যাবতীয় আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে অ্যামেরিকাকে সরিয়ে নিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তিনি এ বিষয়ে নতুন করে দরকষাকষির কথা বললেও ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশগুলি তা নাকচ করে দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ পরেই হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প জলবায়ু চুক্তি সংক্রান্ত বহু প্রতিক্ষিত ঘোষণা করলেন৷ তার আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স স্তুতিবাক্যের মাধ্যমে ট্রাম্পের ‘অসাধারণ নেতৃত্বের’ দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন৷ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে ট্রাম্প কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সে বিষয়ের উল্লেখ করেন তিনি৷
এরপর ট্রাম্প নিজে ২০১৫ সালের জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা করেন এবং দীর্ঘ ভাষণে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে একাধিক যুক্তি ও কারণ তুলে ধরেন৷ তাঁর বক্তব্যের মূলমন্ত্র ছিল ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’৷ ট্রাম্প মনে করেন, এই চুক্তি মার্কিন স্বার্থের মারাত্মক ক্ষতি করেছে৷ চীন ও ভারতের মতো দেশ জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার আরও সম্প্রসারণের সুযোগ পেলেও অ্যামেরিকার উপর ‘অন্যায় শর্ত’ চাপিয়ে কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি শিল্পের ক্ষতি করা হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও সার্বভৌমত্বের উপর৷ সেইসঙ্গে বিপুল আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে বলে ট্রাম্প দাবি করেন৷
মার্কিন জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ট্রাম্প কতটা আন্তরিক, তা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি পিটসবার্গের প্রতিনিধি, প্যারিসের নয়৷’’ পিটসবার্গ শহরের মেয়র অবশ্য এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন৷
বলা বাহুল্য, এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ফলে দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বিবৃতিতে বর্তমান প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করেন এবং ফেডারেল সরকারের এই নীতিকে অগ্রাহ্য করে রাজ্য, শহর কর্তৃপক্ষ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে পরিবেশ সংরক্ষণের ডাক দেন৷
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি বাতিল করে বাকি বিশ্বের সঙ্গে নতুন করে এক চুক্তি স্বাক্ষরের আশা প্রকাশ করেন, যার শর্তগুলি মার্কিন স্বার্থের ক্ষতি করবে না৷ এমন প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিচ্ছেন পশ্চিমা জগতের একের পর এক নেতা৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ও ইটালির প্রধানমন্ত্রী পাওলো জেন্টিলোনি এক বিরল যৌথ বিবৃতিতে সাফ জানিয়ে দেন, প্যারিস চুক্তির রদবদল নিয়ে আলোচনা একেবারেই সম্ভব নয়৷ বাকি দেশগুলির উদ্দেশ্যে তাঁরা এই চুক্তি কার্যকর করার উদ্যোগ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন৷
জাতিসংঘের মহাসচিবের দপ্তর থেকেও ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়েছে৷
চীনের সরকারি শিনহুয়া সংবাদ সংস্থা এক সংবাদভাষ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে৷ শুক্রবার চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্যারিস চুক্তির প্রতি নতুন করে আস্থা দেখাতে চলেছে৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
বিকল্প জ্বালানির পথে জার্মানি
আজকের বিশ্বে অনেক দেশেই জ্বালানি-নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা চলছে৷ জাপানে ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর জার্মানি পরমাণু ও জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি সম্পূর্ণ বর্জন করে পুরোপুরি বিকল্প পথে অগ্রসর হচ্ছে৷
ছবি: Reuters
ফুকুশিমা বিপর্যয়ের গভীর প্রভাব
২০১১ সালের মার্চ মাসে ফুকুশিমা বিপর্যয়ের ঠিক আগে জার্মানি তার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ কিন্তু জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশে পরমাণু চুল্লির এমন বিপর্যয়ের ফলে জার্মানি সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ধাপে ধাপে সব পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার৷
ছবি: dapd
জ্বালানি-নীতির আমূল পরিবর্তন
আর দেরি না করে ২০১১ সালের ৬ই জুন জার্মানির মন্ত্রিসভা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়৷ এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধাপে ধাপে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে ২০২২ সালে জার্মানির শেষ পরমাণু কেন্দ্র অচল করে দেওয়া হবে৷ অন্যদিকে ২০২০ সালের মধ্যে গোটা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ আসবে বিকল্প জ্বালানি থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুধু বিদ্যুতের উৎস নয়
জ্বালানি-নীতির ক্ষেত্রে জার্মানির এই আমূল পরিবর্তন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই৷ সার্বিক এই নীতির আওতায় পরিবহণ ও শীতকালে ঘরবাড়ি গরম রাখার উত্তাপের উৎসকে রাখা হয়েছে৷ এ সব ক্ষেত্রেও জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে না পারলে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়৷
ছবি: REUTERS
বিকল্প জ্বালানির আর্থিক সুবিধা
ছাদে সোলার প্যানেল লাগালে জার্মানিতে বাড়ির মালিক তা থেকে দু’পয়সা আয় করতে পারেন৷ একদিকে সরকার নামমাত্র সুদে ঋণ ও অন্যান্য অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে৷ অন্যদিকে কিছু বিদ্যুৎ কোম্পানি তাঁদের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ কিনে নিতে পারে৷
ছবি: DW/G.Rueter
লোকসানের ধাক্কা
জার্মানির সবচেয়ে বড় বেসরকারি জ্বালানি কোম্পানি ‘এয়ন’ জ্বালানি-নীতির পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক লোকসানের মুখ দেখছে৷ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলেও আপাতত আর্থিক ক্ষতির মুখ দেখতে হচ্ছে এই সংস্থাকে৷ ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে লোকসানের মাত্রা ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ইউরো৷ অন্যান্য কিছু সংস্থাও লোকসানের মুখ দেখছে৷
ছবি: Reuters/I. Fassbender
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি
বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন পরিবেশের ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে৷ কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত কড়া বিধিনিয়িমের ফলে এমন প্রকল্পও বাধার মুখে পড়ছে৷ যেমন উপকূলের কাছে সমুদ্রের উপর বায়ুশক্তি টার্বাইন গড়ে তোলার বিরুদ্ধে মামলা করেছে এক পরিবেশ সংগঠন৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পের পরিকল্পনার সময় পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখলে এমন সমস্যা এড়ানো সম্ভব৷
ছবি: Bund/M.Rode
বাজার অর্থনীতির উপযোগী
শুধু সরকারের একার পক্ষে জ্বালানি-নীতির পরিবর্তন ও বিকল্প জ্বালানি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার প্রচেষ্টা কোনো দেশেই বেশি দিন চলতে পারে না৷ জার্মানি দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর পর বিকল্প জ্বালানির ক্ষেত্রে কিছু ভরতুকি বন্ধ করে দিয়েছে৷ সরকারের বক্তব্য, বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন এতদিনে লাভজনক হয়ে উঠেছে৷ বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টিকে থাকার ক্ষমতাও এসে গেছে৷
ছবি: BELECTRIC.com
বিদ্যুৎ পরিবহণ
বিকল্প জ্বালানির উৎপাদন বাড়িয়ে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমানো যায় বটে, কিন্তু ‘ক্লিন এনার্জি’ গোটা দেশে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ৷ জার্মানির উত্তরে সমুদ্র উপকূল থেকে বায়ুশক্তি প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাভেরিয়া রাজ্যে পৌঁছে দিতে বিশাল এক প্রকল্পের কাজ চলছে৷ এই উদ্যোগকে ঘিরে বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সামলে নিতে পারলে এই পথে ২০২২ সাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে৷
ছবি: Fotolia/Thorsten Schier
জার্মানির সুদূরপ্রসারী জ্বালানি নীতি
জ্বালানির ক্ষেত্রে জার্মানি যে সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করেছে, তার তুলনা মেলা ভার৷ এ বিষয়ে আরও জানতে চান? উপরে ডানদিকে ক্লিক করুন৷