বিরক্তিকর এই কবিতা থেকে যেন নিজেকে আড়াল রাখার জো নেই৷ কারণ ওই কবির সমালোচনায় ফেসবুকে বন্ধু তালিকায় সবাই যেন উঠে পড়ে লেগেছে৷
নবীরুল ইসলাম বুলবুলের লেখা সেই ‘শ্যালিকা’ কবিতাটি পড়েই ফেলতে হলো৷ যন্ত্রণা উদ্রেককারী কবিতাটির শুরুটা ছিল এমন, ‘শ্বশুর বাড়ি মধুর হাড়ি/ শ্যালিকা নেই মাথায় বাড়ি৷/ কে দেবে বনরুটি/ কে করবে খুনশুটি/ কে খাওয়াবে কোর্মা-পোলাও/ বিদায় বেলায়, কে দেবে লাউ!’
কাব্য পাঠ শেষে যারা কবিতাটি শেয়ার দিচ্ছেন তারা সবাই কবিকে তুলোধুনো আর কটাক্ষ করতে ছাড়েননি৷ স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কেন?
সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস বাড়াতে চায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ তাই জেলা-উপজেলায় বই কিনতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা৷ আর তৈরি করা হয়েছে ১ হাজার ৪৭৭টি বইয়ের তালিকা৷ সেই তালিকায় একশটিরও বেশি বইয়ের লেখক সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তত ২৫ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা৷
তাদের একজন হলেন ‘শ্যালিকা' কবিতার রচয়িতা নবীরুল ইসলাম বুলবুল৷ যিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ এই কর্মকর্তার লেখা ২৯টি বই স্থান পেয়েছে সরকারের করা তালিকায়৷ যার বেশিরভাগই কবিতার বই৷ নবীরুলের ২৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে মৃত্তিকা প্রকাশন নামের একটি প্রকাশনী থেকে৷
বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা আর ট্রলের শিকার হন কবি নবীরুল৷
অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের তৈরি করা ওই তালিকায় ছিল না পল্লিকবি জসীমউদ্দীন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, ঔপন্যাসিক শওকত আলী বা বদরুদ্দীন উমরের মতো গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একটি বইও৷ ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও তীর্যক মন্তব্য করতেও ছাড়েননি সচেতন পাঠক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরাও৷
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে, বিদ্রূপ করে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক গোলাম কিবরিয়া নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘স্যারের কাব্য প্রতিভা আমার মতো নাদানকেও বাধ্য করেছে কাব্য রসে সিক্ত হতে.... লিখেই ফেললুম একখানা:
শ্যালিকা পার্ট টু (পার্ট ওয়ান স্যার লিখেছেন)
শ্যালিকা ও আমার শ্যালিকা/ আমারে ছাইড়া তুই গেলিগা/ আসকে আমার তাই মন বালো নেই/ হৃদয়ে লোডশেডিং, আলো নেই/ শ্যালিকা তুই কই গেলিরে/ তুই আমার জবা কুসুম বেলিরে...’
‘আলোচিত স্যারের একটা কবিতা পড়ি!’ লিখে নবীরুল ইসলাম বুলবুলের ‘শ্যালিকা' কবিতাটি শেয়ার করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট ও প্রকাশক রবীন আহসানও৷
সমালোচনার ঝড়ে অবশ্য পিছপা হয়েছে সরকার৷ নবীরুল কাণ্ডে ক্ষেপেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন নিজেও৷ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন তিনি৷
ফরহাদ হোসেনকে ঊদ্ধৃত দেশের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ‘একজন কর্মকর্তা যিনি এই দায়িত্বের মধ্যে ছিলেন তার ২৯টি বই থাকবে কেন? এটি অশোভন৷ আমি নিজে বলছি যে এটা ঠিক হয়নি৷ এটা নিয়ে আমরা বসব৷ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব৷'
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম জানিয়ে দিয়েছেন, ১ হাজার ৪৭৭টি বইয়ের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে৷ নতুন করে তালিকা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করার কথাও জানিয়েছেন সরকারের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা৷
পুরো তালিকাটি বাতিল করে দেয়ার বিপক্ষে নিজের অভিমত একটি দৈনিকে ব্যক্ত করেছেন কথা সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান৷ এজন্য নিজের সপক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছেন তিনি৷
স্বকৃত নোমান লিখেছেন, ‘আমাকে যদি এই তালিকায় নম্বর দিতে বলা হয়, আমি ১০০-এর মধ্যে ৯০ দেব৷ আমার দেখা গত ১৫ বছরে সরকারি উদ্যোগে যেসব বই কেনা হয়েছে, জনপ্রশাসনের এ তালিকা সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট৷ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে ম্যাক্সিম গোর্কি, গার্সিয়া মার্কেস প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই বাদ যায়নি৷ বাদ যায়নি ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোও৷ বই নির্বাচন কমিটি হলে এর চেয়ে ভালো তালিকা কমিটি তৈরি করতে পারত না৷ আমি নিশ্চিত৷ অতীতে কমিটির কাজ দেখেছি৷ দেখে হতাশ হয়েছি৷'
তবে অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম বুলবুলের বই নিয়ে অবশ্য তার সীমাহীন আপত্তি রয়েছে৷ তার ২৯টি বইকে তালিকায় দেখতে চান না স্বকৃত নোমান৷
তিনি লিখেছেন, ‘এই লেখকের নাম সাহিত্য জগতের কেউ আগে কখনও শোনেনি৷ শুনতে হবে এমন কোনো কথা নেই৷ অনেক নিভৃতচারী লেখক থাকেন৷ সকাল থেকে বিভিন্ন সূত্র থেকে নবীরুল ইসলামের কয়েকটি বইতে চোখ বুলিয়েছি৷ অত্যন্ত নিম্নমানের লেখা৷ এটাই সমস্যা৷ ভালো মানের লেখা হলে তার বই রাখা যেতেই পারে৷ আমলা বলে তাকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই৷ কিন্তু তার লেখা সাহিত্য গুণহীন৷'
সাহিত্য আর আমলা—এ দুটি বিষয় একত্রিত হলেই যেন বিতর্ক৷ চলতি বছর এ বিতর্কের শুরুটা হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণার পর৷
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত ১৫ মার্চ এ বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে সরকার৷ সাহিত্যে অবদান রাখায় মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় কবি আমির হামজাকে৷
আমির হামজার নাম ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়৷ প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যে তার অবদান নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে৷ একপর্যায়ে হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়৷
বাবার পুরস্কারপ্রাপ্তির পেছনে তার মেজো ছেলে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানের তৎপরতার খবরও আসে সংবাদমাধ্যমে৷ পরে পুরস্কারের তালিকা থেকে আমির হামজার নাম বাদ দেয়া হয়৷
এরপর গত মে মাসে আমির হামজার ছেলে খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা করা হয়৷
তবে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আমলাদের যে বিশাল দূরত্ব রয়েছে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়৷ অনেক সরকারি কর্মকর্তা যুগে যুগে নিজের সাহিত্যপ্রতিভায় মুগ্ধ করেছেন পাঠকদের, হয়েছেন সমাদৃত৷
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বঙ্কিম চটোপাাধ্যায়৷ তাকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়৷
আরেক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় রচনা করেছেন কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মিনী উপাখ্যান'৷ এটিকে বাংলা কাহিনী কাব্যের আধুনিক ধারার সূচনা-গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়৷ সেই কাব্যগ্রন্থে ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্বশৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়'—তার এই চরণ পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে৷
যাদুবাস্তবতা আশ্রয়ী ঔপন্যাসিক শহীদুল জহিরও ছিলেন একজন আমলা৷ কিন্তু লেখনীর স্বকীতা ও গুণে সচেতন পাঠকের হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনাধি কাল ধরে৷
এমন নাম কম নয়৷ ফলে আমলারা ভালো সাহিত্য রচনা করলে সেটা যে পাঠক গ্রহণ করবে না বিষয়টিকে এভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই৷ বরং সাহিত্য প্রতিভা দিয়ে তারাও পাঠকের মন জয় করুক, তা নিয়েও কারও মধ্যে কোনো কার্পণ্য নেই৷
কিন্তু ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তার নিম্নমানের রচনা ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস' গড়ার নামে অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের পাঠ্য করে ফেলার সিদ্ধান্তে পাঠক তো আপত্তি তুলবেই৷ সেই আপত্তি যৌক্তিক ছিল বলেই সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে৷
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের প্রতি সমর্থনও দিয়েছে অসংখ্য মানুষ৷ কারণ ভালো বই পড়ার মধ্য দিয়ে আমলাদের মধ্যে আরও বেশি মানবিক গুণাবলি বিকশিত হবে, দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনসেবায় তারা আরও নিবেদিতপ্রাণ হবে—এমন প্রত্যাশা অমূলক কিছু নয়৷