আয়হাম আহমদ হলেন সেই পিয়ানোবাদক, যিনি সিরিয়ার একটি রিফিউজি ক্যাম্পের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পিয়ানো বাজিয়ে বিখ্যাত হন৷ এবার তাঁকে দেওয়া হয়েছে প্রথম আন্তর্জাতিক বেটোফেন পুরস্কার৷
ছবি: DW/R. Fulker
বিজ্ঞাপন
ডিডাব্লিউ: হোমস-এর আল-বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত নিয়ে পড়াশুনা করবার পর আপনি দামেস্কের কাছে ইয়ারমুকের ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
আয়হাম আহমদ: ২০১১ সালে বিপ্লব শুরু হবার পর পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে৷ আমি ইয়ারমুকে ফিরতে বাধ্য হই৷ তারপর শিবিরটি অবরোধ করা হয়৷ আমাদের কোনো খাবার ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না, পানি ছিল না৷ সব কিছুর দাম চড়া৷ আমরা ঘাসপাতা খেয়ে – এমনকি বেড়াল মেরে খেয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়েছি৷ লোকে অনশনে মারা যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে আমার কিছু বন্ধ-বান্ধব আর পরিচিতরাও ছিলেন – কিন্তু বিশ্ব কিছুই করেনি৷
পিয়ানো বাজাচ্ছেন আয়হাম আহমদছবি: DW/R. Fulker
সবচেয়ে কষ্ট হতো, যখন দেখতাম, আমার ছেলে আহমদ খিদেয় কাঁদছে....নিজেকে অসহায় মনে হতো....মনে হচ্ছিল, এবার আমিও নিশ্চয় মরব, কাজেই আমি সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে আমার ‘মিউজিক' দিয়ে আশার আলো জাগানোর সিদ্ধান্ত নিই৷ পিয়ানোটা একটা গাড়িতে বসিয়ে আমি সেটাকে টেনে রাস্তায় বের করে নিয়ে যাই৷ সেখানে আমি আমার নিজের লেখা গান বাজাই, উদ্বাস্তু শিবির আর সিরিয়ার অবস্থা নিয়ে গান, যেখানে রক্ত আর মৃত্যুর উপস্থিতি সর্বত্র৷ আমি পিয়ানো বাজিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গান গাই – কখনো বা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে৷ জইনাব বলে যে মিষ্টি মেয়েটি আমার সঙ্গে গেয়েছিল – ভিডিও-টা ইউটিউবে আছে – পরে সে মাথায় গুলি লেগে মারা যায়৷ ওর কথা ভাবলে সত্যিই কষ্ট হয়৷
সংগীত সুস্থ হতে সাহায্য করে
সংগীত মানুষকে আনন্দ দেয় – সেকথা কম-বেশি সকলেই জানি৷ তবে একটি গবেষণায় দেখা গেছে একসাথে সংগীতচর্চা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে এবং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে রোগীকে সুস্থ করতেও ভূমিকা রাখে৷ আরো পাবেন এই ছবিঘর থেকে৷
ছবি: Hochschule für Musik Karlsruhe
সংগীতের আসর
গান শোনার সময় ‘মোটিভেশন হরমোন’ ডোপামিন এবং ‘সুখ হরমোন’ এন্ড্রোফিন’ মস্তিষ্কে একত্রিত হয়৷ গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো সংগীতদল যখন কোরাসে গান গায়, তখন সেই গান উপভোগ করার সময় এক ধরণের বিশেষ অনুভূতি হয়৷ এই অনুভূতি মানুষকে নিরাপত্তা দেয় এবং মনোযোগও বাড়ায়৷ ফলে ‘ইমিউন সিস্টেম’ আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে৷
ছবি: B. Maas
‘ইমিউনথেরাপি’ হিসেবে গান গাওয়া
বেশ কয়েকটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, কোনো সংগীতদলে গান গাওয়ার পর রোগী অনেক ভালো বোধ করেন৷ শুধু তাই নয়, সংগীত শ্বাস-প্রশ্বাসের নালীকে উজ্জীবিত করে ‘স্ট্রেস’ কমায় এবং তার পাশাপাশি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ‘ইমিউন সিস্টেম’-কেও বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: DW/A. Slanjankic
গান গেয়ে ভালো থাকা
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষক দল বয়স্ক মানুষদের, যাঁরা গায়কদলে গান করেন এবং যাঁরা গান করেন না – তাঁদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালান৷ সমীক্ষা চলাকালীন সখের গায়কদের কম ঔষুধের প্রয়োজন হয় এবং ডাক্তারের কাছেও কম যেতে হয়৷ অথচ যাঁরা গায়কদলের সাথে জড়িত ছিলেন না, তাঁদের অনেক বেশিবার চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে৷
ছবি: picture alliance / dpa
পিয়ানো
‘‘স্ট্রোক হবার পর অনেকেরই আঙুলের খানিকটা অংশ অবশ হয়ে যায়৷ কিন্তু তাঁরা যদি পিয়ানো বাজান, তাহলে আস্তে আস্তে একটি একটি করে আঙুলে শক্তি ফরে আসতে পারে৷ অবশ্য এর জন্য আগে থেকেই পিয়ানো বাজানো জানতে বা শিখতে হবে না৷’’ এ কথা বলেন, জার্মানির হ্যানোভার শহরের মেডিকেল কলেজের সংগীত মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ডা. একার্ট আল্টেনম্যুলার৷
ছবি: picture-alliance/ dpa/dpaweb
ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যায়
পিয়ানো বাজানোর সময় প্রতিবারই হাতের আঙুলে তার প্রতিফলন ঘটে৷ বাজানোর সময় আঙুলের নড়াচড়া এবং শব্দধ্বনি রোগীর অনুভূতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ এর কারণে রোগীর ‘মোটিভেশন’ বা ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যায় এবং স্ট্রোকে ভীত হয়ে যাওয়ার ভাব কেটে যেয়ে৷ শুধু তাই নয়, সংগীত বা গানের মধ্যে বেঁচে থাকার আনন্দও খুঁজে পান রোগীরা৷
ছবি: Nurunnahar Sattar
হাঁপানি রোগ
সংগীত ‘ক্রনিক’ ব্যথা, ভয়, অশান্তি – এ সব কমিয়ে মন ভালো করে দেয়৷ যাঁরা বুড়ো বয়সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, তাঁরা সমাজ থেকে কিছুটা দূরে সড়ে যান৷ অথচ সংগীতের মাধ্যমে ‘ডিমেনশিয়া’-র রোগীদের কাছে যাওয়া যায়, করা যায় বন্ধুত্ব৷ এছাড়া স্যাক্সোফোন বা বাঁশি বাজানোর মধ্য দিয়ে শ্বাসনালীর পেশি শক্ত হয় ও ফুসফুসের কাজ বেড়ে যাওয়ায় ‘অ্যাজমা’ রোগীরাও উপকৃত হতে পারেন৷
ছবি: Hochschule für Musik Karlsruhe
6 ছবি1 | 6
আপনি সিরিয়া ছাড়লেন কি করে?
গত মে মাসে আমার জন্মদিনে আমি ক্যাম্প ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বাজানোর কথা ভাবি; পিয়ানোটাকে একটা ঠেলায় বসিয়ে টেনে নিয়ে যাই তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইসিস-এর একটা চেকপয়েন্ট অবধি৷ সেখানে একজন আইসিস সদস্য আমাকে থামিয়ে জিগ্যেস করে, ‘‘তুমি কি জানো না, এই যন্ত্রটি বাজানো নিষিদ্ধ?'' তারপর সে পিয়ানোটা স্রেফ পুড়িয়ে দেয়৷ সেই সঙ্গে যেন আমার হৃৎপিণ্ড পুড়ে যায়৷
তখন আমি সিরিয়া ছেড়ে জার্মানিতে পালানোর সিদ্ধান্ত নিই৷ এখানে আমি আল ইয়ারমুক ক্যাম্পের কণ্ঠ হতে চাই, সিরিয়ার জন্য একটা কিছু করতে চাই, আমার দুই ছেলে, তিন বছরের আহমদ আর এক বছরের কিনান-এর জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করতে চাই৷
আমার মা প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করেন – প্রায় তিন হাজার ইউরো৷ মা বলেন, ‘‘টাকাটা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাও৷ আমি চাই না যে তোমার তোমার ভাই-এর দশা হোক৷'' আমার ভাইকে তিন বছর আগে গ্রেপ্তার করা হয়৷ আজও সে বেঁচে আছে কিনা, তা আমার জানি না৷
দোতলা পিয়ানো, মিউজিক, সংগীত
03:44
This browser does not support the video element.
এবার আপনি বেটোফেন পুরস্কার পেতে চলেছেন৷ আপনার কাছে এর অর্থ কী?
ইয়ারমুকে থাকাকালীন আমি যে সব গান লিখেছিলাম, অনুষ্ঠানে আমি সেই সব গানই গাইব৷ তার মধ্যে একটি গান আমি গেয়েছিলাম সেই ছোট মেয়েটির সঙ্গে, পরে যে মারা যায়৷ আরেকটি গান আছে, যার কথাগুলো লিখেছিলেন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গাজার একটি ছেলে৷ সে-ও পরে মারা যায়....এই সব আমার ভিতরে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, দুঃখের স্মৃতি আর আনন্দের স্মৃতি, সিরিয়ার স্মৃতি৷
একদল রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বন শহরের রাস্তা, বাজারঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জার্মান ভাষাশিক্ষার কাজে৷ সেই সঙ্গে জার্মানির মানুষজন ও সংস্কৃতিও কিছুটা চেনা হয়ে যাচ্ছে৷ একেই বলে বোধ হয় ‘প্রোঅ্যাকটিভ’ পন্থায় ভাষা শেখা!
ছবি: DW/M. Hallam
উদ্বাস্তুদের জন্য ভাষাশিক্ষার পাঠক্রম
জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া এক কথা, এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা আরেক কথা৷ কারণ তার জন্য প্রয়োজন জার্মান ভাষা শেখা৷ সেটা তো শুধু ক্লাসরুমের বেঞ্চিতে বসেই নয়, বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনেও জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু শেখা যায় – যেমন বন শহরের পথেঘাটে৷
ছবি: DW/M. Hallam
‘ইন্টেগ্রেশন কোর্স’
বিদেশি-বহিরাগতকে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা, সমাজের অংশ করে তোলাকে জার্মানে বলে ‘ইন্টেগ্রেশন’৷ এসিবি লিঙ্গুয়া ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুল রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য একটি বিশেষ ইন্টেগ্রেশন কোর্স চালু করেছে৷ সেই কোর্স অনুযায়ী পড়ুয়াদের মাঝেমধ্যে ক্লাসরুম ছেড়ে পথে বেরিয়ে অচেনা পথচারী বা দোকানিদের জার্মানে প্রশ্ন করতে বলা হয়েছে: ‘আচ্ছা, এটা কী ফল? ঐ সবজিটার নাম কী?’
ছবি: DW/M. Hallam
আনারসের আর্বি যেন কী?
দেখলে চিনতে পারার কথা৷ দামটা না লিখলেও চলে, কিন্তু ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে...৷
ছবি: DW/M. Hallam
পরীক্ষায় নকল নয়, তবে শর্টকাট চলে
ছাত্রদের বলে দেওয়া হয়েছে মোবাইল ব্যবহার না করতে, বরং রাস্তা বা অন্যান্য খোঁজখবরের জন্য মানুষজনকে জার্মানে প্রশ্ন করতে৷ কিন্তু ধরুন যদি বাসাম-এর মতো কাউকে পাওয়া যায়, যে জার্মান আর আর্বি, দু’টো ভাষাই জানে, তাহলে তো পোয়াবারো!
ছবি: DW/M. Hallam
বেটোফেন যেন কবে জন্মেছেন?
লুডভিশ ফান বেটোফেন সম্ভবত বন শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত সন্তান৷ জন্মেছিলেন ১৭৭০ সালে, শহরের মূল চত্বরের কাছের একটি গলিতে বেটোফেনের জন্মের বাড়ি না দেখলে, বন-এ কিছুই দেখা হলো না৷ রাদওয়ান আয়ুজ ও তাঁর ছেলে আলি অতিকষ্টে বেটোফেনের জন্মের তারিখটা খুঁজে বার করেছেন৷
ছবি: DW/M. Hallam
রাস্তাঘাট চেনা
টিমকে হয়ত বলে দেওয়া হয়েছে, ‘ফ্রিডেন্সপ্লাৎস’, মানে শান্তির চত্বরে যাও৷ অথবা ৬০৮ নম্বর বাস কোথায় যাচ্ছে? পরের বাসটা আসবে কখন? বাসটা আবার থামে একটি উদ্বাস্তু আবাসের কাছে, যেখানে দলের অনেকের বাস৷
ছবি: DW/M. Hallam
বন থেকে চিঠি
কোথাও বসে পোস্টকার্ড লেখা হলো ক্লাসের নতুন কাজ৷ তার জন্যে পোস্ট অফিসে গিয়ে স্ট্যাম্প কিনে, পোস্টকার্ডে সেঁটে পোস্ট করতে হবে৷ স্ট্যাম্পের ‘রিসিট’ রেখে দিতে হবে৷
ছবি: DW/M. Hallam
পয়েন্ট মানেই ‘প্রাইজ’
এরপরেও ডয়চে ভেলের রিপোর্টার যে দলটির সাথে ছিলেন, তাঁরা খুব ভালো ফলাফল করতে পারেনি – সম্ভবত রিপোর্টারের কচকচানি, তার ওপর আবার রিপোর্টারকে কোনো প্রশ্নের উত্তর জিগ্যেস করা চলবে না, এই কারণে৷