এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে আমাদের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠছে৷ সাম্প্রতিক কালে একাধিক পরিষেবা মানুষের অনেক কাজ সহজ করে তুলেছে৷
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে সেই প্রযুক্তির অপব্যবহারের দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই৷
২০২৩ সালে এআই বড় আকারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে৷ চ্যাটজিপিটিথেকে শুরু করে মিডজার্নির মতো অনেক প্রয়োজনীয় অ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে৷ কিন্তু ভুয়া খবর ও নিয়ন্ত্রণের অভাব সম্পর্কে ভয়ভীতিও বেড়ে চলেছে৷
২০২৩ সালে এআই-এর ক্ষেত্রে উত্থানপতনের দিকে একবার নজর দেওয়া যাক৷ ড্যাল-ই ও মিডজার্নির মতো ছবি সৃষ্টির পরিষেবার কল্যাণে ২০২২ সালের শেষের দিকেই এআই-কে ঘিরে উত্তেজনা শুরু হয়েছিলো৷ আচমকা শুধু বর্ণনার মাধ্যমেই যে কোনো ছবি সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল৷
২০২৩ সালে এআই-এর মাধ্যমে সৃষ্টি করা ছবি দিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে৷ এমনকি এক প্রতিযোগিতায় বিচারকমণ্ডলী না বুঝেই এমন এক ছবিকে পুরস্কৃত করেছেন৷
সেলফি ছবিকে চাকুরির আবেদনের সিভির উপযুক্ত করে তুলতে ‘রেমিনি'-র মতো এআই পোর্ট্রেট অ্যাপ ভাইরাল হয়েছে৷ তবে লিঙ্গ বৈষম্য ও ইউরোপ-কেন্দ্রিক ছবি সৃষ্টির কারণে এমন সব অ্যাপ বিতর্কও সৃষ্টি করেছে৷
বাড়ছে এআই-র ব্যবহার-অপব্যবহার
04:00
যেমন লেন্সা নামের অ্যাপ মহাকাশচারী, রক তারকা বা সুপারহিরো হিসেবে যে কোনো মানুষের পোর্ট্রেট ছবি সৃষ্টি করতে পারে৷ তবে ডিডাব্লিউ সহকর্মী রজার ও আদ্রিয়ানার উপর পরীক্ষা চালিয়ে একেবারে ভিন্ন ফল পাওয়া গেল৷ রজার নিজের একাধিক পুরুষালি সংস্করণ পেলেও কলম্বিয়া থেকে আসা আদ্রিয়ানার ছবিতে ত্বকের রং অনেক বেশি ফরসা দেখাচ্ছে৷ তার চোখের রং নীল এবং অনেক ছবিতে তাকে স্বল্প পোশাকে দেখা যাচ্ছে৷ অথচ সে যে সব সেলফি আপলোড করেছিল, তাতে তার পোশাক মোটেই সে রকম ছিল না৷
এছাড়া ‘ডিপফেক ইমেজ' বা ভুয়া ছবির কারণে এআই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷ ডনাল্ড ট্রাম্পকে পুলিশ গ্রেফতার করছে, এমন ডিপফেক ছবির কথা মনে আছে? এমন ছবি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের আবেগ নিয়ে খেলে রাজনৈতিক শিবিরে আলোড়ন তোলা যায়৷
তাছাড়া অনেক শিল্পীও এমন ইমেজ জেনারেটর নিয়ে খুশি নন৷ তাঁরা নিজেদের সৃষ্টিকর্ম অনলাইনে দেওয়ার পর তাদের সম্মতি ছাড়াই এআই মডেল ট্রেনিংয়ের কাজে সেগুলি ব্যবহার করা হয়েছে৷ এখনো পর্যন্ত এআই ইমেজের কপিরাইট সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি৷
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে চ্যাটজিপিটি প্রকাশ করা হয়৷ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এই পরিষেবার ব্যবহারকারীদের সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে৷ কিছু সময়ের জন্য কনজিউমার অ্যাপ হিসেবে সেটি সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধির রেকর্ড দখল করেছিল৷ মাইক্রোসফট চ্যাটজিপিটি সৃষ্টিকারী ওপেনএআই কোম্পানিতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে৷ বিং নামের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে সেই চ্যাটবট জুড়ে এই কোম্পানি বিং চ্যাট সৃষ্টি করে৷
কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা: আদি থেকে বর্তমান
বর্তমানে প্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় চ্যাটজিপিটি৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা দিয়ে এটি তৈরি৷ এআই প্রযুক্তির শুরু থেকে এই পর্যায়ে আসার পেছনে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
দৈনন্দিন জীবনে এআই
স্মার্টফোন খুলতে ফেস আইডির ব্যবহার, ফেসবুকে পছন্দের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, জীবনযাপনে সিরি-আলেক্সার ব্যবহার - এসবের পেছনে আছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৷ কিন্তু একদিনে এই প্রযুক্তি এত দূর আসেনি৷
ছবি: Reuters/T. Peter
এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রকে কিছু ‘শেখানোর’ মাধ্যম হচ্ছে ‘আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কস’ বা এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম৷ ১৯৪৩ সালে মার্কিন নিউরোফিজিওলজিস্ট ও সাইবারনেটিশিয়ান ওয়ারেন ম্যাককালেক এবং কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্টিস্ট ওয়াল্টার পিটসের গবেষণাপত্রে প্রথম এএনএন ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়৷
ছবি: Axel Bueckert/Zoonar/picture-alliance
প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোবট
মার্কিন বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নিউরোফিজিওলজিল্ট ও সাইবারনেটিসিয়ান উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার ১৯৮৪ সালে এলমার ও এলসি নামে দুটি রোবট তৈরি করেছিলেন৷ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারা প্রথম রোবট এগুলো৷ আলো ও স্পর্শ ব্যবহার করে তারা বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারতো৷
ছবি: United Archives/IMAGO
পড়াশোনার বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি
মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি (ছবি) ১৯৫৫ সালে প্রথম ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ টার্মটি ব্যবহার করেন৷ এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন যেখানে পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্বীকৃতি পায়৷
ছবি: AP/picture alliance
প্রথম চ্যাটবট
সিরি, আলেক্সার কথা আমরা সবাই জানি৷ তবে ১৯৬৬ সালে ‘এলিজা’ নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল, যাকে প্রথম এআই চ্যাটবট বলা হয়৷ এলিজা মানুষের কথা বুঝতে পারত, কথাও বলতে পারত৷ যদিও তার নির্মাতা জার্মান-অ্যামেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইওসেফ ভাইৎসেনবাউম (ছবি) প্রায়ই বলতেন, এলিজা বুদ্ধিমান নয়৷
স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এসআরআই-এর ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার’ ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ‘শেকি’ নামে একটি রোবট তৈরি করেছিল, যেটি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ শেকির আগে তৈরি সব রোবটকে প্রতিটি ধাপে নির্দেশ দিতে হত৷ কিন্তু শেকির তা প্রয়োজন ছিল না৷ এসআরআই-এর ওয়েবসাইট বলছে শেকি ছিল প্রথম মোবাইল রোবট যার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার ক্ষমতা ছিল৷
ছবি: SRI International
দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারানো
এআই গবেষণার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে খেলা৷ একটি এআই চেস প্রোগ্রাম ১৯৮০র দশকে চেস মাস্টার ডেভিড লেভিকে খেলায় হারিয়ে দিয়েছিল৷ আর ১৯৯৬ সালে আইবিএম এর ‘ডিপ ব্লু’ কম্পিউটার তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল৷
ছবি: Stan Honda/AFP/Getty Images
প্রথম রোবটিক খেলনা
একটি মার্কিন কোম্পানি ১৯৯৮ সালে রোবোটিক খেলনা ‘ফার্বি’ বাজারে এনেছিল৷ প্রথমে এটি ‘ফার্বিশ’ বলতো৷ কিন্তু তাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, তাকে ইংরেজি ভাষা ও শব্দ শেখানো শুরু করলে সে একসময় তা বলতে পারতো৷ ফার্বির মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ প্রথম বুঝতে পারে যে, চাইলে যন্ত্রকে কিছু শেখানো যায়৷
ছবি: PA Fearn/dpa/picture alliance
জিওপার্ডি! কুইজ শো জয়
২০১০ ও ২০১১ সালে আইবিএম-এর ওয়াটসন কম্পিউটার সিস্টেম মার্কিন টেলিভিশন কুইজ শো ‘জিওপার্ডি!’তে অংশ নিয়ে দুজন চ্যাম্পিয়নকে হারাতে সক্ষম হয়৷
ছবি: IBM/dpa/picture alliance
ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট সিরির আগমন
২০১১ সালে অ্যাপল ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট ‘সিরি’ নিয়ে আসে৷ এটি মানুষের কথা বুঝতে পেরে সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে৷ এআই জগতে সেই সময় এটি একটি অন্যতম সাফল্যের ঘটনা ছিল৷ সিরির পর এসেছে আলেক্সা, গুগল- যা এখন প্রায় সবাই ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ লিখেছিল রোবট
২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট জিপিটি-৩৷ এটি মার্কিন এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর ল্যাঙ্গুয়েজ-জেনারেটর৷ প্রবন্ধটি পড়তে এই লিংকে (shorturl.at/cjnzT) ক্লিক করুন৷
ছবি: Getty Images
রোবোকাপ
রোবোটিকস ও এআই গবেষণা এগিয়ে নিতে ১৯৯৬ সালে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রোবোকাপ টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন৷ এটি প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে৷ ‘রোবট সকার ওয়ার্ল্ড কাপের’ সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে রোবোকাপ৷
ছবি: JACK TAYLOR/AFP/Getty Images
বিশ্বকাপের বলে এআই প্রযুক্তি
কাতার বিশ্বকাপে অফসাইড ধরতে এআই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছিল ফিফা৷ এর সাহায্যে বলের মধ্যে থাকা সেন্সর ও ছাদে থাকা ১২টি ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটবলার ও বলের অবস্থান আরও ভালোভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: DW
চ্যাটজিপিটি
মার্কিন ওপেনএআই কোম্পানির তৈরি চ্যাটজিপিটি একটি শক্তিশালী মেশিন লার্নিং মডেল৷ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের মতো লেখা বা টেক্সট তৈরি করার ক্ষমতা৷ এর মানে হলো, কোনো একটি বিষয়ে একজন মানুষ যেমন প্রত্যুত্তর দিতে পারে, চ্যাটজিপিটিও সেরকমই জবাব লিখে জানাতে পারে৷ এটি চ্যাটবটের মতো অ্যাপগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
14 ছবি1 | 14
বর্তমানে অনেক মানুষ ইমেল, কোডিং ও গবেষণার জন্য নিয়মিত বিং এবং অন্যন্য চ্যাটবট ব্যবহার করেন৷ ব্রাজিলে এমনকি চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে লেখা একটি আইনও কার্যকর করা হয়েছে৷ কিন্তু কখনো ভুল উত্তরের কারণে এআই চ্যাটবটগুলির সমালোচনা করা হয়েছে৷ সেই অবস্থাকে ‘হ্যালুসিনেশন' মা মতিভ্রম বলা হয়৷ এভাবে এমন পরিষেবা কার্যত ‘ফেক নিউজ' বা ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়৷ তাছাড়া অনেক মানুষ এআই মডেলে নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য ভরার বিষয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন৷ ফলে ইটালিতে কিছু সময়ের জন্য চ্যাটজিপিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷
২০২৩ সালে আরেকটি ‘গেম চেঞ্জার' এসেছে৷ কৃত্রিম অডিও, কণ্ঠের নকল ও সৃজনশীল ভাবনার ফসল হিসেবে কিছু মজাদার ভিডিও আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে৷ তাছাড়া স্পটিফাইয়ের ‘ভয়েস ক্লোনিং'-এর মতো টুল পডকাস্টারদের ক্ষমতা বাড়াতে চায়৷ বিভিন্ন ভাষায় তাদের কণ্ঠের নকল করে পডকাস্টাররা এমন মানুষের নাগাল পাচ্ছেন, যাদের কাছে অন্যভাবে পৌঁছানো সম্ভব হতো না৷
কিন্তু কণ্ঠ ক্লোন করার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপফেকও সৃষ্টি করা হয়েছে৷ যেমন ড্রেক ও দ্য উইকেন্ড নামের গায়কদের কণ্ঠ নকল করে ‘হার্ট অন মাই স্লিভস' নামের গান সৃষ্টি করা হয়েছে৷ তাঁদের রেকর্ড কোম্পানি ‘ইউনিভার্সাল মিউজিক গ্রুপ' সে বিষয়ে মোটেই খুশি হয় নি৷ কপিরাইট লঙ্ঘনের দায়ে মামলার জের ধরে শেষ পর্যন্ত সেই ট্র্যাক সরিয়ে নিতে হয়েছে৷
এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া এআই অডিও ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে নির্বাচনি প্রচার চালানো হচ্ছে৷