1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আমার শৈশবের ঝড়ের বয়স বেড়ে গেছে

২৪ এপ্রিল ২০১৮

ঝড় মানেই মৃত্যু, বাস্তুহারা মানুষের মিছিল৷ উপকূল জুড়ে হাহাকার৷ এই প্রাকৃতিক নির্মমতা শুধু ঝড় আর মৃত্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়৷ এর রেশ থেকে যায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে৷

Fotoreportage zur Problematik des Klimawandels in Bangladesch
ছবি: DW/K.Hasan

ছোটবেলার ঝড়ের স্মৃতি মানেই কালবৈশাখি৷ মফস্বলের বাড়ির উঠোন কালো করে ঝড় আসত৷ দূরে পুরোনো সরকারি ক্যাম্প৷ তার সামনের মাঠের ওপারে বড় বড় নারকেল গাছগুলো মাথা ঝাঁকাতো মাতালের মতো৷ মনে হতো গল্পের বইয়ের একেকটা ডাইনি পাগলের মতো করছে৷

ঝড়ের সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি৷ বাতাসের তোপ কিছুটা কমলে বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়ানো৷ কী অদ্ভুত জীবন ছিল!

তবে কখনো কখনো ঝড়ের তোপ এতটাই থাকত যে, দরজা, জানালা পর্যন্ত খোলা যেত না৷ সব বন্ধ করে বসে বসে আকাশের গুড়গুড় শব্দ শোনা৷ টিনের চালে শিলা পড়ার শব্দ৷ এ সবই শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি৷ তখন ঝড় মানেই ছিল এই৷ আর যে দৃশ্য মনে পড়ে তা হলো, পরদিন সকালে দীঘির পড়ে গাছ উপড়ে পড়ে থাকা কিংবা ডাল ভেঙে পড়ার দৃশ্য৷ এসবই শৈশবের রোম্যান্টিকতা৷

পরে একটু বড় হয়ে জানলাম ঝড়ের আরেক দিকের কথা৷ জানলাম, ঝড়ে মানুষ মরে৷ ঘর বাড়ি উজার হয়৷ ঝড়ের বন্যায় নদীর পাড় ভাঙ্গে৷ ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম৷

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের ত্রাণ দিতে যাওয়াকে একটা বড় কাজ হিসেবেই দেখতাম৷ নৌকায় করে পানিবদ্ধ মানুষদের কাছে কাছে যাওয়া, ত্রাণের জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখ দেখে বড় মায়া হতো৷ আমরা ত্রাণ দিতাম শুকনো খাবার, কাপড় আর ঔষধ৷

নৌকায় একেক ধরনের ত্রাণের জন্য একেক জনের ওপর দায়িত্ব থাকতো৷ একবার হয়েছে কী, আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল ঔষধ বিলি করার৷ খুবই সাধারণ ঔষধ – পানি পরিষ্কার করার ট্যাবলেট, প্যারাসিটামল, স্যালাইন – এগুলোই৷

নৌকা ভেড়াতেই অনেকে ভাবল আমি ডাক্তার৷ এসে নানান অসুখের কথা বলা শুরু করলো৷ যাই হোক, কোনোমতে কিছু ঔষধ বিলি করে পার পেলাম৷ কিন্তু ফিরতে ফিরতে মনে হলো, একজন ডাক্তার নেয়া যেত৷

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর এলো৷ আমার পেশা সাংবাদিকতা৷ উপকূল এলাকায় গেলেন আমার সহকর্মীরা৷ তাদের ক্যামেরায় দেখলাম এর ভয়াবহতা৷ শত শত মানুষ মরে পড়ে আছেন উপকূলজুড়ে৷ এ দৃশ্য দেখা যায় না৷

একবার এক সিনিয়র সহকর্মী প্রশ্ন করেছিলেন, প্রকৃতি কখন সুন্দর? আমি উত্তর দিতে পারিনি৷ তখন তিনি বললেন, যখন সে শান্ত থাকে৷ কিন্তু এই শান্ত সুন্দর প্রকৃতির মাঝেই কী ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে, তা না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ ঠিক তাই৷

দু'বছর পর এলো সাইক্লোন আইলা৷ এবার আমি ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে নিজেই ছুটে চললাম উপকূলে৷ যত কাছে এগোই ততই যেন প্রকৃতির কাঁপন টের পাই৷ রাতভর গাড়িতে করে ছুটে চলেছি৷ দু'পাশে নেই আলো৷ বড় বড় গাছগুলো যেন প্রকৃতির কাছে নুয়ে সেলাম ঠুকছে৷

আইলায় সিডরের মতো দশ হাজার মানুষ মারা না গেলেও প্রাণ হারিয়েছিলেন কয়েকশ' জন৷ কিন্তু পানির উচ্চতা ছিল অনেক বেশি৷ জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়ে যায় উপকূলের ৭৬ কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ৷ আরো সাড়ে তিনশ' কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ তিন লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়৷ দু'লাখ একর কৃষিজমি তলিয়ে যায় নোনা পানিতে৷

পটুয়াখালির আন্ধার মানিক নদীর ভয়াবহতা আমি দেখেছি স্বচক্ষে৷ কালো কালো পাহাড়ের মতো ঢেউ৷ বাঁধ ভেঙ্গে আততায়ীর মতো ঢুকে পড়ে ভাসিয়ে নিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম৷

ট্রলারে করে অনেক জায়গায় গিয়েছি৷ দেখেছি পানিবন্দি মানুষের কী নির্মম পরিণতি৷ নিরাপদ নয়, তাই অনেক দুর্গম জায়গায় যেতেই পারিনি, বা আমাকে যেতে দেননি স্থানীয় সহকর্মীরা৷ যত দুর্গম, ভয়াবহতা তত বেশি৷ সাহায্য পাবার সম্ভাবনাও তত কম৷ কী যে এক দুর্বিষহ ব্যাপার৷ খুলনা, সাতক্ষীরা সব জায়গাতেই মানুষের পরিণতি কত নির্মম৷

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলেছবি: Zobaer Ahmed

পরের বছর আবার গেলাম৷ সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে৷ বাগেরহাটের শরণখোলায় বেড়িবাঁধ ধরে হেটে গিয়েছি মাইলের পর মাইল৷ নোনা বাতাসে শরীরে সাদা সাদা ছোপ পড়ে গেছে৷ সেখানে গিয়ে টের পেলাম একটা ঝড়ের ভয়াবহতা শুধু মানুষের মৃত্যুর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়৷ ঝড়ের তাণ্ডবে স্বজনহারা মানুষগুলোর মন যেন কুঁকড়ে গেছে৷

একজন বলছিলেন কিভাবে তিনি সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া তাঁর স্ত্রীর হাত ধরতে পারেননি৷ কয়েক ঘণ্টা একটা খুঁটিকে একহাত দিয়ে এবং আরেকহাত দিয়ে শিশু সন্তানকে বুকে চেপে ধরে ছিলেন৷ ঝড়ের তাণ্ডব শেষ হলে দেখতে পান শিশু সন্তানটিও বেঁচে নেই৷ এমন সব নির্মম ঘটনা ঘরে ঘরে৷

এ তো গেল মানসিক ক্ষতি৷ কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণটিও কম নয়৷ ঘুরতে ঘুরতে এক জেলেমাঝির সঙ্গে দেখা হলো৷ তিনি বললেন, সিডরে তাঁর আয়ের একমাত্র পথ, একমাত্র সম্বল নৌকাটি ভেঙে যায়৷ এরপর ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে আরেকটি নৌকা বানান৷ কিন্তু আইলায় সেটাও ভেসে যায়৷ এখন না খেয়ে হলেও ২০ ভাগের চড়াসুদে নেয়া সেই ঋণ তো পরিশোধ করতেই হবে৷ আবার আয়ের পথটিও বন্ধ৷

এমন ঘটনা এসব এলাকায় ভুড়ি ভুড়ি৷ এক বাড়িতে তালাবন্ধ দেখে কৌতূহল হলো৷ প্রতিবেশীরা জানালেন, ঋণদাতার কিস্তি পরিশোধের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন সবাই৷ আরেক নারীর স্বামী পালিয়েছেন৷ কিন্তু তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে পালাতে পারেননি সেই নারী৷ তাঁকে এখন যে করেই হোক ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ কারণ মানবিক সহায়তার নাম করে চড়া সুদে যারা ঋণ দিচ্ছেন, তাঁরা ছাড়বার পাত্র নন৷

এ সব দেখে শৈশবের ঝড়ের রোমান্টিকতা কবেই উবে গেছে৷ হাজারো লাশ আর পরিবেশ শরণার্থীর মিছিল কোনোভাবেই আম কুড়ানোর রোম্যান্টিকতাকে মনে ঠাঁই দিতে দেয় না৷

ঝড় নিয়ে আপনার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে? লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ