1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘সামাজিক রীতি-নীতি সবকিছু দিয়েই নারীকে ছোট করে রাখা হয়েছে'

২২ আগস্ট ২০২৫

পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ ও রোধের উপায় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

পর্দার পেছনে এক নারী দেখছেন বাইরের দৃশ্য৷
একটি সহিংস সম্পর্কের মধ্যে আমরা সারা জীবন থাকবো না। সেখানে যদি একজন নারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে তিনি ওই সম্পর্কের বাইরে গিয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করবেন, তিনি সেটা করতে পারেন। ছবি: Rafael Ben-Ari/Chameleons Eye/Newscom World/IMAGO

ডয়চে ভেলে: পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ কী? কারা এর শিকার হন?

মালেকা বানু: পারিবারিক সহিংসতার প্রধানত শিকার হন নারী ও শিশুরা। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে  পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা। তারা যে-কোনো তুচ্ছ কারণে সহিংসতার শিকার। সব দায় যেন তাদের। এটা হলো না, ওটা হলো না, রান্না ঠিকমতো হলো না, ভাতটা ঠিকমতো নরম হলো না- এর সব দায় নারীর। যে-কোনো  কারণে নারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এটা  সমাজ অনুমোদিত।  আবার যৌতুক আরেকটা কারণ। এখন আবার আরেকটা চিত্র আছে, তা হলো, এখন অল্প শিক্ষিত থেকে উচ্চ শিক্ষিত সব শ্রেণির নারীই সচেতন হচ্ছে। তারা প্রতিবাদ করছে। আবার সে আয় করতে শিখছে, কিন্তু সেই আয়ে তার আবার অধিকার নাই। সেটা সে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে। নারী যখন এসব নিয়ে কথা বলছে, তখন সে পরিবারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তার অধিকারবোধ তৈরি হচ্ছে। পছন্দ- অপছন্দ প্রকাশ  করছে। এটা পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে পারছে না। সে নারীর স্বাধীন প্রকাশ নিতে পারছে না। নারীকে নির্যাতন করে দমন করতে চাইছে।

 আমরা বলি পারিবারিক সহিংসতা। সেটা তো আসলে শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় নারীর প্রতি সহিংসতা। পরিবারে পুরুষের প্রতি কি সহিংসতা আমরা দেখি?

সেটা তেমন দেখি না। সেটা হলেও নারীর তুলনায় কিছুই না। একটা-দুইটা হয়তো হয়। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা নারী হিসাবে জন্ম নেয়ার কারণে হয়। এ কারণেই আমরা বলি পারিবারিক সহিংসতার প্রধান শিকার নারী। আর যেটা হয়, সেটা মানুষের প্রতি যে মানুষের সহিংসতা- সেটা।

কখনো কখনো দেখি, নারী পারিবারিক সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাবা-মায়ের কাছে চলে যায় বা অন্য কোনো আশ্রয়ে যায়। তখন এর প্রতিকারের উদ্যোগ না নিয়ে বুঝিয়ে আবার স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এমন কেন হয়?

আগেই তো বললাম যে,নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজ অনুমোদন করে। ফলে, তার পাশে কেউ দাঁড়ায় না। বোনের পাশে ভাই দাঁড়াচ্ছে না, বোনও দাঁড়াচ্ছে না, বাবা-মাও দাঁড়ায় না, পরিবারও দাঁড়ায়না। এটা একটা চক্রের মতো। মৃত্যু অবধারিত জানার পরও তাকে আবারো সেইখানেই পাঠানো হয়। মৃত্যু ছাড়া যেন নারীর মুক্তি নাই।

পরিবারে নারী তো নারীর সহিংসতারও শিকার হন। শাশুড়ি, জা বা ননদের হাতেও তো নির্যাতনের শিকার হন। এটা আপনি ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে?

এটা হলো পিতৃতান্ত্রিক দুষ্টিভঙ্গি, যা সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়ই বহন করে। সমাজে নারীর অবস্থা হলো, নারী কোনো কথা বলতে পারবে না, সে কোনো কিছুতেই ‘না' বলতে পারবে না। নারীর নিজের কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারবে না। সব তাকে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হবে। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। এটা নারী-পুরুষ সবার মধ্যে আছে।

এ ব্যাপারে আইন কি যথেষ্ট আছে? নাকি আরো কঠোর আইন দরকার?

আমরা যত কঠোর আইন করবো, তত শাস্তির হার কমবে। পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কিন্তু একটা আইন আছে (পারিবারিক সহিংসতা(প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন,২০১০)। এই আইনটি কিন্তু একটা প্রোগ্রেসিভ আইন। এর মূল লক্ষ্য হলো, পারিবারিক সুরক্ষা। পরিবারের মধ্য থেকেই সুরক্ষা দেয়া। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। এই আইনটি বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে না।  এর বাইরে নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোাধী আইন আছে, তার মাধ্যমেও বিচার করা সম্ভব। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতা রোধে যে আইন, সেটা বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার

18:51

This browser does not support the video element.

পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে স্বামীর হাতেই স্ত্রী বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন,স্বামীর হাতেই স্ত্রী বেশি হত্যার শিকার হচ্ছেন। এটা কেন হচ্ছে? এটা তো একটা ভালোবাসার বন্ধনের জায়গা।

এখানে সম্পর্কের যে সমীরণ, আমাদের পরিবার ব্যবস্থায় সেটা তো ক্ষমতার সম্পর্ক। আমি তোমার চেয়ে ঊর্ধ্বতন। পুরুষের আধিপত্য। সবকিছু আমার মতো করে হতে হবে। যদি না হয়, তাহলেই নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাই স্বামীর হাতেই স্ত্রী বেশি নির্যাতনের শিকার হন। স্বামীও তো পিতৃতান্ত্রিকতা দ্বারাই পরিচালিত হন। সম্পর্কটা সেভাবেই নির্ধারিত হয়।

তাহলে নারীর আর্থিক সক্ষমতা কি তার মুক্তির জন্য কাজ করবে না? তার স্বাধীন চিন্তা কি তাকে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে না?

আসলে পুরুষের যে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, সেটাকে এখনো চ্যালেঞ্জ করা যাচ্ছে না। আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারছি না। আর রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজের কারণে পারা যাচ্ছে না। বিভিন্ন আইন আছে, যা পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে। পারিবারিক আইনে তো নারীকে পুরুষের অর্ধেক করে রাখা হয়েছে। আমাদের সামাজিক রীতি-নীতি, ব্যবস্থা, আইন সবকিছু দিয়েই তো নারীকে ছোট করে রাখা হয়েছে। এই জায়গাগুলো যদি চ্যালেঞ্জ না করা যায়, তাহলে তো নারীরা এগোতে পারবে না। নির্যাতনের শিকার হবে।

মালেকা বানু, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক৷ছবি: DW/Sazzad Hossain

শিশুরাও তো পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে বেশি।

শিশুরা তো সবচেয়ে ভালনারেবল। সে দুর্বল। সে প্রতিরোধ করতে পারে না। প্রতিবাদ করতে পারে না। তার প্রতি অপরাধ করে সহজেই পার পাওয়া যায়। সে অভিযোগও করতে পারে না। সে ভয় পায়। পরিবার ও পরিবারের বাইরে সে সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল। ফলে তাদের প্রতি সহিংসতা বেশি হয়। সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকেই এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। আমাদের শিক্ষা কারিকুলামেও এটা নিয়ে কাজ করা যায়।

নারী যদি পরিবারে সহিংসতার শিকার হয়, তখন সে যদি তার সুরক্ষার জন্য আলাদা থাকতে চায়, পরিবার থেকে বের হতে চায়। তা কি এই সমাজ মেনে নেয়?

এই সমাজে নারীদের সিঙ্গেল থাকা খুবই কঠিন। অনেক শিক্ষিত নারী পরিবারে সহিংসতার শিকারহয়েও বিবাহ বিচ্ছেদে যেতে চায় না। আলাদা থাকতে চায় না। তার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ এখানে একটা বাধা। সমাজ একটা বাধা। একলা মেয়ে হিসবে বসবাস না করতে পারা একটা বাধা। আরো অনেক রকম বাধা আছে। একা বাসাভাড়া নিয়ে থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক বাধা তো আছেই। আবার যারা অর্থনৈতিকভাবে ন্বাবলম্বী, তারাও নানা কারণে একটা সহিংস সম্পর্কের মধ্যে জীবন কাটায়। তার একটা ট্রমাটিক অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়।

দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। এর জন্য আবার কেউ কেউ নারীকে বেশি দায়ী  করার চেষ্টা করেন। আসলে পরিস্থিতি কী?

দায়ী করার বিষয় না এটা। আমরা যারা নারী আন্দোলন করি, তারা কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদকে সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখি না। একটি সহিংস সম্পর্কের মধ্যে আমরা সারা জীবন থাকবো না। সেখানে যদি একজন নারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে তিনি ওই সম্পর্কের বাইরে গিয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করবেন, তিনি সেটা করতে পারেন। সেটা আজকাল কেউ কেউ করছেন। করছেন না যে, তা নয়। কিন্তু ছেলেরা কী করছে ? কথায় কথায় তালাক দিচ্ছে, ২৪-২৫ বছরের সংসার ভেঙে দিচ্ছে। পুরুষের যে সংসার ভেঙে দেয়ার প্রবণতা, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার কারণ ভিন্ন। কিন্তু নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদে বাধ্য হচ্ছে। পুরুষ যে-কোনো সময়ে, যে-কোনো কারণে, কোনো বয়সে  সংসার ভেঙে দিচ্ছে। কারণ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হবে, আসলে এই বিচ্ছেদে কার কী উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বিচারে পুরুষের কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে।

পারিবারিক সহিংসতা কি সব ধরনের পরিবারেই হয়? শিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত  সবখানেই সহিংসতা আছে? আপনাদের  পর্যবেক্ষণ কী?

সহিংসতা সব পর্যায়েই আছে। আমাদের কাছে যে অভিযোগগুলো আসে, তার মধ্যে শিক্ষিত, ধনী পরিবারেরও আছে। গরিব বা অল্পশিক্ষিতও আছে। নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো গ্রামাঞ্চলে একটু বেশি। কিন্তু সুসজ্জিত ঘরের মধ্যেও সহিংসতা হচ্ছে।

আপনার পরামর্শ কী? এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়?

আসলে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার যে ভারসাম্যহীনতা, সেইখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে নারীকে। নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে, সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিতে হবে, আইনে সমান অধিকার দিতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে লেখা থাকতে হবে। এইভাবে আসলে পরিবর্তন আনতে হবে। এভাবে চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া তো আর উপায় নাই।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ