‘রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ এনে দেয়া পেশাক খাত অনেকের টার্গেট'
৪ এপ্রিল ২০২৫
ডয়চে ভেলে: এবার ঈদের আগে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব পোশাক শ্রমিক বেতন, ভাতা পাননি৷ শেষ পর্যন্ত কয়েকটি কারখানা দিতেই পারেনি৷ এরকম কেন হলো?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: পেলো না, মানে কত জন পেলো না? আমরা ৬ মার্চ মিটিং করে বলে দিয়েছিলাম ২৫ মার্চের মধ্যে বকেয়া বেতনসহ বোনাস দিতে হবে৷ আর এপ্রিল মাসেরও অর্ধেক বেতন দিতে হবে৷ ছুটি কবে থেকে হবে তা-ও বলা ছিল৷ আমাদের হিসাব মতে, ২৫ মার্চের মধ্যে ৯৯ শতাংশ পোশাক কারখানায় বেতন-বোনাস হয়েছে৷ কম-বেশি হতে পারে৷ ২৫ মার্চ পর্যন্ত ১২টি ফ্যাক্টরিতে সমস্যা ছিল৷ তাদের মালিকরা পালিয়ে গেছে৷ তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা বৈঠক করে ২৭ মার্চে সর্বশেষ সময় বেঁধে দিই৷ তারা তাদের গাড়ি, বাড়ি বিক্রি করে দেবে, না কিভাবে দেবে, তারা জানে৷ তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়৷ ২৭ তারিখের পর থেকে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়৷ সর্বশেষ পাঁচটি কারখানা নিয়ে সমস্যা হয়৷
তাদের ব্যাংকে সমস্যা ছিল৷ টিএনজেডকে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা দেয়৷ অন্যগুলোর সমস্যা সমাধান হলেও ২৭ মার্চ রাত পর্যন্ত টিএনজেড-এর আংশিক সমাধান হয়৷ আরো কয়েকটি কারখানার সমস্যা ছিল৷ যেমন, আওয়ামী লীগের এমপি সাইফুজ্জামান শিখরের কারখানার সমস্যা ছিল৷ সেই সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করবো? তারপরও আমরা আমাদের স্পেশাল ফান্ড থেকে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা দিয়েছি৷ টিএনজেড গার্মেন্টসকে আমরা গত নভম্বেরে ১৭ কোটি টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি৷ তারপরও তাদের বাকি ১৬ কোটি টাকা৷ এই টাকা কি সরকার দেবে? মালিক বিদেশে থাকেন৷ তার প্রতিনিধি একজন ডাইরেক্টর শাহিন সাহেবকে আমরা পুলিশ হেফাজতে নিই৷ তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন৷
টিএনজেড-এর সমস্যার তো সমাধান হয়নি...
শ্রম ভবনের সামনে শেষ পর্যন্ত ১০০ শ্রমিক ছিলেন৷ আমার মনে হয়েছে, কোনো কোনো শ্রমিক নেতা তাদের উসকানি দিয়েছে৷ তারা সমস্যার সমাধান চায়নি৷ তারা সমস্যাটা ৩১ মার্চ ঈদের দিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চেয়েছে৷ গোয়েন্দা রিপোর্টও আছে৷ তারা যে হাঁড়ি মিছিল করলো, তারা হাঁড়ি কোথায় পেলো? শেষ পর্যন্ত তাদের ১০ হাজার টাকা করে বোনাস দেয়া হয়েছে৷ তারা চলে গেছে৷ ৮ এপ্রিল আবার বৈঠক করবো সমাধানের জন্য৷ এই ফ্যাক্টরিগুলো চালানো যাবে না৷ এগুলো আমরা পুরোপুরি বন্ধ করে দেবো৷ যেমন, বেক্সিমকো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এখন একটি কারখানার ১৬ কোটি টাকা বেতন বাকি৷ কোরবানির আগে আরো বকেয়া হবে৷ তখন কী হবে? তাই আমরা বন্ধ করে দেবো৷ তবে ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা হয়৷ আগেও হয়েছে৷ এবার পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারতো৷ কিছু কারখানা আগেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ তাদের শ্রমিকরা এখন অন্য কারখানায় কাজ করছে৷ তাদেরও তো বকেয়া বেতন বোনাস দিতে হবে৷
পোশাক খাত থেকেই বলতে গেলে সিংহ ভাগ রপ্তানি আয় আসে৷ মালিকরাও ব্যবসা করেন৷ সেই বিবেচনায় মালিকপক্ষ, সরকার কি তাদের প্রতি সুদৃষ্টি দিচ্ছে?
আমাদের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে এই তৈরি পেশাক থেকে৷ ফলে এই সেক্টরটা অনেকের জন্য টার্গেট৷ এই সেক্টরটা যদি এলোমেলো করে দেয়া যায়, শ্রমিক আন্দোলনের নামে, তাহলে যারা এই দেশটাকে সামনে এগোতে বাধা দিচ্ছে, তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়৷ শ্রমিক অসন্তোষ করে গার্মেন্টগুলো বন্ধ করে দিতে পারলে ইকোনমি কলাপস করে দেয়া যায়৷
কিন্তু মালিকরা কি শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার করছেন?
আগে তো বিজিএমইএ সরকার ছিল৷ তারাই সরকার চালাতো৷ এই মালিকরা এখন কোথায় আছে? সালাম এফ রহমান, নাসা গ্রুপ কোথায় আছে? হয় জেলে আছে, নয় পালিয়ে গেছে৷ আওয়ামী লীগের এমপি শিখর হঠাৎ করে তার কারখানা বন্ধ করে দিলো৷ এখানে শ্রমিকরা আগে মালিকদের ওপর কথা বলতে পারতো না৷ এখন কথা বলতে পারছে৷ আগে তো মালিকরাই সরকার ছিল৷ তারা তো শ্রমিকদের ওপর চাপ দিতে পারতো৷ এই চাপটা তো এখন উঠে গেছে৷ সেই কারণে শ্রমিকদের সব দাবি-দাওয়া এখন সামনে আসছে৷ গত ১৫ বছরে যারা ব্যবসা করেছে, তাদের তো সরকারের সঙ্গে লিংক ছিল৷ তারা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পাচার করেছে৷ তারা তো এখন কোনো দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না৷ তারা চায় একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে৷ পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিতে৷
বন্ধ করে দিলে কি সামাধান হবে?
না, সমাধান হবে না৷ ধরেন, একজন শ্রমিকের বেতন ২০ হাজার টাকা৷ বন্ধ করে দিলে তার সব মিলিয়ে পাওনা হবে দেড় লাখ টাকা৷ এই টাকা তো তাকে দিতে হবে৷ সেখানে তো একটা বিশৃঙ্খলা হবে৷ আবার এই শ্রমিকরা তো কর্মহীন হয়ে যাবে৷ তাদের কোনো কাজ না থাকলে তো এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে৷ শ্রমিক নেতারা একদিকে মালিকের পক্ষে কাজ করে বেনিফিটেড হয়৷ আবার শ্রমিকদের ব্যবহার করে৷ এটাই হলো সমস্যা৷
১২ হাজার ৫০০ টাকা পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি৷ এটা বাড়ানোর কোনো চিন্তা আছে কি-না...
আমরা শ্রমিকদের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করেছি৷ এটা করতে মালিকদের অনেক চাপ দিতে হয়েছে৷ এটা কিন্তু ডাবল হয়েছে৷ এখন শ্রমিক নেতারা বলছে, এটা ২০ শতাংশ করতে হবে৷ কিন্তু মালিকদেরও তো বাঁচাতে হবে৷ এই আন্দোলন তো ভালো গার্মেন্টসেও ছড়িয়ে পড়েছে৷ তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ তারা ভালো গার্মেন্টসে কাজ করতে দিচেছ না৷ কাজ করলে ইট-পাটকেল ছুড়ে বন্ধ করে দিচ্ছে৷ রোড অ্যাক্সিডেন্টে পোশাক শ্রমিক মারা গেলেও কারখানায় হামলা হয়৷
ট্রেড ইউনিয়ন করতে তো নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের সম্মতি লাগে৷ কিন্তু আইএলও তো এই শর্ত উঠিয়ে দিতে বলছে৷ আপনার কী করছেন?
আমরা আইনটি আরো শিথিল করে দেবো৷ এখন ২০-২৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগে৷ প্রথমে মনে করেছিলাম, এটা ১৫ শতাংশ করবো৷ এখন আমরা মনে করছি, এই শর্ত উঠিয়ে দেবো, কোনো শর্ত থাকবে না৷ আমরা আইএলও-তে গিয়েছিলাম৷ আমাদের ব্যাপারে সবাই পজিটিভ আছে৷ একজন শ্রমিক নেতা সেখানে কবির নামে একজনকে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ তুলেছিল৷ কিন্তু সে তো কারখানায় আগুন দেয়া মামলার আসামি৷ তাহলে কেউ ফৌজদারি অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় নেয়া যাবে না?
এক সময় পোশাক কারখানার ৮০ ভাগ কর্মী ছিলেন নারী৷ এখন তা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে৷ এর কারণ কী?
হ্যাঁ, এখন ৫৫ ভাগে নেমে এসেছে৷ কিছু কাজ আছে, ভারী কাজ যেগুলো আগে থেকেই পুরুষরা করতো৷ তারপরে আমাদের তো কোনো স্টাডি নাই৷ আবার কিছু কাজ আছে মেয়েরাই করে৷ এখন মেয়েরা কেন কমে যাচ্ছে সেটার তো কোনো জরিপ ছাড়া কারণ বলা যাবে না৷
এখানে সেইফটি সিকিউরিটির বিষয় আছে কি-না? এগুলোর কি উন্নতি হবে না?
যেগুলো কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি, সেখানে তো সেইফটি সিকিউরিটি আছে৷ আমরাও দেখি৷ সেখানে শিশু শ্রমও নাই৷ অ্যাবিউজ করে, রেপ করে- এগুলো তো জাতীয় সমস্যা৷ এগুলো যে গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদেরই শুধু টার্গেট করে হয়, তা নয়৷ এগুলো তো জেনারেল ইস্যু৷
যখন তখন শ্রমিক ছাঁটাই৷ কারাখানা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া- এগুলো তো হচ্ছে...
মালিকরা কারখানা চালাতে পারে না৷ তখন তো এগুলো হয়৷ ছাঁটাই হয়, কারখানা বন্ধ হয়৷ এখন আমরা একটা মেকানিজম বের করবো. যাতে এগুলো হঠাৎ করে না হয়৷ আমাদের অনুমতি নিতে হয়৷ এগুলো নিয়ে কাজ করছি৷