জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, ‘‘মাঠে খেলছেন আমলারা৷ রাজনীতিবিদরা সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছেন৷'' এখন প্রশ্ন হলো, রাজনীতিবিদেরা কেন রাজনীতিতে নাই৷ আমলারা কেন তা দখল করছেন?
বিজ্ঞাপন
রোববার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী অফিস মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে জিএম কাদের আরো বলেন, ‘‘সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক হচ্ছেন জনগণ আর তাদের ভোটে নির্বাচিতদেরই দেশ পরিচালনার কথা৷ কিন্তু কাজকর্মে এমপি সাহেবদের খবর নেই, আর সচিব-সাহেবরা সব কাজ করেন, মন্ত্রী মহোদয়েরা শুধু জানতে চান৷''
জিএম কাদের যে পরিস্থিতির কথা বলেছেন তাতে দেশের প্রকৃত চিত্রই ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা৷ তারা এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গণতন্ত্রের জন্য আরো দুঃখজনক পরিণতির আশঙ্কা করেন৷
অবশ্য তারা মনে করেন, আমলারাজোর করে রাজনীতিতে ঢুকছেন না৷ রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছেন তারা৷ তাদের মতে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যদি আমলাতন্ত্র নির্ভর হতে হয় তাহলে আমলারা সুযোগ নেবেনই৷ স্বাভাবিক নিয়মেই রাজনীতিবিদেরা তখন সাইডলাইনে চলে যাবেন৷ তারা এটাকে বলছেন, ‘‘স্যাড স্টোরি৷''
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সররকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘‘এখন প্রশাসনের সচিব বা পদস্থ কর্মকর্তারা অবসরের পরই রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এমপি মন্ত্রী হতে চান৷ আর কাজটি শুরু করেন সরকারি চাকরিতে থাকার সময়ই৷ তারা সরকারি চাকরিতে থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন৷ সভা সমাবেশে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন৷''
‘‘আমলারা চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন’’: তারেক শামসুর রহমান
এই সুযোগটি তারা কেন পাচ্ছেন? সরকারি চাকরিতে থাকতেই তাদের কেন রাজনৈতিক আচরণ করতে দেখা যায়? এর জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘এর দায় রাজনীতিবিদদের৷ বিএনপিকে আর কী বলবো! ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই যা অবস্থা তাতে আমলা নির্ভর হওয়া ছাড়া তাদের আর উপায় কী থাকতে পারে৷''
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘জিএম কাদেরের ভাই( এইচএম এরশাদ) বেঁচে থাকলে তাকে তিনি প্রশ্ন করলে ভালো করতেন৷ এই রাজনীতিবিদদের সাইডলাইনিং-এ তার কোনো ভূমিকা আছে কিনা?''
দক্ষিণ এশিয়ার সফল নারী রাজনীতিকরা
উন্নত দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের হার কম৷ তবে এ অঞ্চল থেকেও উঠে এসেছেন অনেক নারী রাজনীতিবিদ৷ তাঁদের কারো কারো সাফল্য খুব উল্লেখযোগ্য৷ এমন নারী রাজনীতিবিদদের নিয়েই এই ছবিঘর...
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
ইন্দিরা গান্ধী, ভারত
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬ সালে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া ইন্দিরা ভারতের ‘লৌহমানবী’ নামে খ্যাত৷ ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও পরে ১৯৮৪-তে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’-এর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের জন্য সমালোচিত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/KPA
শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা৷ ২০১৬ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাশালী নারী তালিকায় ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা৷ সবচেয়ে বেশি সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার রেকর্ডও তাঁর দখলে৷
ছবি: Reuters/A. Alfiky
খালেদা জিয়া, বাংলাদেশ
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রথম নারী হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন৷ প্রথমবারে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ও পরে আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন৷
ছবি: Bdnews24.com
বেনজির ভুট্টো, পাকিস্তান
১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ ও ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া বেনজির ভুট্টো কোনো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী৷ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এই নেত্রী ২০০৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর দল ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’র নেতৃত্ব দেন৷ রাজনীতির প্রথম পাঠ তিনি তাঁর পিতা, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর কাছে পেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে, শ্রীলঙ্কা
বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে৷ তিন দফায় (১৯৬০-৬৫, ১৯৭০-৭৭, ১৯৯৪-২০০০) দ্বীপ দেশটির দায়িত্বে ছিলেন তিনি৷ শ্রীলঙ্কার সরকারী ভাষাকে ইংরেজি থেকে বদলে সিনহালা করার ফলে তিনি দেশের তামিল সংখ্যালঘুদের রোষের মুখে পড়েন৷
ছবি: picture alliance/Sven Simon
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারত
জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ রেল, কয়লা, যুব, নারী ও শিশু বিষয়ক একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
সোনিয়া গান্ধী, ভারত
প্রধানমন্ত্রী না হলেও ভারতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক একটি নাম সোনিয়া গান্ধী৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বামী রাজীব গান্ধী প্রয়াত হবার পর কংগ্রেসের দায়িত্বে আসেন তাঁর ইটালীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী সোনিয়া৷ ২০০৪ সালে সোনিয়ার নেতৃত্বেই কংগ্রেস দেশের ক্ষমতায় এলেও প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন মনমোহন সিং-এর হাতে৷ প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধির কারণে তাঁর নাম স্থান পেয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের তালিকায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Hadebe
জয়ললিতা, ভারত
পাঁচ দফায় দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ভারতের তামিল নাড়ু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জয়ললিতা৷ জনসাধারণের কাছে ‘আম্মা’ বা মা নামে খ্যাত এই নেত্রী এককালে দক্ষিণী চলচ্চিত্রের নামকরা অভিনেত্রীও ছিলেন৷ ২০১৬ সালে ৫ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷
ছবি: Dibyangshu Sarkar/AFP/Getty Images
মায়াবতী, ভারত
উত্তর প্রদেশ-কেন্দ্রিক বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) মুখ্যত দলিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের পার্টি৷ ২০০১ সালে দলের ভার নেন মায়াবতী৷ বিভিন্ন দলের সমর্থনে চারবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন মায়াবতী৷ রাজ্যের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর নাম ভারতের সর্বোচ্চ করদাতাদের তালিকায় বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Das
চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, শ্রীলঙ্কা
১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ছিলেন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা৷ এছাড়া নির্বাচন চলাকালীন সময়ে ১৯৯৪ সালে আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও তিনিই পালন করেন৷ দেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজোঁ অফ অনার’ পান ২০১৮ সালে৷ এই সম্মান পাওয়া প্রথম শ্রীলঙ্কার নাগরিক তিনিই৷
ছবি: picture-alliance/AP/Vincent Thian
হিনা রব্বানী খার, পাকিস্তান
২০১১- থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন হিনা রব্বানী খার৷ ৩৩ বছর বয়সি হিনা এই দায়িত্ব পেয়ে ইতিহাস গড়েন৷ পাকিস্তানে তিনিই প্রথম নারী হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়ে দেশের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হবারও রেকর্ড গড়েন৷ দেশে ও বিদেশে যুবপ্রজন্মের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বিষয়ে বক্তব্য রাখা এই নেত্রী বর্তমানে পাকিস্তানের সংসদ সদস্য৷
ছবি: dapd
সুষমা স্বরাজ, ভারত
মোট দশবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়া প্রয়াত সুষমা স্বরাজ সবশেষ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন৷ রাজনীতিতে আসার আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুষমা মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে হরিয়ানার ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন৷ ২০১৭ সালে মার্কিন পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ বিজেপির এই রাজনীতিবিদকে ভারতের ‘সবচেয়ে প্রিয় রাজনীতিক’ আখ্যা দেয়৷ ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
12 ছবি1 | 12
বাংলাদেশে করোনা ব্যবস্থাপনা ও এনিয়ে নানা কাজে মন্ত্রী এমপিসহ মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ হয়তো কিছু করছেন৷ কিন্তু প্রশাসনিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে তারা অনুপস্থিত৷ ফলে যারা জনপ্রতিনিধি তাদের কাজ চলে গেছে আমলাদের কাছে৷ আমলারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন৷ ফলে সাধারণ মানুষ কোনো কিছু জানতে জানতে পারছেন না৷ কারুর কাছে যেতে পারছেন না৷ এটা কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়৷
আর আমলারাও রাজনীতির বাইরে এই অযাচিত ক্ষমতা পেয়ে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷ জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন নিজেই ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রশাসনের কমর্কর্তাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রবণতা এত পরিমাণে এখন বেশি যে প্রতিদিন তিন-চারটি করে বিভাগীয় মোকদ্দমা শুনতে হয় এবং বিভাগীয় মোকদ্দমায় অনেকের শাস্তি হচ্ছে৷ এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক৷''
‘‘এটা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্য একটা স্যাড স্টোরি’’: শান্তনু মজুমদার
ড. তারেক শামসুর রহমান মনে করেন, আমলাদের প্রভাব এখন অনেক বেশি বেড়ে গেছে৷ ক্ষমতার প্রয়োজনে আমলা নির্ভরতার পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে রাজনীতিবিদদের দক্ষতার অভাবেও এটা হয়েছে৷ তবে এটা হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদেরা৷ কিন্তু এখন তা করছেন আমলারা৷ তারা চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন ও তৎপরতা চালান৷ তাহলে রাজনীতিবিদেরা কী করবেন?''
এর ফলেসরকার ও রাজনীতি এখন আমলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে৷ অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘এটা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্য একটা স্যাড স্টোরি৷''