২০১০ সালে ব্লাসফেমি আইনে দেয়া মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে গতবছর থেকে ক্যানাডায় বাস করছেন পাকিস্তানের খ্রিষ্টান নারী আসিয়া বিবি৷ বুধবার তাঁকে নিয়ে ফরাসি ভাষায় একটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ফ্রান্সের সাংবাদিক টোলেট ইসাবেল-আনা ‘অবশেষে মুক্ত' বইটির সহ-লেখক৷ আসিয়া বিবির মুক্তির জন্য তিনি আন্দোলন করেছেন৷ ইসাবেল-আনাই একমাত্র সাংবাদিক যিনি ক্যানাডায় অজ্ঞাত স্থানে বসবাস করা আসিয়া বিবির সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন৷
গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে কারাগারে বন্দি জীবন ও বর্তমানে ক্যানাডায় কেমন আছেন, তা ইসাবেল-আনাকে জানিয়েছেন আসিয়া বিবি৷ তিনি ঐ সাংবাদিককে বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে গণমাধ্যম থেকে আপনি আমার সম্পর্কে জানেন৷ কিন্তু কারাগারে আমার প্রতিদিনের জীবন ও এখনকার নতুন জীবন সম্পর্কে আপনার কোনো ধারনা নেই৷''
কারাগারে তাঁকে শিকলবন্দি করে রাখা হতো বলে জানান আসিয়া বিবি৷ এছাড়া অন্য বন্দিরা তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতো বলেও জানান তিনি৷
আসিয়া বিবি বলেন, ‘‘কারাগারে আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল চোখের পানি৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমার গলায়... লোহার শিকল ছিল, যেটা নিরাপত্তা প্রহরীরা আংটা দিয়ে শক্ত করে দিতে পারতেন৷''
আসিয়া বিবির সঙ্গে থাকা অনেক নারী বন্দি ‘ফাঁসি! ফাঁসি!' বলে চিৎকার করতেন বলেও জানান তিনি৷
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
ছবি: picture alliance/dpa
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
ছবি: Noman Michael
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
ছবি: AP
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
ছবি: AP
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
ছবি: Reuters/F. Mahmood
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ছবি: APMA
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ছবি: RIZWAN TABASSUM/AFP/Getty Images
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. K. Bangash
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷
ক্যানাডায় নিরাপদ ও নিশ্চিত জীবন থাকলেও ভবিষ্যতে কখনও জন্মভূমিতে ফেরার সম্ভাবনা না থাকার বিষয়টি তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাকে যখন বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বিদায় না বলেই দেশ ছাড়তে হয়েছিল তখন আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল৷''
‘‘পাকিস্তান আমার দেশ৷ আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, কিন্তু এখন আমি চিরদিনের জন্য নির্বাসনে,'' বলেন তিনি৷
আগামী সেপ্টেম্বরে বইটির ইংরেজি অনুবাদ বের হওয়ার কথা৷
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের জুন মাসে লাহোরের কাছে শেখুপুরা এলাকায় ফল পাড়তে গিয়ে অন্য নারীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে চার সন্তানের জননী আসিয়া বিবি মহানবীকে (সাঃ) নিয়ে কটূক্তি করেন বলে অভিযোগ ওঠে৷ ওই অভিযোগে ব্লাসফেমি আইনের আওতায় ২০১০ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ এরপর দীর্ঘ আট বছর কারাভোগ করতে হয় তাঁকে৷
এরপর ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট আসিয়া বিবিকে মুক্তির রায় দেন৷ এরপর প্রায় ছয় মাস তাঁকে করাচিতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রাখা হয়েছিল, কারণ কট্টরপন্থি ইসলামিস্টরা তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল৷