আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ততো এখন কোর্টের কাছে: খাদিজাতুল কুবরা
রাহাত মিনহাজ ঢাকা
২১ নভেম্বর ২০২৩
বিনা বিচারে ১৫ মাস কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়ে ২০ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা৷
বিজ্ঞাপন
২০২৩ সালের আগস্টে বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হওয়ার পর থেকেই দেশে-বিদেশে খাদিজার মুক্তির সোচ্চার দাবি ছিল৷
তার মুক্তি চেয়ে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একাধিকবার আহ্বান জানিছে৷ পথে নেমেছিল তার সহপাঠী থেকে শুরু করে দেশের অগণিত মানুষ৷ কারাগারে কেমন ছিলেন খাদিজা, সামনে দিনগুলোতে তিনি কি করতে চান এ বিষয়ে ডয়চে ভেলে বাংলার সাথে কথা বলেছেন খাদিজাতুল কুবরা৷
ডয়চে ভেলে: খাদিজা, আপনি কেমন আছেন?
খাদিজাতুল কুবরা: জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ৷ সুস্থ আছি কিন্তু শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল এবং অনেক ধরনের সমস্যা আছে৷ সেটার জন্য ডাক্তার দেখাতে হবে৷ আমার ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন আছে৷ আমিতো আগে থেকেই অসুস্থ ছিলাম৷ কারাগারেতো আর ওইরকমভাবে কোনো ট্রিটমেন্ট আমি করাতে পারিনি৷ কিডনিতে স্টোন ছিল৷ এখন কি পরিস্থিতি, সেটাও আমি জানি না৷
পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
আমি যখন কারাগারে, তখন কোর্ট পারমিশন দেওয়ায় আমি কিছু পড়ালেখা করেছিলাম৷ তবে আমি আসলে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না যে আমি হয়তো এই পরীক্ষাটা দিতে পারব৷ কিন্তু যেতে পেরেছি, পরীক্ষা দিয়েছি৷ মোটামুটি ভালো হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ৷ আমার পরের পরীক্ষা ২৫ নভেম্বর৷
আপনি কোন ইয়ারের পরীক্ষা দিলেন?
এটা সেকেন্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার, সব মিলিয়ে চতুর্থ সেমিস্টার পরীক্ষা৷
আপনি কি আগের পরীক্ষাগুলো দিতে পেরেছিলেন?
জ্বি জ্বি৷ আমি থার্ড সেমিস্টার (তৃতীয় সেমিস্টার) শেষ করে দেড়-দুই মাস ক্লাস করে তারপর গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাই৷
আপনি যখন কারাগারে ছিলেন, এটাতো খুবই কঠিন সময়৷ আপনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী৷ একটা উচ্ছ্বল সময় আপনি পার করছিলেন ক্যাম্পাসে৷ তারপরে আপনাকে অন্তরীণ থাকতে হলো ১৫ মাস৷ আপনার এই সময় নিয়ে, কারাগারের জীবন নিয়ে আপনি আমাদের কিছু বলতে পারেন?
আমি কারাগার জীবনটা আমার মাইন্ড থেকে টোটালি বের করে দিয়েছি৷ এই জিনিসটা ভাবলেই কেমন জানি লাগে৷ আমি ভাবতে চাই, আমার লাইফে আসলে কারাগারের কোনো অধ্যায় ছিল না৷ আমি ওইটা নিয়ে আসলে কিচ্ছু মনেও করতে চাচ্ছি না৷ আমি দুঃখিত, এই বিষয়টি আমি চিন্তাও করতে চাই না৷
ছোট্ট করে জানতে চাই, আপনার পড়াশোনার কেমন ক্ষতি হলো এই ১৫ মাসে বা আপনি আপনার শিক্ষা জীবন নিয়ে কি ভাবছেন?
১৫ মাসের মধ্যে একটা বছর চলে গেছে৷ এখনতো এই সেমিস্টার ফাইনাল দিচ্ছি৷ এখন ৩০ তারিখে আদালতের রায়ের পর সিদ্ধান্ত নিব, জীবনে কি করব৷ আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ততো এখন কোর্টের কাছে৷
আপনি বাড়িতে ফিরে কি করলেন আপনার মা-বাবা, পরিবারের অন্য সদস্য সবাই নিশ্চিয় আনন্দিত ছিলেন?
সবাই আসলো৷ সবাই অনেক খুশি৷ সবাই আসতেছে, মানে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি৷ সবাই কথা বলতেছে৷ মানে অন্যরকম৷ সবাই আসতেছে, পাড়া-প্রতিবেশিরা৷ মা অনেক খুশি৷ মায়ের টেনশন শেষ৷
এই পরিবারের যে জার্নি কঠিন সময় পার করার, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল কোন সময়টা, আপনি একটু আমাদের শেয়ার করতে পারেন৷ আমি পরিবারের কথা বলছি?
আমিতো আসলে ছিলাম না৷ এটা তারাই ভালো করে বলতে পারবে কখন৷ আমি যতটা জানি, তারা সব সময় খারাপই ছিলেন৷
আপনি যখন কারাগারে ছিলেন, তখন কি আপনি জানতে পারতেন যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, অনেকেই আপনার জন্য প্রতিবাদ করেছে৷ অনেক অজানা মানুষ আপনার জন্য কলম ধরেছে৷ সমবেদনা জানিয়েছে৷ আপনার জন্য লিখেছে৷ এই বিষয়টা কারগার থেকে আপনি জানতে পারতেন, বা কোনো আইনজীবী আপনাকে জানাতো?
আসলে এই বিষয়গুলো হয়তো আপু কখনও বলতো৷ এইগুলো আপুমনি সবকিছু হ্যান্ডেল করতো৷
আপনি আপনার শিক্ষা জীবন, ভবিষ্যত নিয়ে কিছু একটা বলতে পারেন, আপনি কি চিন্তা করছেন?
আমার মাথায় এখন একটা টেনশন ঘুরতেছে যে, শেষ পর্যন্ত আমার বিচার কি হবে৷
দেড় বছর পর আপনি আবার মুক্ত জীবনে৷ এই অনুভূতিটা কেমন, আপনি কেমন বোধ করছেন?
আমার এখনও মনে হচ্ছে আমি ঘোরের মধ্যে আছি৷ আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমি বাইরে৷
খাদিজা, আপনি কি কিছু কিছু বলতে চান৷ আমি প্রশ্ন করছি না৷
এই ১৫ মাসে আমার একটা রিয়েলাইজেশনই ছিল, লাইফে ফ্যামিলি অনেক ইমপর্ট্যান্ট৷
গত বছরের মে মাসের ছবিঘরটি দেখুন...
ডিজিটাল মামলা: কারা, কাদের বিরুদ্ধে, কী অভিযোগে করেন
সিজিএস ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। বিশ্লেষণ বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ সিজিএস ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মামলার তথ্য নিয়ে গবেষণা
সিজিএস বিশ্লেষণ বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। আসামি হওয়া রাজনীতিকের সংখ্যা ৪০৩ জন (৩১ শতাংশ)। এর পরেই আছেন সাংবাদিক (৩৫৫ জন)। তারপর আছেন শিক্ষার্থী (১১৮ জন)। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর ও সিজিএসের উপদেষ্টা আলী রীয়াজ৷
ছবি: Privat
বাদী আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার মধ্যে ৩৫৩টি মামলার তথ্য-উপাত্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করেছে সংগঠনটি। সেসব মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫৫টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ৩০টির বাদী আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী।
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করায় ৯৮ মামলা
গত বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করায় যেসব মামলা হয়েছে তার ১৩টি করেছে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা, বাকি ৮৫টি ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ৫০ জন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মী৷ ছাত্রলীগের ২০ জন ও আওয়ামী লীগের ১৯ জন মামলা করেছেন৷ এসব মামলায় ৫৮ জন অভিযুক্তকে আটক করার তথ্য পেয়েছে সিজিএস৷
নিরাপত্তা সংস্থা করেছে তিনটি মামলা৷ মন্ত্রী বা তার পরিবারের সদস্যরা করেছেন চারটি৷ বাকি ৪৪টি বিভিন্ন ব্যক্তির দায়ের করা মামলা৷ এর মধ্যে ২৮ জন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মী৷ এসব মামলায় ২৩ জনকে আটক করা হয়েছে৷ ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান ও ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলসহ (ছবি) ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেছিলেন৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
রাজনীতিবিদদের অবমাননায় কমপক্ষে ৭৫ মামলা
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের অবমাননা করায় মামলা হয়েছে ৭৪টি৷ অন্যজন জাতীয় পার্টির রাজনীতিবিদ৷ এসব মামলায় ৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
মামলাকারীদের পরিচয়
৮৯০টি মামলার মধ্যে ৫০৮টি মামলা করা ব্যক্তির পরিচয় জেনেছে সিজিএস৷ এর মধ্যে ১১১টি করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷ ৪৩টি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী আছেন ২০৬ জন৷ এর মধ্যে ১৬৭ জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত৷ দুইজন জড়িত বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে৷ ছবিতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের করা মামলায় আটক সাংবাদিক তানভীর হাসান তানুকে দেখা যাচ্ছে৷ পরে তিনি জামিন পান৷
ছবি: Jeebon Haq
জনপ্রতিনিধিদের করা মামলা
মামলাকারীদের মধ্যে ৩৭ জন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি৷ এর মধ্যে আছেন সাংসদ (পাঁচ জন), মেয়র (৬), ওয়ার্ড কাউন্সিলর (১১), ইউপি চেয়ারম্যান (৮) ও উপজেলা চেয়ারম্যান (৪)৷ ২০২১ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক ডিজিটাল আইনে সাংবাদিক আবু তৈয়ব মুন্সীর (ছবি) বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন৷
ছবি: BD News
ফেসবুকে পোস্ট ও মন্তব্যের কারণে মামলা
উল্লেখিত সময়ে ফেসবুকে পোস্ট ও মন্তব্যের কারণে ১,১৭৫ জনের বিরুদ্ধে ৫৬৮টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে ৫১টি মামলা হয়রানির, ২৯টি আর্থিক প্রতারণা ও ৮৫টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মামলা৷ ২০২০ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণসহ নানা অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল৷ ঐ সময় ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর পরিচয় দিয়ে লেখক মুশতাক আহমেদকে আটক করা হয়৷ পরে তিনি কারাগারে মারা যান৷