সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ তনুর বাবা মনে করেন, বিশেষ এলাকায় এই খুন হওয়ায় বিচার পাওয়া যাবে না৷ তাই তাঁর কথায়, ‘‘আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি, তিনিই বিচার করবেন৷''
ছবি: Twitter
বিজ্ঞাপন
ঠিক একবছর আগে, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ, শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনুকে হত্যা করা হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়৷ তনুর বাবা ক্যান্টমেন্টেই সিভিল চাকরি করেন৷ ঐ রাতে তাঁদের ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে ভিতরেই আরেকটি বাসায় ছাত্র পড়াতে গিয়েছিলেন তনু৷ পরে তাঁর লাশ পওয়া যায়৷
হত্যাকাণ্ডের পর থেকে চারবার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হলেও, তনু হত্যার সঙ্গে জড়িত কাউকে চিহ্নিত বা আটক করতে পারেননি পুলিশ৷ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডি-র সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহমেদ এখনো ‘মামলার তদন্ত চলছে' বললেও, কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেননি৷ তনুর লাশের দু'দফা ময়না তদন্ত করেও কোনো ফল হয়নি৷ ডিএনএ টেস্টেও জড়িতদের কাউকে শনাক্ত করা যায়নি৷ তনুর পরিবারের পক্ষ থেকে সন্দেহভাজনদের নাম জানানো হয়েছিল তদন্তকারীদের৷ তাদের ধরার ব্যাপারেও পুলিশ কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷
তদন্ত কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘তদন্তে নতুন কোনো অগ্রগতি নেই৷ গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সেনাবাহিনীর মহড়া থাকায় প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি৷ তবে তনুর মোবাইল ফোন, ব্যাগ, স্যান্ডেলসহ আরো কিছু জিনিসের ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া গেলে তদন্ত এগিয়ে নেয়া যাবে বলে আশা করি৷''
Yar Hossain - MP3-Stereo
This browser does not support the audio element.
তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিআইডি আমাদের মামলার তদন্ত নিয়ে এখন আর কিছু জানায় না৷ কাউকে গ্রেপ্তার বা আটকও করেনি তারা৷ অথচ আমাদের চুপচাপ থাকতে বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে কথা না বলতে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আমার মনে হয়, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তনুকে হত্যা করা হয়েছে বলেই এর বিচার হবে না৷ যদি বাইরে হতো তাহলে বিচার পেতাম, আসামিরা ধরা পড়তো৷ আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি৷ তিনিই বিচার করবেন৷''
ইয়ার হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের চাপ দেয়া হচ্ছে৷ নানা ধরনের চাপের শিকার হচ্ছি আমরা৷ মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে৷ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের চারিকটাও শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা জানি না৷ প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই আবেদন, আমরা বাঁচতে চাই, আমরা বিচার চাই৷''
তনুর বাবা বলেন, ‘‘গত একটি বছর আমার মেয়ে ছাড়া বেঁচে আছি৷ আশা ছিল বিচার পাবো৷ কিন্তু সে আশাও এখন আর নেই৷ আমার ভিতরে এখন শুধু আগুন জ্বলছে৷''
এদিকে তনু হত্যা মামলার তদন্তে এক বছরেও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় সিআইডিকে ১০ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে আল্টিমেটাম দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লা শাখা৷ আগামী ১০ দিনের মধ্যে সিআইডি যদি তদন্তে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে না পারে, তাহলে ২ এপ্রিল থেকে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলবে তারা৷
সোমবার দুপুরে কুমিল্লা সিআইডিকে স্মারকলিপি দেয়ার পর, গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লা জেলার মুখপাত্র খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, ‘‘সংবাদ সম্মেলন করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে লাগাতার আন্দোলনে নামবো৷ আমরা আশা করি, অচিরেই তনু হত্যাকারীদের শনাক্ত করে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে৷''
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷