহাউস গ্যাস পরিহার করতে হবে৷ স্কুলের এই ছাত্রছাত্রীরা ‘ক্লিন এনার্জি’ সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসাহী৷ ভবিষ্যতের জন্য তারা এটাকে বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে৷ তাদের এই স্বপ্ন পূরণ করতে সবাই সাহায্য করতে পারে৷
ছবি: Gemeinde Saerbeck/U.Gunnka
10 ছবি1 | 10
প্যারিস চুক্তির ঘোষিত লক্ষ্য হল, বিশ্বের উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমিত রাখা৷ এই লক্ষ্য অর্জন করা শেষমেষ সম্ভব না হলেও, তার উল্লেখটাই তো একটা অর্জন৷ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগে বিশ্বের তাপমাত্রা আসলে দুই থেকে তিন ডিগ্রি বাড়বে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা৷ তাহলে প্যারিস চুক্তি জলবায়ু পরিবর্তন রুখবে কীভাবে? দুঃখের বিষয়, ঐ চুক্তির দরুন কেউই কিছু করতে বাধ্য নয়৷ অশ্মীভূত জ্বালানি বর্জন করার কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করা হয়নি৷ অপরদিকে ইচ্ছামতো তেল-কয়লা-গ্যাসের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার জন্যও কোনো দণ্ড নেই৷
প্যারিস চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে, এই হ্রাসের লক্ষ্য ও পরিমাণ নিজেরাই নির্দিষ্ট করতে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ কিন্তু এ সবই স্বেচ্ছায়, বাধ্যতামূলভাবে নয়৷ একক দেশগুলি তাদের দায়িত্ব পালন করছে কিনা, অথবা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে কিনা, তা পরখ করার কেউ নেই৷ অর্থাৎ চুক্তি মেনে না চললেও কোনো সাজা হবে না৷
সবসুদ্ধ বলা চলে যে, প্যারিস চুক্তি ছ'বছর আগে কোপেনহেগেনের মতো পুরোপুরি ব্যর্থ নয়৷ একদিন হয়তো বিশ্বের মানুষ এই চুক্তির কথা স্মরণ করে বলবে, ‘‘পৃথিবীর মানুষ সেই সময় উপলব্ধি করতে শুরু করে, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি কী হতে পারে৷ তবে আমরা যে তখন আরো বেশি করিনি, সেটা একটা ট্র্যাজেডি বৈকি৷''
আপনি কি গ্রেহেম লুকাস-এর সঙ্গে একমত? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
জলবায়ু সম্মেলন: কে কত ছাড় দিতে প্রস্তুত?
প্যারিসে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে প্রায় ১৮৫টি দেশ স্বেচ্ছায় গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর বিচ্ছিন্ন লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরেছে৷ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণের জন্য দায়ী যে দেশগুলি, তাদের মধ্যে কে কতটা ‘ত্যাগ’ স্বীকার করতে প্রস্তুত?
ছবি: picture-alliance/ZB
চীন
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের প্রশাসন ২০৩০ সাল নাগাদ ‘কার্বন ইনটেনসিটি’ ২০০৫ সালের তুলনায় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে চায়৷ সেইসঙ্গে জীবাশ্মভিত্তিক নয়, এমন জ্বালানির অনুপাত বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে চায় চীন৷
ছবি: Getty Images/AFP/W. Zhao
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
২০২৫ সালের মধ্যে (২০০৫ সালের তুলনায়) কার্বন নির্গমনের মাত্রা ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ২০৩০ সালের মধ্যে সে দেশের জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রগুলি কার্বন ডাই-অক্সাইড দূষণের মাত্রা ৩২ শতাংশ কমাতে চায়৷
ছবি: Reuters/M. Ngan
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
২৮ সদস্যের এই রাষ্ট্রজোট ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ১৯৯০ সালের তুলনায় কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কমাতে চায়৷ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২৭ শতাংশ বাড়ানোরও লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে ইইউ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleul
ভারত
২০৩০ সালের মধ্যে (২০০৫ সালের তুলনায়) ‘কার্বন ইনটেনসিটি’ ৩৫ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের৷ সেইসঙ্গে জ্বালানির চাহিদার ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি দিয়ে মেটাতে চায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল এই দেশ৷
ছবি: AP
রাশিয়া
২০৩০ সালের মধ্যে (১৯৯০ সালের তুলনায়) নির্গমনের মাত্রা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমাতে চায় আয়তনের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া৷ অবশ্য অন্যান্য বড় দূষণকারী দেশের অঙ্গীকারের উপর এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y.Smityuk/TASS
জাপান
২০৩০ সালের মধ্যে (২০১৩ সালের তুলনায়) নির্গমনের মাত্রা ২৬ শতাংশ কমানোর অঙ্গীকার করেছে জাপান৷ তবে ফুকুশিমা বিপর্যয় সত্ত্বেও আবার ২০ থেকে ২২ শতাংশ পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভর করছে সে দেশ৷ বিকল্প জ্বালানির অনুপাত বাড়িয়ে ২২ থেকে ২৪ শতাংশে আনতে চায় জাপান৷
ছবি: Reuters/I. Kato
ব্রাজিল
প্রথম ধাপে ২০২৫ সালের মধ্যে (২০০৫ সালের তুলনায়) নির্গমনের মাত্রা ৩৭ শতাংশ কমাতে চায় ব্রাজিল৷ ২০৩০ সালের মধ্যে সেই মাত্রা বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে সে দেশ৷
ছবি: picture-alliance/ZB
ইরান
২০৩০ সালের মধ্যে ইরান নির্গমনের মাত্রা ৪ শতাংশ কমানোর শর্তহীন অঙ্গীকার করেছে৷ সেইসঙ্গে ‘অন্যায় নিষেধাজ্ঞা’ তুলে নিলে এবং আর্থিক সাহায্য ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি দিলে সে দেশ বাড়তি ৮ শতাংশ নির্গমন কমাতে প্রস্তুত৷