1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

একুশের যে গান বিস্মরণের অতীত

শিশির রায়
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রতিটি জাতিরই এমন এক-একটি গান থাকে যা তাদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড'৷ মানুষ সে গানের সুর ও বাণীর মধ্যে নিজেদের জীবন ও সময়কে দেখতে পায়, নিজেদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টি-যাপনে সে গানকে মিশিয়ে নেয়৷

আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা গানটি ভাষা শহিদদের নিয়ে বাঙালির আবেগ-অনুভূতি-বেদনার উন্মন প্রকাশের নান্দীমুখ
আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা গানটি ভাষা শহিদদের নিয়ে বাঙালির আবেগ-অনুভূতি-বেদনার উন্মন প্রকাশের নান্দীমুখছবি: Mortuza Rashed

দক্ষিণ কলকাতার এক থিয়েটারহলে গিয়েছি নাটক দেখবো বলে৷ ফেব্রুয়ারির সন্ধে নামছে, রবিবারের কলকাতা চায়ে চুমুক দিচ্ছে ছুটির দিন ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়ার মনখারাপে৷ হলের সামনে জটলা, অনেকগুলি মানুষ ঘিরে আছেন তিন-চারটি মানুষকে৷ কাছে এগোতে ভেসে আসে উদাত্ত গলা, গানের সুর—

শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে

অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে

রক্তে আগুনে প্রতিরোধ গড়ে

নয়া বাংলার নয়া সকাল...

কিংবা

জয় বাংলা বাংলার জয়

হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়

কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে

নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়...

নাটকের দলগুলি এসেছে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায়৷ তাদের নিয়েই নাট্যোৎসব, দিনভর পর পর বাংলাদেশের নাট্যপ্রযোজনার সাক্ষী থাকছে কলকাতা৷ সেখানেই, দু'টি নাটকের মাঝে চলছে গান৷ ফুটপাতেই, খালি ও খোলা গলায়, ছোট ঢোলকের মতো একটি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গতে৷ গাইছেন ওরা জনচারেক, ওদের ঘিরে হাতে হাতে তালি দিচ্ছেন দর্শকেরা৷ গলা মেলাচ্ছেন পরিচিত চরণগুলি ফিরে ফিরে আসার সময়৷ এই সবই আমার চেনা গান৷ চেনা বললে ভুল হবে, চিরচেনা৷ ‘পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে', ‘জয় বাংলা বাংলার জয়', ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়', ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি', ‘সালাম সালাম হাজার সালাম'... আরো কত...৷ ভাষার গান, মুক্তির গানগুলি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সমার্থক৷ স্রেফ গান নয় এরা, একটি জাতিকে এক লক্ষ্যে চালিত করার সামাজিক-রাজনৈতিক ক্রিয়ায় অতি জরুরি এক সাংস্কৃতিক অনুঘটক৷ আমিও মনে মনে গাইছিলাম, এবং গাইতে চাইছিলাম আরও একটি গান, একাত্তরের চেয়েও দু'দশক বয়স বেশি তার৷ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...' একুশে ফেব্রুয়ারি সমাগত বলেই বোধহয় চাইছিলাম কলকাতা শহরে, এই ফাল্গুনী বাতাসে ছড়িয়ে যাক এ গানের সুর ও বাণী৷

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে পেরিয়েছে সাতটি দশক৷ এই সময়কালে বাঙালির ভাষা, জাতি ও রাষ্ট্রের দাবি স্বীকৃত ও রক্ষিত হয়েছে নিবিড় নিদারুণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে৷ স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বকে দিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস', পৃথিবীর যে প্রান্তে যে ভূমে যে মানুষটি আছেন, তার মাতৃভাষা বলার অধিকারকে নিশ্চিত করেছে যে দিবসের স্বীকৃতি৷ বিশ্বের প্রতিটি বাঙালির জন্য এ এক গর্বের বিষয়— তার মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা পৃথিবীকে এই অধিকারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে বলে৷ পরাধীনতার শেকল ছেঁড়ার লড়াই করেছে বহু দেশ বহু জাতি, কিন্তু মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে মানুষের আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা৷ বাঙালি জাতি সেই বিশিষ্টতার অধিকারী৷

একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মুখ কে বা কারা? সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা৷ তাঁরা কেউ ‘বিশিষ্ট' নন, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তা-ও বলা যাবে না, ছাত্রসমাজের এক বিপুল অংশের সঙ্গে যে সাধারণ মানুষেরা ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিলেন ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ও তার পরে পরেও, তারা সেই জনস্রোতের কয়েকটি মুখ— শাসকের পুলিশের নির্বিচার গুলি যাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল৷ তারা তাই প্রণম্য ‘ভাষা শহিদ'৷ তাদের ছবিগুলি দেখি... সহজ সাধারণ মুখ, যেন পাশের বাড়ির চেনা ছেলেটি৷ ইতিহাস তাদের বিস্মৃত হবে না, তবে এ এক অমোঘ সত্য যে প্রজন্মান্তরে একটি আন্দোলনের গুরুত্বে অনেক সময় ভাটা পড়ে৷ পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের প্রজন্ম আর এই একুশ শতকের প্রজন্ম তো এক নয়, বর্তমান কাল জন্মাবধি দেখেছে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি তার অধিকৃত, নিজের, আপন৷ না চাইতেই যা পাওয়া হয়ে যায়, অনেক সময় তাকে স্বতঃসিদ্ধের মতো ধরে নেয় মানুষ, বুঝতে পারে না কোন মূল্যে এক দিন এই ভাষার দাবিকে রক্ষা করতে হয়েছিল৷ তবে আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানগুলি পুরোনো হয় না কখনো: একটি গান, বা কবিতা, একটি সাহিত্য বা চিত্রকৃতি হয়ে দাঁড়ায় আন্দোলনের পরিচায়ক, প্রতিশব্দ৷ সময়ের পলি পড়ে যদি বা পুরোনো হয় কিছু মুখ, গান-কবিতা-শিল্প জেগে থাকে কালজয়ী হয়ে৷ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটি তেমনই এক জ্বলন্ত প্রমাণ— যেন ভাষা আন্দোলনের অদৃশ্য পতাকা এক৷

ভাষা শহিদদের স্মরণে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে ভাস্কর্যছবি: privat

এই গানকে যত চিনি, তার রূপকারদের কি জানি তত নিবিড় করে? ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' লিখেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, গত বছর মে মাসে চিরবিদায়ে গেলেন তিনি৷ সত্তরের দশক থেকেই লন্ডনপ্রবাসী মানুষটি, কিন্তু আজীবন আশ্লিষ্ট বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালির সঙ্গেই৷ ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র, বয়স কুড়িও পেরোয়নি৷ একুশে ফেব্রুয়ারিকে দেখেছেন চোখের সামনে৷ এমন নয় যে কেবল ওই একটা দিনেই যত আন্দোলন প্রতিবাদ প্রতিরোধ, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে তারও বছর পাঁচেক আগে থেকেই৷ ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারি মাসে তা তুঙ্গমুহূর্তে ওঠে, একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি নির্ধারিত হয় সর্বাত্মক প্রতিরোধের দিন৷ পুলিশের গুলি চলেছিল সে দিন নির্বিচারে, এবং তার পরেও— লাঠিচার্জ কাঁদানে গ্যাস ধরপাকড় নির্যাতন এসবের কথা নাহয় অকথিতই থাকলো৷ তরুণ আবদুল গাফফার চৌধুরী নিজেও আহত হয়েছিলেন৷ সেই উত্তাল সময়েরই ফসল তার কলম থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘ কবিতা ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?'' গোটা কবিতাটাই পরে সুরারোপিত হয়ে গান হয়ে ওঠে, কিন্তু প্রথম স্তবকটি হয়ে ওঠে বিশেষ বিখ্যাত, ভাষা শহিদদের নিয়ে বাঙালির আবেগ-অনুভূতি-বেদনার উন্মন প্রকাশের নান্দীমুখ৷

এই গানের ‘হয়ে ওঠা'র এই ইতিহাস আজ বহুচর্চিত৷ তা ধরা আছে স্বয়ং গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্মৃতিকথনে, সাক্ষাৎকারে, লেখায় এখানে-ওখানে, সেই সময়ের আরও বহু বিশিষ্টজনের বয়ানেও— একালের প্রযুক্তিবহুল জীবনে এই পূর্বাপর ইতিহাস সহজলভ্যও৷ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো'-য় প্রথম সুর দিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ৷ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের অভিযাত্রাকে যদি বাংলা গানের সুরযাত্রার নিরিখে দেখা যায়, এই মানুষটি হবেন তার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ যাত্রিক৷ তবু জেনে রাখা ভালো, আমার ভাইয়ের... গানের তিনি প্রথম সুরকার হলেও তার দেওয়া সুরটি বেশি পরিচিত বা বিখ্যাত হলো না, বিখ্যাত হলো আরেক সুরশিল্পী আলতাফ মাহমুদের করা সুর— যে সুরে আবিশ্ব বাঙালি আজ এ গান গেয়ে থাকেন৷ পঞ্চাশের দশকের সুর বাঙালি কণ্ঠে তুলে নিলো, জহীর রায়হান ১৯৬৯ সালে তার ‘জীবন থেকে নেওয়া' ছবিতেও ব্যবহার করলেন এই গান ও সুর, সেই ছবিতেই ছিল ‘আমার সোনার বাংলা' গান, অচিরেই যা হয়ে উঠবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত৷ আমাদের দুর্ভাগ্য— স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আলতাফ মাহমুদকে পেলাম না আর— মুক্তিযোদ্ধাদের কাছের মানুষ, সংগ্রামী শিল্পী আলতাফ মাহমুদকে একাত্তরের আগস্টে তার ঢাকার বাড়ি থেকে বন্দি করে নিয়ে যায় পাক সেনা, আর খোঁজ পাওয়া যায়নি তার৷

আমার জানা ছিল না আলতাফ মাহমুদকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট রয়েছে৷ আগ্রহীজন সেটি দেখতে পারেন, ছিমছাম ওয়েবসাইটটিতে তার জীবন, মনন, সাহিত্যকৃতি, তার সুর ও গানের সন্ধান, ছবি— অনেক কিছুই আছে৷ এখানেই আছে ‘একুশের গানের সূচনা' শিরোনামে একটি বিভাগে তার সন্তান ও উত্তরসূরি শাওন মাহমুদ লিখেছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো'র সুরারোপ নিয়ে: "কেউ কেউ বলেন '৫৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আলতাফ মাহমুদ নতুন সুরারোপে মনোনিবেশ করেন এবং ১৯৫৪ সালেই... তার দেয়া নতুন সুরে নিজেই গানটি পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে৷... প্রথম দিকে আলতাফ মাহমুদ নিজেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পুরো কবিতাটি গেয়ে পরিবেশন করেছেন৷ এর পর দু'তিনবার নিজের সুরকে সামান্য পরিবর্তন করেন৷ যতদূর জানা যায়, তৃতীয় সুর করার পর বাংলাদেশের গণসংগীতের দুই দিকপাল শেখ লুৎফর রহমান এবং আব্দুল লতিফের কাছে গিয়েছিলেন মতামত জানবার জন্য৷ তারা দুজনে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গান উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন৷ বর্তমানে যে সুরে এই গানটি পরিবেশন করা হয় তা তৃতীয় মোডিফিকেশনের ফল৷”

এই সবই ‘একুশের ইতিহাস'-এর অতি জরুরি উপাত্ত৷ আমরা বাঙালিরা খুব সংরক্ষণপ্রবণ নই, অন্য দেশ হলে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের অবদানকে, প্রতিটি স্তর ও পর্যায়ের অনুপুঙ্খকে ধরে রাখতো সংগ্রহশালায়, আর্কাইভে৷ আমাদের সেই পূর্ণাঙ্গতা নেই, তা অর্জনেরও অভিপ্রায় দেখা যায় না তত, এমনকি প্রযুক্তিধন্য এই একুশ শতকেও৷ আমরা গানটাকে আমাদের সমষ্টিস্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখেছি, তার নেপথ্যের মানুষগুলিকে নিয়ে তত চর্চা করিনি৷ মানুষের প্রয়াণে তার কাজের খোঁজ পড়ে, নতুন করে মূল্যায়নের একটা ধারা তৈরি হয়৷ বাংলাদেশে আলতাফ মাহমুদের নামাঙ্কিত ফাউন্ডেশন তার জীবনকৃতির প্রবাহটি প্রাণবন্ত রেখেছে, কিন্তু তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ক'জন অবহিত? ২০২২-র মে মাসে আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রয়াণে ফের এক বার একুশের গানের গীতিকার রূপে তার মূল্যায়ন হচ্ছে৷ বাঙালির বোঝা দরকার, এই মানুষগুলির জীবন ও কাজ বৃহত্তর অর্থে একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্যেরই অচ্ছেদ্য অঙ্গ, নতুন প্রজন্মকে তাদের সম্বন্ধে জানানোটা একটা জাতিগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷

প্রতিটি জাতিরই এমন এক-একটি গান থাকে যা তাদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড'৷ মানুষ সে গানের সুর ও বাণীর মধ্যে নিজেদের জীবন ও সময়কে দেখতে পায়, নিজেদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টি-যাপনে সে গানকে মিশিয়ে নেয়৷ গানগুলির পারস্পরিক তুলনা টানা চলে না, কারণ, প্রতিটি গান যে জাতি-অস্তিত্বের জল-হাওয়া থেকে বেরিয়ে আসে তাদের চরিত্র আলাদা, আলাদা তাদের সংকট, সংগ্রামের অভিমুখ৷‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটির সূত্রে আমরা অন্য দু'-একটি এমন গানের উল্লেখমাত্র করতে পারি, প্রভাবে প্রকাশে যারা মাতিয়েছিল নিজস্ব সংস্কৃতির মানুষকে, এমনকি সেই গণ্ডি ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অন্য ভূমে, অজস্র মানুষের কণ্ঠে৷ ‘উই শ্যাল ওভারকাম' গানটা কার না জানা! গোড়ায় এ ছিল নিতান্ত এক ‘গসপেল সং', বিশ শতকের প্রথম বছরটিতে প্রকাশ পেয়েছিল ‘আই উইল ওভারকাম সাম ডে' রূপে, রচয়িতা চার্লস আলবার্ট টিন্ডলে৷ আমেরিকান মেথডিস্ট চার্চের এক মিনিস্টার ছিলেন মানুষটি, একই সঙ্গে গীতিকার-সুরকারও, আবার ‘গসপেল সং' লিখলেও তার প্রাণভ্রমরাটি ছিল আফ্রিকান-অ্যামেরিকান লোকগানের ঐতিহ্য৷ সে জন্যই কি কালে কালে এই গান রূপ নিলো ‘উই শ্যাল ওভারকাম সামডে'-র? ১৯৬৩-র আগস্টে বছর বাইশের জোয়ান বায়াজ-এর গলায় এ গান আপন করে নিলেন সমবেত তিন লক্ষ মানুষ, মানুষের জীবন, চাকরি, স্বাধীনতার দাবিতে আহুত ‘দ্য গ্রেট মার্চ অব ওয়াশিংটন'-এ এ গান হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের গান, পরে সিভিল রাইটস মুভমেন্টেও তার ব্যাপক ভূমিকা৷ কবে কখন এ গান বাংলা, বাঙালিরও গান হয়ে গিয়েছে— ‘আমরা করবো জয়', হয়েছে হিন্দিতেও: ‘হাম হোঙ্গে কামিয়াব'৷ বিশ্বের গণসংগীত-ইতিহাসের বিশারদরা বলেন ‘ওল'ম্যান রিভার' গানটার কথা৷ মিসিসিপি নদী বয়ে চলেছে নির্বিকার উদাসীন, দু'পাড়ের মানুষের— শোষিত নিপীড়িত আফ্রিকান-অ্যামেরিকান মানুষের কষ্ট ও জীবনসংগ্রামের প্রতি তার কোনও বার্তা নেই৷ ১৯২৭-এ লেখা, পরের বছর রের্কড-হওয়া এ গানের গীতিকার-সুরকার অস্কার হ্যামারস্টিন-জেরোম কার্নকে মানুষ মনে রাখেননি, মনে রেখেছেন গায়ক পল রোবসনকে, তিনিই এ গানকে নবজীবন দিয়েছিলেন তার কণ্ঠে, কথাও পাল্টে নিয়েছিলেন কিছু৷ এই গানকেও বাঙালি আপন করে নিয়েছে, ভূপেন হাজারিকার সুর-বাণী-গায়নে ‘বিস্তীর্ণ দুপারে... ও গঙ্গা বইছো কেন' ইংরেজি গানটি থেকেই প্রাণিত৷ গানের কোনো ভূগোল হয় না, তার ভাবপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে মহাদেশ-মহাসাগর পেরিয়ে অন্য ভূমে, প্লাবিত করতে পারে জনচেতনা, এ তারই প্রমাণ৷ এখানে বলা উদাহরণগুলি সবই মানুষের অধিকার আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে৷ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে নিজস্ব গৌরবে৷ ভাষা আন্দোলনের মূল পর্বের আগে নয়, পরে রচিত হয়েও তা হয়ে উঠেছে একটি জাতির ভবিষ্যৎ অধিকার আন্দোলনের পূর্বগান৷ এ গান সেই দিক থেকে দেখলে সত্তর-একাত্তরের মুক্তির গানগুলির দায়িত্বশীল অভিভাবক, পূর্বসূরি৷

শিশির রায়ছবি: privat

কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মানুষ প্রতি বছরই একুশের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে ঢাকায় যান৷ এখানেও হয় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান— পাড়ায় পাড়ায়, বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার আয়োজনে, সরকারি উদ্যোগে তো বটেই৷ কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে ‘ভাষা শহিদ স্মারক'— মায়ের কোলে লুটিয়ে আছে সন্তান৷ পরম মমতায় দুঃখিনী বাংলা মা আঁকড়ে আছেন হতচেতন ছেলেকে, দেখে মনে পড়ে যায় ‘পিয়েতা' ভাস্কর্যের কথা৷ কবিতায়, গানে, ভাষণে, আবেগী উচ্চারণে বাংলা ভাষাকে উদ্‌যাপন করবেন আজ কত মানুষ৷ একুশ শতকে সেই

উদ্‌যাপনের রূপটিও নানাবিধ৷ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো'-র সঙ্গে সেখানে গাওয়া হবে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান— ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই'৷ কয়েক বছর আগে নাবিদ সালেহিন নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া একটি দুর্দান্ত ব্যাপার করেছিলেন, তার নেতৃত্বে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটি গেয়েছিলেন বারো জন শিল্পী, বারোটি ভাষায়— বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি, আরবি, নেপালি, চীনা, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, ফরাসি, জার্মান, মালয়, রুশ ভাষায়৷ একটি গানের পুনর্জন্ম, নতুন ভাষায়, নতুন ভাষার মানুষের কাছে— এর থেকে বড় পাওয়া কি আর কিছু হতে পারে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ