‘আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৬ আগস্ট ২০১১![Screenshot der Seite tagoreweb.in Flash-Galerie Rabindranath Tagore ###Hinweis: Bild nur in Zusammenhang mit der Berichterstattung der Seite verwenden!###](https://static.dw.com/image/5555281_800.webp)
রবীন্দ্রনাথ আমাদের, অর্থাৎ বাঙালিদের চোখে উপনিষদের একজন ঋষি ছিলেন৷ ছোট বেলা থেকে আমিও সেভাবেই তাঁকে চিন্তা করতে অভ্যস্ত৷ কিন্তু বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বিদেশে, রবীন্দ্রনাথকে একজন আধ্যাত্মিক কবি হিসেবে ধরা হয় - এ কথা কি খুব সহজেই মেনে নেওয়া যায়? প্রশ্ন করি সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আমাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী উজ্জ্বল ভট্টাচার্য্যকে৷ তিনি বলেন,‘‘রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছু ছিলেন এবং সেই সঙ্গে আধ্যাত্মিক কবিও ছিলেন৷ তাঁর যে রচনাকর্ম, তাঁর জীবন, নিজের সময়ে নিজের ভুমিকা খোঁজার চেষ্টা এবং সেই অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা - সব ক্ষেত্রেই তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা বা ঈশ্বরচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল৷ সুতরাং সেই হিসেবে বলা চলতে পারে যে, তিনি আধ্যাত্মিক কবি ছিলেন বা আধ্যাত্মিক কবিও ছিলেন৷''
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, উপনিষদের সব পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটি নারীর ব্যাকুল বাণী ধ্বনিত-মন্ত্রিত হয়ে উঠেছে - যা কখনোই বিলীন হয়ে যায়নি৷ তিনিও জানতেন,
অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়...
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম৷
অর্থাৎ, হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও; হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক৷
তাই স্বাভাবিকভাবেই উজ্জ্বল ভট্টাচার্য্যের কাছে জানতে চাই - রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তায় উপনিষদের ভূমিকা কি? উজ্জ্বল ভট্টাচার্য্যের কথায়, ‘‘রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কৈশোরের প্রারম্ভে, তখন তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে নিয়ে হিমালয়ে যেতেন৷ এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের এক স্তম্ভ৷ উনি রবীন্দ্রনাথকে উপনিষদের শ্লোক পড়াতেন, মুখস্থ করতে দিতেন, তার মানে বলে দিতেন৷ সেই যে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ, উপনিষদের সঙ্গে পরিচয় এবং তার সঙ্গে হিমালয়ের পরিবেশ - এগুলোর একটা গভীর ছাপ তাঁর জীবনে পড়েছে৷ আমার মনে হয়, তাঁর রচনাকর্মের প্রথম দিকে এটাই ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী ছাপ৷ ফুল যেভাবে কুঁড়ি থেকে বিকশিত হয়, তেমনই উপনিষদের চিন্তা থেকেই রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার বিকাশ হয়েছে৷''
এই যেমন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম' গ্রন্থে লেখেন, ‘মানুষের আলো জ্বালায় তার আত্মা, তখন ছোটো হয়ে যায় তার সঞ্চয়ের অহংকার৷ জ্ঞানে-প্রেমে-ভাবে বিশ্বের মধ্যে ব্যাপ্তি দ্বারাই সার্থক হয় সেই আত্মা৷ সেই যোগের বাধাতেই তার অপকর্ষ, জ্ঞানের যোগে বিকার ঘটায় মোহ, ভাবের যোগে অহংকার, কর্ম যোগে স্বার্থপরতা৷' লেখেন, ‘ভৌতিক বিশ্বে সত্য আপন সর্বব্যাপক ঐক্য প্রমাণ করে, সেই ঐক্য-উপলব্ধিতে আনন্দিত হয় বৈজ্ঞানিক৷'
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাহলে তাঁর জীবনে এবং রচনার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার একটি বিশেষ সূত্র পাই? নাকি এক্ষেত্রে তাঁর চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটেছে? উজ্জ্বল ভট্টাচার্য্য জানান, ‘‘প্রথম যে কাব্যগ্রন্থটি যেখানে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তার একটা আভাস মেলে, সেটা হচ্ছে ‘নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থে৷ নৈবেদ্যের ঈশ্বর - কিছুটা বলা যেতে পারে ‘কর্পোরেট ঈশ্বর'৷ তার নিশ্চিত কর্তব্য আছে৷ তিনি একজন দূরের মানুষ৷ তার কাছে রবীন্দ্রনাথ দাবি জানাচ্ছেন - ‘আমাকে এভাবে গড়ে তোলো'৷ এবং ঈশ্বর, স্বদেশ, সমাজ - এই তিনটে মিলে একটা ত্রিভুজ তৈরি হচ্ছে৷ সেখান থেকে আমরা দেখছি, তাঁর যে গীতপর্ব - গীতাঞ্জলী, গীতিমাল্য, গীতালি - তাতে তাঁর যে ব্যক্তিস্বত্ত্বা, তাঁর যে ক্ষুদ্র আমির জগত, তার সঙ্গে যে এই বিশ্ব-আমির সম্পর্ক - সেটাকে তিনি খোঁজার চেষ্টা করছেন, ছটফট করছেন এবং ধীরে ধীরে সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন৷ গীতালিতে সেই পর্ব পুরো হয়েছে৷ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ‘কবির নাম ও সর্বনাম'-এ এটাকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখা করেছেন৷ অবশ্য অন্যান্যরাও করেছেন৷ যেমন আবু সৈয়দ আয়ুব এবং কবি শঙ্খ ঘোষ এই পর্বটি নিয়ে বিশেষ চিন্তা করেছেন৷ এটাকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব৷ আর তৃতীয় পর্বে রবীন্দ্রনাথ উদার এক মহাসমুদ্রের মতো হয়ে উঠেছেন৷ সেটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের চারটি কাব্যগ্রন্থ৷''
তাই কবিগুরুর কবিতার ভাষাতেই আবারো বলা যায়,
মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা৷
….কে সে৷ জানি না কে৷ চিনি নাই তারে৷
শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে,
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তর প্রদীপ-খানি৷
কে সে, চিনি নাই তারে...৷
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী