পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ ও রোধের উপায় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
একটি সহিংস সম্পর্কের মধ্যে আমরা সারা জীবন থাকবো না। সেখানে যদি একজন নারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে তিনি ওই সম্পর্কের বাইরে গিয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করবেন, তিনি সেটা করতে পারেন। ছবি: Rafael Ben-Ari/Chameleons Eye/Newscom World/IMAGO
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ কী? কারা এর শিকার হন?
মালেকা বানু: পারিবারিক সহিংসতার প্রধানত শিকার হন নারী ও শিশুরা। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা। তারা যে-কোনো তুচ্ছ কারণে সহিংসতার শিকার। সব দায় যেন তাদের। এটা হলো না, ওটা হলো না, রান্না ঠিকমতো হলো না, ভাতটা ঠিকমতো নরম হলো না- এর সব দায় নারীর। যে-কোনো কারণে নারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এটা সমাজ অনুমোদিত। আবার যৌতুক আরেকটা কারণ। এখন আবার আরেকটা চিত্র আছে, তা হলো, এখন অল্প শিক্ষিত থেকে উচ্চ শিক্ষিত সব শ্রেণির নারীই সচেতন হচ্ছে। তারা প্রতিবাদ করছে। আবার সে আয় করতে শিখছে, কিন্তু সেই আয়ে তার আবার অধিকার নাই। সেটা সে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে। নারী যখন এসব নিয়ে কথা বলছে, তখন সে পরিবারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তার অধিকারবোধ তৈরি হচ্ছে। পছন্দ- অপছন্দ প্রকাশ করছে। এটা পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে পারছে না। সে নারীর স্বাধীন প্রকাশ নিতে পারছে না। নারীকে নির্যাতন করে দমন করতে চাইছে।
আমরা বলি পারিবারিক সহিংসতা। সেটা তো আসলে শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় নারীর প্রতি সহিংসতা। পরিবারে পুরুষের প্রতি কি সহিংসতা আমরা দেখি?
সেটা তেমন দেখি না। সেটা হলেও নারীর তুলনায় কিছুই না। একটা-দুইটা হয়তো হয়। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা নারী হিসাবে জন্ম নেয়ার কারণে হয়। এ কারণেই আমরা বলি পারিবারিক সহিংসতার প্রধান শিকার নারী। আর যেটা হয়, সেটা মানুষের প্রতি যে মানুষের সহিংসতা- সেটা।
কখনো কখনো দেখি, নারী পারিবারিক সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাবা-মায়ের কাছে চলে যায় বা অন্য কোনো আশ্রয়ে যায়। তখন এর প্রতিকারের উদ্যোগ না নিয়ে বুঝিয়ে আবার স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এমন কেন হয়?
পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেল কেন?
গত ৭ মাসে পারিবারিক সহিংসতায় ৩২২জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৩৩জন নারী। পারিবারিক সহিংসতা কি হঠাৎই বেড়েছে? কেন? এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষ৷
এই সরকার যখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে শাস্তি কমিয়ে দিচ্ছে, তখন অন্যায়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। যেমন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আগে শারীরিক সম্পর্ক করলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এই সরকার এটা কমিয়ে ৭ বছর কারাদণ্ড করে দিয়েছে। যৌতুকের ধারাগুলোও সংশোধন করা হয়েছে। এসব কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
নারীদের উপর নির্যাতনকে এই সরকার কখনো মব, কখনো ন্যায্য ক্ষোভ বলছে: নুজিয়া হাসিন রাশা, শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বলছে, অভ্যুত্থানের পর নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। অথচ এই অভ্যুত্থান নারীদের হাত ধরেই হয়েছে। টার্নিং পয়েন্টে নারীরা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এখন নারীরাই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। নারীদের উপর নির্যাতনকে এই সরকার কখনো মব, কখনো ন্যায্য ক্ষোভ বলছে। ফলে এরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এই সরকার নারীদের কর্তৃত্বের জায়গায় রাখেনি। বৈষম্য বিরোধী যে কন্ঠস্বর, সেটা দিনে দিনে নাই হয়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
এমন পদক্ষেপ দেখছি না যে কারণে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে, ফলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে: নূর খান লিটন, মানবাধিকার কর্মী
সমাজে সব ধরনের অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব স্তরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। দৃশ্যমান এমন কোনো পদক্ষেপ দেখছি না যে কারণে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে। ফলে পারিবারিক সহিংসতাসহ অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
মূলত বিচারহীনতার কারণে যে কোনো অপরাধ বাড়ে, তার প্রতিফলন আমরা দেখছি: তাসনিম আফরোজ ইমি, শিক্ষার্থী
এক বছরে বিচারব্যবস্থা বা আইন-শৃঙ্খলার যে অবস্থা, সেকারণে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতন বলেন, সেটা বেড়ে যাচ্ছে। এই সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। মূলত বিচারহীনতার কারণে যে কোনো অপরাধ বাড়ে, তার প্রতিফলন আমরা দেখছি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকেন নারীরা। মব, বিচারহীনতা, আইনশৃঙ্খলা সবকিছুই একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। বর্তমান সরকারের সক্ষমতা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে।
ছবি: Samir/DW
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা কমতে থাকবে: জামিউল আহসান সিপু, সাংবাদিক
নারীর প্রতি পুরুষের, পুরুষের প্রতি নারীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেই পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা অপেক্ষাকৃতভাবে কমতে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
ছবি: Samir/DW
নারীরা বর্তমানে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন: মামসুরা আলম, ছাত্রদল নেত্রী
নারীদের প্রতি সহিংসতা বা পারিবারিক সহিংসতা অন্য যে কোনো ধরনের অপরাধের থেকে আলাদা। নারীরা বর্তমানে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এই কারণে যেমন পরিবারে, তেমনি বাইরেও মবের শিকার হচ্ছেন, হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। কয়েকদিন আগেও দেখলাম একজন নারীর পোশাক ধরে কয়েকজন পুরুষ টানাটানি করছে, সেটা আবার ভিডিও করা হচ্ছে। আশপাশে শত শত মানুষ, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে না। এসব কারণেও নারীরা আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ছে।
ছবি: Samir/DW
পথে-ঘাটে নারীকে পেটাচ্ছে, সরকার যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে: শরীফা বুলবুল, সাংবাদিক
মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের মধ্য দিয়ে যে নারীত্বের অবমাননা হয়েছে, এখনও যেন সেই অবস্থা চলছে। এটা না থামার কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা। এ যাবৎ কোনো নারী নির্যাতনের সঠিক বিচার আমরা পাইনি। এই সরকারের আমলে বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে নারীরা। পথে-ঘাটে নারীকে পেটাচ্ছে, সরকার যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে। আমরা এখন রাস্তায় বের হতেই ভয় পাচ্ছি।
ছবি: Samir/DW
আর্থিক অচ্ছলতা এবং অনেক বেশি মোবাইলে আসক্তির কারণে অনেক পরিবারে অশান্তি হচ্ছে: মো. হানিফ, গার্মেন্টস কর্মী
আর্থিক অচ্ছলতার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা নেই, আর টাকা না থাকার কারণে পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। এর সঙ্গে আছে মোবাইল ফোন। অনেক বেশি মোবাইলে আসক্তির কারণেও অনেক পরিবারে অশান্তি হচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
কোনো ধরনের শাস্তির নজির না থাকার কারণে নারী নির্যাতন এত বেড়ে গেছে: তানজিলা তাহসীন, সাংবাদিক
শুধু তো নারী নয়, শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় দায় প্রশাসনের। কোনো ঘটনাতেই প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কোনো ধরনের শাস্তির নজির না থাকার কারণে নারী নির্যাতন এত বেড়ে গেছে। নারীর পোশাক নিয়ে কটুক্তির কারণে যাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তাকে আবার জেল থেকে বের হওয়ার পর ফুলের মালা দেওয়া হচ্ছে। লঞ্চ ঘাটে দুই নারীকে বেল্ট দিয়ে পেটানো হচ্ছে। অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নিলো না।
ছবি: Samir/DW
এই সরকারের সময় আইনের শাসন বলতে কিছু নেই: অনিকা বিনতে আশরাফ, শিক্ষার্থী
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। নারীর উপর প্রভাব বিস্তার করার প্রবণতা থেকেও নির্যাতন হচ্ছে। এই সরকারের সময় আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। এখানে যে কেউ চাইলেই মব সৃষ্টি করতে পারছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই হচ্ছে না। এইসব কারণে নির্যাতনকারীরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Samir/DW
10 ছবি1 | 10
আগেই তো বললাম যে,নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজ অনুমোদন করে। ফলে, তার পাশে কেউ দাঁড়ায় না। বোনের পাশে ভাই দাঁড়াচ্ছে না, বোনও দাঁড়াচ্ছে না, বাবা-মাও দাঁড়ায় না, পরিবারও দাঁড়ায়না। এটা একটা চক্রের মতো। মৃত্যু অবধারিত জানার পরও তাকে আবারো সেইখানেই পাঠানো হয়। মৃত্যু ছাড়া যেন নারীর মুক্তি নাই।
পরিবারে নারী তো নারীর সহিংসতারও শিকার হন। শাশুড়ি, জা বা ননদের হাতেও তো নির্যাতনের শিকার হন। এটা আপনি ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে?
এটা হলো পিতৃতান্ত্রিক দুষ্টিভঙ্গি, যা সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়ই বহন করে। সমাজে নারীর অবস্থা হলো, নারী কোনো কথা বলতে পারবে না, সে কোনো কিছুতেই ‘না' বলতে পারবে না। নারীর নিজের কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারবে না। সব তাকে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হবে। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। এটা নারী-পুরুষ সবার মধ্যে আছে।
এ ব্যাপারে আইন কি যথেষ্ট আছে? নাকি আরো কঠোর আইন দরকার?
আমরা যত কঠোর আইন করবো, তত শাস্তির হার কমবে। পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কিন্তু একটা আইন আছে (পারিবারিক সহিংসতা(প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন,২০১০)। এই আইনটি কিন্তু একটা প্রোগ্রেসিভ আইন। এর মূল লক্ষ্য হলো, পারিবারিক সুরক্ষা। পরিবারের মধ্য থেকেই সুরক্ষা দেয়া। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। এই আইনটি বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে না। এর বাইরে নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোাধী আইন আছে, তার মাধ্যমেও বিচার করা সম্ভব। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতা রোধে যে আইন, সেটা বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার
18:51
This browser does not support the video element.
পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে স্বামীর হাতেই স্ত্রী বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন,স্বামীর হাতেই স্ত্রী বেশি হত্যার শিকার হচ্ছেন। এটা কেন হচ্ছে? এটা তো একটা ভালোবাসার বন্ধনের জায়গা।
এখানে সম্পর্কের যে সমীরণ, আমাদের পরিবার ব্যবস্থায় সেটা তো ক্ষমতার সম্পর্ক। আমি তোমার চেয়ে ঊর্ধ্বতন। পুরুষের আধিপত্য। সবকিছু আমার মতো করে হতে হবে। যদি না হয়, তাহলেই নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাই স্বামীর হাতেই স্ত্রী বেশি নির্যাতনের শিকার হন। স্বামীও তো পিতৃতান্ত্রিকতা দ্বারাই পরিচালিত হন। সম্পর্কটা সেভাবেই নির্ধারিত হয়।
তাহলে নারীর আর্থিক সক্ষমতা কি তার মুক্তির জন্য কাজ করবে না? তার স্বাধীন চিন্তা কি তাকে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে না?
আসলে পুরুষের যে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, সেটাকে এখনো চ্যালেঞ্জ করা যাচ্ছে না। আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারছি না। আর রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজের কারণে পারা যাচ্ছে না। বিভিন্ন আইন আছে, যা পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে। পারিবারিক আইনে তো নারীকে পুরুষের অর্ধেক করে রাখা হয়েছে। আমাদের সামাজিক রীতি-নীতি, ব্যবস্থা, আইন সবকিছু দিয়েই তো নারীকে ছোট করে রাখা হয়েছে। এই জায়গাগুলো যদি চ্যালেঞ্জ না করা যায়, তাহলে তো নারীরা এগোতে পারবে না। নির্যাতনের শিকার হবে।
মালেকা বানু, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক৷ছবি: DW/Sazzad Hossain
শিশুরাও তো পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে বেশি।
শিশুরা তো সবচেয়ে ভালনারেবল। সে দুর্বল। সে প্রতিরোধ করতে পারে না। প্রতিবাদ করতে পারে না। তার প্রতি অপরাধ করে সহজেই পার পাওয়া যায়। সে অভিযোগও করতে পারে না। সে ভয় পায়। পরিবার ও পরিবারের বাইরে সে সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল। ফলে তাদের প্রতি সহিংসতা বেশি হয়। সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকেই এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। আমাদের শিক্ষা কারিকুলামেও এটা নিয়ে কাজ করা যায়।
নারী যদি পরিবারে সহিংসতার শিকার হয়, তখন সে যদি তার সুরক্ষার জন্য আলাদা থাকতে চায়, পরিবার থেকে বের হতে চায়। তা কি এই সমাজ মেনে নেয়?
এই সমাজে নারীদের সিঙ্গেল থাকা খুবই কঠিন। অনেক শিক্ষিত নারী পরিবারে সহিংসতার শিকারহয়েও বিবাহ বিচ্ছেদে যেতে চায় না। আলাদা থাকতে চায় না। তার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ এখানে একটা বাধা। সমাজ একটা বাধা। একলা মেয়ে হিসবে বসবাস না করতে পারা একটা বাধা। আরো অনেক রকম বাধা আছে। একা বাসাভাড়া নিয়ে থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক বাধা তো আছেই। আবার যারা অর্থনৈতিকভাবে ন্বাবলম্বী, তারাও নানা কারণে একটা সহিংস সম্পর্কের মধ্যে জীবন কাটায়। তার একটা ট্রমাটিক অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়।
বাড়িতেই সবচেয়ে কম নিরাপদ নারীরা
জাতিসংঘের একটি গবেষণা জানিয়েছে, ২০১৭ সালে অর্ধেকেরও বেশি নারী খুন হন পরিবারের কোনো সদস্যের হাতেই৷ বর্তমানে নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক নিজেদের বাড়িই৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/S. Moraes
পরিবারেই বিপদ...
জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনওডিসি’র একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছে৷ এর ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার হত্যাই সংগঠিত হয়েছে মৃত নারীদের পরিবারের কোনো সদস্যের দ্বারা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/N. Pisarenko
ঘরের শত্রু...
২০১৭ সালে মোট ৩০ হাজার নারী খুন হয়েছেন তাদের সঙ্গী বা ভালোবাসার মানুষের হাতে৷ জাতিসংঘের তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রতি ঘন্টায় ছয়জন নারী নিজের পরিচিত মানুষের হাতে খুন হন৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
ক্ষমতার অসাম্য
শুধু নারী মৃত্যুর হার বা কারণই নয়, এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য৷ পরিবারের ভেতরে নারী সব সময় পুরুষের তুলনায় কম ক্ষমতার অধিকারী হবার কারণেই বেশি অত্যাচারিত হয়৷ এর কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে লিঙ্গবৈষম্যকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. R. Caivano
সবচেয়ে বেশি যেখানে...
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয় অ্যামেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলিতে৷ পরিবারের সদস্যদের হাতে নারীদের নিহত হবার সংখ্যাও এই দুই মহাদেশে সর্বোচ্চ৷
ছবি: Imago/Agencia EFEE. Guzman
সবচেয়ে কম যেখানে...
প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, ‘‘নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রুখতে কঠোর আইন ও নীতি থাকা সত্ত্বেও তা পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না৷’’ তবুও ইউরোপের দেশগুলিতে তুলনামূলকভাবে এই প্রবণতা সবচেয়ে কম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NurPhoto/A. Pitton
সমস্যার মোকাবিলা
নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়েছে এই প্রতিবেদন৷ পাশাপাশি, নারীর সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দ্রুত বিচার করতেও পরামর্শ দেয় এই রিপোর্ট৷
ছবি: UNFPA Nicaragua/Joaquín Zuñiga
পুরুষদের ভূমিকা
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে পরামর্শ হিসাবে বলা হয়েছে, উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক নীতি-বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কথা৷ এই সব ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলাফল পেতে হলে পুরুষদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে প্রতিবেদনটি জানায়৷
ছবি: Imago/ZUMA Press
7 ছবি1 | 7
দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। এর জন্য আবার কেউ কেউ নারীকে বেশি দায়ী করার চেষ্টা করেন। আসলে পরিস্থিতি কী?
দায়ী করার বিষয় না এটা। আমরা যারা নারী আন্দোলন করি, তারা কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদকে সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখি না। একটি সহিংস সম্পর্কের মধ্যে আমরা সারা জীবন থাকবো না। সেখানে যদি একজন নারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে তিনি ওই সম্পর্কের বাইরে গিয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করবেন, তিনি সেটা করতে পারেন। সেটা আজকাল কেউ কেউ করছেন। করছেন না যে, তা নয়। কিন্তু ছেলেরা কী করছে ? কথায় কথায় তালাক দিচ্ছে, ২৪-২৫ বছরের সংসার ভেঙে দিচ্ছে। পুরুষের যে সংসার ভেঙে দেয়ার প্রবণতা, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার কারণ ভিন্ন। কিন্তু নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদে বাধ্য হচ্ছে। পুরুষ যে-কোনো সময়ে, যে-কোনো কারণে, কোনো বয়সে সংসার ভেঙে দিচ্ছে। কারণ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হবে, আসলে এই বিচ্ছেদে কার কী উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বিচারে পুরুষের কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে।
পারিবারিক সহিংসতা কি সব ধরনের পরিবারেই হয়? শিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সবখানেই সহিংসতা আছে? আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?
সহিংসতা সব পর্যায়েই আছে। আমাদের কাছে যে অভিযোগগুলো আসে, তার মধ্যে শিক্ষিত, ধনী পরিবারেরও আছে। গরিব বা অল্পশিক্ষিতও আছে। নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো গ্রামাঞ্চলে একটু বেশি। কিন্তু সুসজ্জিত ঘরের মধ্যেও সহিংসতা হচ্ছে।
আপনার পরামর্শ কী? এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়?
আসলে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার যে ভারসাম্যহীনতা, সেইখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে নারীকে। নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে, সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিতে হবে, আইনে সমান অধিকার দিতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে লেখা থাকতে হবে। এইভাবে আসলে পরিবর্তন আনতে হবে। এভাবে চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া তো আর উপায় নাই।