‘আমলাদের দিয়ে রাজাকারদের তালিকা যথাযথ হবে না’
১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ডয়চে ভেলে : স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও কেন রাজাকারদের পূর্নাঙ্গ তালিকা করা যায়নি?
শাহরিয়ার কবির : দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তার প্রধান সহযোগী যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থকরা৷ যার ফলে রাজাকার বা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিবরণ মুছে ফেলতে চেয়েছে৷ এ কারণে তারা কখনই উদ্যোগী হয়নি৷ আমরাই ১৯৮৫ সালে প্রথম একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় একটা বই বের করি৷ সেটাই এখন বিভিন্ন জায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার হয়৷ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরীর চেয়েও সহজ হচ্ছে রাজাকারদের তালিকা তৈরী৷ অল্পকিছু সংখ্যক লোক স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে৷ জেনারেল নিয়াজির বইয়ে আছে তারা ৫০ হাজার লোককে রিক্রুট করেছিল, এক লাখ তাদের টার্গেট ছিল৷ তখনকার আনসার বাহিনী পুরোটাই রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তর হয়েছিল৷ মোটামুটি ৫০ হাজারের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা৷
এখন যে তালিকাটি প্রকাশ হতে যাচ্ছে, তাতে কি পূর্নাঙ্গ চিত্র উঠে আসবে?
রাজাকারদের তালিকা করতে অসুবিধা নেই৷ কিন্তু যেসব দলীয় বাহিনী ছিল আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী, শান্তি কমিটি এগুলোর তালিকা করা একটু দুরুহ হবে৷ কারণ জামায়াতে ইসলামী তো স্বীকার করতে চায় না, আল-বদর তাদের ঘাতক বাহিনী ছিল৷ এদের রেকর্ড জামায়াত রাখেনি৷ আমলাদের দিয়ে রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করলে সেটা যথাযথ হবে না৷ কারণ বেশিরভাগ আমলার জন্মই হয়নি তখন৷ এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের সহযোগিতা নেওয়া দরকার৷
মানবতাবিরোধী কয়েকজনের বিচার হয়েছে, কয়েকজনের বিচার চলছে৷ বিচার প্রক্রিয়ার গতি কি কমে গেছে?
বিচারের গতি তো কমেছেই৷ প্রধান বিচারপতি সিনহার সময় দু'টো ট্রাইব্যুনালকে একটা করা হয়৷ একটা বন্ধ করে দিলেন৷ সুপ্রিমকোর্টে শুনানি বিলম্বিত করে দিলেন৷ আমরা সরকারকে বারবার বলছি, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালটা পুনরায় চালু করার জন্য৷ সামনে বড় রকমের চ্যালেঞ্জিং বিচার রয়েছে৷ আপনারা জানেন জার্মানিতে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচার হয়েছে৷ হিটলারের নাৎসি পার্টির হাইকমান্ডের বিচার হয়েছে৷ এখন আমরা জামায়াতে ইসলামীর বা আল-বদর বাহিনীর বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি৷ একটা ট্রাইব্যুনাল দিয়ে এটা সম্ভব নয়৷
মানবতাবিরোধীদের বিচারে সরকারের গা ছাড়া ভাব লক্ষ্য করেন কি-না?
লোকবলের অভাবের কথা তো আমরা শুরু থেকেই বলছি৷ কয়েকদিন আগে তুরিন আফরোজকে বাদ দেয়া হয়েছে৷ এভাবে করা ঠিক হয়নি৷ এখানে দক্ষ জনশক্তির অভাব আছে৷ এটা পূরণ করতে হবে৷ এটা সরকার কেন করছে না সেটা আইনমন্ত্রী ভালো বলতে পারবেন৷
সারাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কতদূর?
আমরা বলেছি, একজন যুদ্ধাপরাধীও যদি বেঁচে থাকে এবং কেউ যদি অভিযোগকারী থাকেন তাহলে তার বিচার হতে হবে৷ বঙ্গবন্ধুর সময় সাধারণ ক্ষমার পর ১১ হাজার ব্যক্তি জেলে ছিলেন৷ ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে৷ এখন তো সেটা সম্ভব নয়৷ এখন অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত এদের অনেকেই মারা গেছে৷ এখন ৭০০ জনের মতো একটা তালিকা আছে তদন্ত সংস্থার কাছে৷ তারা কাজ করছে৷
অনেকেই সরকারি দলে যোগ দিয়ে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ আছে?
মানবতাবিরোধী কেউ সরকারি দলে গেছে এমন কোন তথ্য নেই৷ তবে জামায়াত বা বিএনপি থেকে অনেকেই সরকারি দলে যোগ দিয়েছেন নিজেদের বাঁচাতে বা সুবিধা পেতে সেগুলো আমরা জানি৷ আমরা যেটা জানি জামায়াতের অনেকেই আওয়ামী লীগে ঢুকে রেডিক্যালাইজ করার চেষ্টা করছে৷
এখনো তো দেশে জামায়াত সক্রিয়? এই দলটাকে সরকার নিষিদ্ধ করে না কেন?
সরকার চাচ্ছে বিচারের মাধ্যমে তাদের নিষিদ্ধ করতে৷ জামায়াত নিষিদ্ধকরণের বাইরেও একটা প্রচণ্ড চাপ আছে৷ আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট তো মনে করে, জামায়াত মডারেট মুসলিম পার্টি৷ তাদের নিষিদ্ধ করলে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে এবং তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আরো কঠিন হবে৷ পশ্চিম ইউরোপও এমনটাই মনে করে৷ আমরা বলছি, শুধু ৭১ এর গণহত্যার জন্য নয়, এখন যে সন্ত্রাস হচ্ছে সেটার জন্যও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা দরকার৷
আওয়ামী লীগ এত লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও যেটা হয়নি, ভবিষ্যতে কি সেটা সম্ভব?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবাতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে যে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে সেটা সরকারের সিদ্ধান্তে৷ কিন্তু বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার বিচার করতে বাধ্য হয়েছে৷ আমরা আশাবাদি, বাংলাদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে এবং সব যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে৷ সরকারকে বুঝতে হবে জঙ্গি দমন করতে হলে তাদের দর্শন বন্ধ করতে হবে৷