আধুনিক শহুরে সভ্যতায় প্লাস্টিক আবর্জনা বড় সমস্যা৷ আমস্টারডাম শহরে এমন জঞ্জাল পুনর্ব্যবহারের এক অভিনব পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে৷ প্লাস্টিক বোতল থেকে তৈরি হচ্ছে নৌকা৷
বিজ্ঞাপন
আমস্টারডামে নৌকা-বিহার৷ তবে মারিউস স্মিট ঠিক শহর ঘুরতে আসেননি, এসেছেন ‘ফিশিং' করতে৷ মাছ নয়, প্লাস্টিক বোতল ধরতে৷ বোতলের পরিমাণ কম নয়৷ মারিউস বলেন, ‘‘এটা বোতল, অন্য রকম ফেনা, প্লাস্টিক ব্যাগ৷ দেখলে মনে বড় দুঃখ লাগে৷ কত রকমের জঞ্জাল! এমন জিনিস কেন খালে এসে পড়ে?''
আমস্টারডাম শহরের খালপথ পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ৷ কিন্তু যেখানেই বেশি মানুষ, সেখানেই বেশি আবর্জনা৷ খাল পরিষ্কার রাখতে স্মিট ‘প্লাস্টিক হোয়েল' নামের এক কোম্পানি গড়ে তুলেছেন৷ তাই তিনিই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম ‘প্লাস্টিক জেলে'৷ মারিউস স্মিট বলেন, ‘‘আমার সন্তানদের এটা অদ্ভুত লাগে৷ কারণ বাবারা সাধারণত ব্যাংকে কাজ করে অথবা স্বাভাবিক চাকরি করে৷ তাদের বাবা প্লাস্টিক জেলে৷ সম্প্রতি আমার ৬ বছরের সন্তান প্রশ্ন করেছিল, বাবা তুমি সারাদিন ঠক কী করো? আমি পানি থেকে প্লাস্টিক তুলি – এটা বলতে সত্যি অদ্ভুত লাগে৷''
কিন্তু তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সেই কাজ করেন৷ বাকিদেরও উৎসাহ জোগান৷ কোম্পানিতে তাঁর অধীনে ২০ জন কর্মী কাজ করছেন৷ ‘প্লাস্টিক হোয়েল' সংস্থার কর্মী স্কিপ ডে ফোগড বলেন, ‘‘পর্যটনের জন্য এটা ভালো৷ মানুষ বলবে, এটা পরিষ্কার শহর৷ অতএব শুধু পরিবেশ নয়, সৌন্দর্য রক্ষাও কাজের অংশ৷ আমি এই কাজ করতে পেরে সত্যি গর্বিত৷ সবাইকে বলি, খালি সময়ে এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ৷''
তবে শুধু প্লাস্টিক সংগ্রহ করাই প্লাস্টিক জেলেদের জন্য যথেষ্ট নয়৷ তাঁরা রিসাইক্লিং-ও করেন৷ প্লাস্টিক বোতল দিয়ে নৌকা তৈরি হয়৷ এমনকি তাঁদের নিজস্ব নৌকাও আমস্টারডামের প্লাস্টিক জঞ্জাল দিয়ে তৈরি৷ এক জায়গায় আরও নোংরা জঞ্জাল রয়েছে৷ অন্যদিকে প্লাস্টিক হালকা, শক্তপোক্ত এবং ভালোভাবে ভেসে থাকতে পারে৷ অর্থাৎ নৌকা তৈরির আদর্শ উপকরণ৷ মারিউস স্মিট বলেন, ‘‘মানুষ যখন আমাদের নৌকা দেখেন, তখন তাঁরা সেটা ছুঁতে চান৷ কারণ তাঁরা জানতে চান, আমরা কীভাবে প্লাস্টিক আবর্জনা দিয়ে নৌকা তৈরি করি৷ তাঁরা পুরোপুরি বিশ্বাসও করেন না৷ অথচ প্রক্রিয়াটা মোটেই তেমন কঠিন নয়৷''
পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ
গত কয়েক বছরে ঢাকায় প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায়, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ তবে বর্তমানে বেশ কিছু প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারাখানা গড়ে ওঠায়, এ সমস্যা অনেকটাই দূর হওয়ার পথে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবেশের হুমকি প্লাস্টিক বোতল
ঢাকার একটি দোকানে প্লাস্টিক বোতলগুলোয় বিভিন্ন রকম পানীয়৷ গত কয়েক বছরে প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায়, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ব্যবহৃত বোতল যেখানে সেখানে ফেলায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে৷ তবে এবার বেশ কয়েকটা প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারাখানা গড়ে ওঠায় এ সমস্যা দূর হতে যাচ্ছে বলে আশা করছেন অনেকেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
কামরাঙ্গীর চরের কারখানা
ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে এনে বিক্রির জন্য পরিমাপ করা হচ্ছে কামরাঙ্গীর চরের একটি কারখানায়৷ এখানে ধরণ অনুযায়ী প্রতি কেজি বোতলের জন্য দেয়া হয়ে থাকে ছয় টাকা থেকে পনেরো টাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী
পরিমাপের পর বাছাই করার জন্য বোতল নামাচ্ছেন এক মহিলা কর্মীরা৷ ঢাকার বিভিন্ন বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী৷ কামরাঙ্গীরচরের এ সব কারখানায় মহিলা শ্রমিকেরা পুরুষের চেয়ে কম বেতন পান৷ এক সপ্তাহ কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিকের বেতন কমপক্ষে ২০০০ টাকা৷ অথচ সমান কিংবা তারও বেশি কাজ করে একজন নারী শ্রমিক পান মাত্র ১৪০০ টাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কারখানার জন্য স্বতন্ত্র জায়গা
বিভিন্ন রঙের বোতলগুলো বাছাই করে আলাদা করা হয়৷ এ সব প্লাস্টিকের বোতল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে আসে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা৷ রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ সব রপ্তানীকারকদের দশ ভাগ ‘ইনসেনটিভ’ দিয়ে থাকে৷ এছাড়া এ ধরণের কারখানার জন্য স্বতন্ত্র একটি জায়গার কথাও ভাবছে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআই৷
ছবি: DW/M. Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কারখানার শ্রমিকরা কাজ করেন মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে৷ ছবিটা দেখেই যেটা একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আপনার কাছে – তাই না?
ছবি: DW/M. Mamun
ধোয়া ও শুকানো
বোতলগুলো চূর্ণ করে ভাঙার পরে সেগুলো ফেলা হয় ছোট এই চৌবাচ্চায়৷ এরপর সেখান থেকে ধুয়ে সেগুলো শুকানোর জন্য দেয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
রপ্তানির জন্য প্রস্তুত
পানিতে ধোয়া প্লাস্টিকের টুকরা শুকানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে৷ বলা বাহুল্য, এগুলোকে সম্পূর্ণ পানিমুক্ত করে তবেই রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
চূড়ান্ত বাছাই
সবশেষে চূড়ান্ত বাছাই করা হয় টুকরাগুলো৷ এ সব প্লাস্টিকের টুকরাগুলো মূলত চীনে রপ্তানি করা হয়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ সব বর্জ্য প্লাস্টিক৷ এই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয় মূলত বিভিন্নরকম ফাইবার৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঝুঁকিপূর্ণ কাজ
বোতলগুলোকে এ পর্যায়ে মেশিনে দিয়ে ভাঙা হয়৷ এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি মহিলা ও পুরুষেরা সমানভাবেই করে থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি বর্জ্য তৈরি
এ সব কারখানা ঢাকা থেকে বর্জ্য অপসারণে ভূমিকা রাখলেও, নিজেরাই আবার ভূমিকা রাখে বর্জ্য তৈরিতে৷ প্লাস্টিক বোতলের যেসব অংশের বাণিজ্যিক মূল্য নেই, সেসব সরাসরি ফেলা হয় পাশের বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে৷ ফলে এ নদীটির জলপ্রবাহ প্রায় বন্ধের উপক্রম৷
ছবি: DW/M. Mamun
10 ছবি1 | 10
‘প্লাস্টিক হোয়েল' কোম্পানির দপ্তরে গেলে এই প্রক্রিয়া দেখা যায়৷ মারিউস স্মিট বলেন, ‘‘এটা একটা সাধারণ বোতল, যা খাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ এরপর তা শ্রেডারিং ও ধোয়ার কাজ হয়৷''
তারপর প্লাস্টিকের কণা বেরিয়ে আসে৷ মারিউস বলেন, ‘‘এই কণা থেকে আমরা ফোম প্লেট তৈরি করি৷ নৌকার মৌলিক উপকরণ হিসেবে সেটা ব্যবহার করা হয়৷ এটাই নৌকার ভিত্তি৷''
এর মধ্যে তিনি তিনটি নৌকা তৈরি করেছেন৷ আরও তিনটির পরিকল্পনা চলছে৷ এই আইডিয়া অনেককেই উৎসাহিত করছে৷ অনেক সংস্থা নিজস্ব কর্মীদের প্রমোদভ্রমণের জন্য বায়না করছেন৷ প্লাস্টিক ফিশিং ব্যাপারটার সঙ্গে আজকের ট্রেন্ডের বেশ একটা যোগসূত্র রয়েছে৷