যে আরএসএস হিন্দুত্বাদী রাজনীতির জন্য পরিচিত, তার প্রধান মোহন ভাগবত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা শোনালেন।
বিজ্ঞাপন
ভারতবাসীর পরিচয়, তিনি একজন ভারতীয়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যই ভারতের পরিচয়। এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বললেন, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। তার এই বক্তব্য নিয়ে দেশ জুড়ে নতুন করে জল্পনা শুরু করেছে। কেউ বলছেন, সামনে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই এমন কথা বলেছেন ভাগবত। আবার কেউ বলছেন, ভাগবত যদি সত্যিই এ কথা মনে করেন, তাহলে বিজেপির যে নেতারা সাম্প্রদায়িক কথা বলছেন তাদের বিরুদ্ধএ ব্যবস্থা নিক আরএসএস।
ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্য পরিচিত আরএসএস। যার প্রধান এখন মোহন ভাগবত। আরএসএস-এর ছাতার তলায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের মতো অতি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যেমন আছে, তেমনই আছে বিজেপির মতো রাজনৈতিক সংগঠন। সকলেই আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী নীতি অনুসরণ করে। এই আরএসএস বহু বছর ধরে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসার করেছে জনসমক্ষে। ঘরওয়াপসির কথা বলেছে। অর্থাৎ, মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের ধর্মান্তরিত করার কথা বলা হয়েছে। সেই আরএসএস-এর প্রধান যখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলেন, তখন তা অন্য বার্তা বহন করে।
দুনিয়ার কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে৷ এদের মধ্যে বিজেপি, জামায়াতে ইসলামিসহ কয়েকটি দলের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে৷ ছবিঘরে বিস্তারিত৷
ছবি: DW/O. S. Janoti
জার্মানি
ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন বা খ্রিস্টিয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ জার্মানির সবচয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বেশিরভাগ সময় এই দলটি জার্মানির ক্ষমতায় রয়েছে৷ ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যাথলিক মতাদর্শের দলটি বর্তমান বিশ্বে নিজেদের উদারনীতির জন্য পরিচিত৷ দলটি মধ্য-ডানপন্থি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/M. Rietschel
অস্ট্রিয়া
এই দেশে ডানপন্থি আন্দোলনের নেতা ভিয়েনার মেয়র কার্ল লুগারের নেতৃত্বে ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় ক্রিস্টিয়ান সোশ্যাল পার্টি(সিএসপি), বর্তমান নাম অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টি (ওভিপি)৷ খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীল এই দলটি বর্তমানে ক্ষমতায়, যাদের নীতি অভিবাসনবিরোধী৷
ছবি: Herbert Neubauer/APA/picture alliance
নেদারল্যান্ডস
দেশটির ধর্মভিত্তিক দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক আপিল (সিডিএ)৷ ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সিডিএ’র এর মূল আদর্শ: খ্রিস্টান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্যানাডা
কুইবেক রাজ্যে ২০০০ সালে রোমান ক্যাথলিকদের সহযোগিতায় গঠিত হয় ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি৷ পার্টির মূলনীতিতে বলা হয়েছে,‘‘অর্থোডক্স খ্রিষ্টীয় মতবাদ ও কুইবেক জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ই হবে দলের প্রধান লক্ষ্য৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/C. Roussakis
অন্যান্য দেশে ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি
ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, ইটালি, সুইজারল্যান্ড, লেবানন, নরওয়ে, সিরিয়া, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সার্বিয়া, রোমানিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, বলিভিয়া, হাইতি এসব দেশেও খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি রয়েছে৷
ছবি: Alessandra Tarantino/AFP
তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি
‘একে’ পার্টি নামে পরিচিত রক্ষণশীল এই দলের নেতা রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ ২০০৩ সাল থেকে এর্দোয়ানের দল দেশ পরিচালনা করছে৷ ২০০১ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এবং ইসলামি পরিচয় দিয়ে মুসলমান ভোটারদের সমর্থন পেলেও দলটি নিজেদের ইসলামভিত্তিক দল বলতে নারাজ৷ এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দমনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/AP/picture alliance
ভারত, বিজেপি
১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের হিন্দু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসংঘ পরে জনতা পার্টি নামে দল গঠন করে৷ ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টিতে মিশে যায় জনসংঘ৷ ১৯৮০ সালে সাবেক জনসংঘ সদস্যরা বেরিয়ে এসে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠন করে৷ ১৯৯৬ সালে কট্টরপন্থি দলটি বৃহত্তম দলে পরিণত হয়৷ বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, গুজরাট দাঙ্গায় উস্কানিসহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Kumar
ভারত, শিব সেনা
১৯৬৬ সালে কার্টুনিস্ট বাল ঠাকরে এই হিন্দুত্ববাদী এই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন৷ তাদের আধিপত্য মূলত মুম্বই কেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে দলটির৷ শিব সেনা দলের প্রধান উদ্ধব ঠাকরে বর্তমানে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Maqbool
নেপাল
আশি শতাংশেরও বেশি হিন্দু অধ্যূষিত দেশ নেপাল৷ সনাতন ধর্ম সমিতি, নেপালি জনতা পার্টি (বিজেপির নেপালি সংস্করণ) প্রধানতম ধর্মীয় দল,যা হিন্দুদের আম্ব্রেলা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য৷
ছবি: PRAKASH MATHEMA/AFP/Getty Images
পাকিস্তান
জামাত ই ইসলামী পাকিস্তানের বৃহত্তম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল৷ পাকিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে, শরিয়া আইন দিয়ে দেশ পরিচালনার লক্ষ্যে ১৯৪১ সালে দলটির প্রতিষ্ঠা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (আগের নাম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ)৷ ১৯৭৭ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মভিত্তিক দলটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷ ২০০১ সালে বিএনপি’র সাথে জোট গঠন করে পার্লামেন্টে স্থান করে নেয় জামায়াত৷ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এই দলের শীর্ষ অনেক নেতা৷ এছাড়া বিভিন্ন সময় নাশকতার অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে৷
ছবি: Getty Images/AFP
11 ছবি1 | 11
রোববার মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ভাগবত। সেখানে তিনি বলেছেন, ''যে বা যারা গো-রক্ষার দোহাই দিয়ে গণরোষ তৈরি করে কাউকে কাউকে আক্রমণ করছেন, তারাও হিন্দুত্বের বিরোধী। মনে রাখতে হবে, ভারতের হিন্দু, মুসলিম একই উৎস থেকে এসেছে।'' অথচ এই আরএসএস-এরই একটি সংগঠন গোরক্ষক সমিতি। বিভিন্ন অঞ্চলে গোরক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে বার বার উঠে এসেছে। বস্তুত, ফ্রিজে গোমাংস রাখা থাকতে পারে, এই অপরাধে খুন হতে হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে। সেখানেও হিন্দুত্ববাদীদের নাম সামনে এসেছে। প্রশ্ন উঠছে, তখন কেন চুপ ছিলেন ভাগবত? যদি সত্যিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন তিনি, তাহলে কেন গোরক্ষক সমিতির মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস-এর ছাতার তলায় স্থান পায়। কেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘরওয়াপসি স্লোগানের বিরোধিতা করেন না তিনি?
ভাগবত বলেছেন, ''গরু একটি পবিত্র প্রাণী। কিন্তু গো-রক্ষার কারণে যারা গণরোষ তৈরি করে অন্যত্র আক্রমণ করছেন, তারা হিন্দুত্ব থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন। আইন আইনের পথে চলবে।'' প্রশ্ন উঠছে, উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে, যেখানে একের পর এক লিঞ্চিংয়ের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আইন অপরাধীদের শাস্তি দিচ্ছে? পুলিশ এবং প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে? ম্প্রতি গাজিয়াবাদের একটি ঘটনা ফের এই প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে।
বস্তুত, মোহন ভাগবতের কথা শুনে এই প্রশ্নগুলিই তুলেছে এমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েসি। তাঁর প্রশ্ন, নাথুরাম গডসের ভাবাদর্শে যারা বিশ্বাস করেন, যারা হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাস করে, তারাই মুসলিমদের লিঞ্চিং করে। এবং তাদের সমর্থন দেয় হিন্দুত্ববাদী সরকার। ভাগবত কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?
কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং বলেছেন, ''মোহন ভাগবত কি এই শিক্ষা তার প্রচারক, অনুগামী, বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতাদের দেবেন? বিজেপির যে নেতারা হেট স্পিচ দেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?''
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ভগবতের এই বক্তব্য আসলেরাজনৈতিক। উত্তর প্রদেশে বিজেপি খুব ভালো জায়গায় নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। আগামীা বছর সেখানে নির্বাচন। উত্তর প্রদেশের মুসলিম ভোটও বিজেপির দরকার। সে কারণেই এ ধরনের সম্প্রীতির কথা বলছেন ভাগবত। তবে ভগবত নিজে বলেছেন, তিনি কোনো রাজনীতির কথা বলতে চান না।
বস্তুত, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ উগ্র হিন্দুত্ববাদী বলেই পরিচিত। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার হেট স্পিচ দেওয়ার অভিযোগ আছে। লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে তিনি আইন করেছেন। সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় মুসলিমদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। মোহন ভগবতের বক্তৃতা সেই সমস্ত ক্ষতে মলম দেওয়ার জন্যই তৈরি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ।