রাশিয়া ও চীনের সংশয় সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদ একযোগে উত্তর কোরিয়ার উপর নতুন এক ঝাঁক নিষেধাজ্ঞা চাপালো৷ ফলে ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া প্রথম বার পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পর এই নিয়ে ৯ বার জাতিসংঘ সে দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপালো৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Jon Chol Jin
বিজ্ঞাপন
গত ৩রা সেপ্টেম্বরের পরমাণু পরীক্ষার পর এবারের নিষেধাজ্ঞার আওতায় উত্তর কোরিয়া থেকে বস্ত্র রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করার পাশাপাশি সে দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহের উপর কিছু শর্ত চাপানো হয়েছে৷ অ্যামেরিকার ইচ্ছামতো পেট্রোলিয়াম সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হবে৷ বর্তমানে সে দেশে যে পরিমাণ অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পাঠানো হয়, সেটিকেই ঊর্দ্ধসীমা হিসেবে স্থির করা হয়েছে৷ নতুন করে উত্তর কোরিয়ার কোনো শ্রমিককে বিদেশে কাজের অনুমতি দেওয়া যাবে না৷ উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে প্রায় ৯৩,০০০ উত্তর কোরীয় শ্রমিক বিদেশে কর্মরত৷
জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হেলি বলেন, এই সব পদক্ষেপের মাধ্যমে পিয়ং ইয়ং-কে স্পষ্ট বার্তা পাঠানো হচ্ছে যে, বিশ্ব পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়া মেনে নেবে না৷ তবে বর্তমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনাও তুলে ধরেন তিনি৷ হেলি বলেন, অ্যামেরিকা মোটেই যুদ্ধ চায় না৷ পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করলেই উত্তর কোরিয়া তার ভবিষ্যৎ আবার নিশ্চিত করতে পারবে৷ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য প্রমাণ করলে গোটা বিশ্ব সে দেশের প্রতি শান্তির পথে এগোবে৷
কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা কমাতে চীন ও রাশিয়া সীমান্তের দুই প্রান্তেই শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপের ডাক দিচ্ছে৷ অর্থাৎ তারা চায়, উত্তর কোরিয়া পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করুক৷ সেই সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়াও বন্ধ হোক৷ অ্যামেরিকা অবশ্য এই প্রস্তাব মানতে নারাজ৷ রাশিয়া মনে করে, বর্তমান সংকট কাটাতে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞা চাপানো ঠিক নয়৷ তাছাড়া এখনই নিষেধাজ্ঞার মাত্রা চরমে নিয়ে গেলে ভবিষ্যতে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের হাতে আর কোনো পদক্ষেপ নেবার উপায় থাকবে না৷ চীনও দ্রুত উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিচ্ছে৷
নিরাপত্তা পরিষদের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে এশিয়ার অনেক দেশ৷ উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কারণে এইসব দেশ চরম অস্বস্তিতে ভুগছে৷
উত্তর কোরিয়ায় কিম বংশের ‘রাজত্ব’
কিম পরিবার গত ৭০ বছর ধরে উত্তর কোরিয়া শাসন করছে৷ রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় কিম ইল-সুং, কিং জং-ইল ও কিম জং-উন প্রায় দেবতার সমান৷ কিন্তু কিংবদন্তির পিছনে মানুষগুলি কারা?
ছবি: picture alliance / dpa
তরুণ নেতা
উত্তর কোরিয়ার প্রথম ও ‘চিরন্তন’ প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সুং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে ক্ষমতায় আসেন ১৯৪৮ সালে৷ উত্তর কোরিয়ার সরকারি বর্ষপঞ্জির শুরু কিম ইল-সুং-এর জন্মবর্ষ ১৯১২ সাল থেকে৷ ছবিতে কিম ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন, যে চু্ক্তির মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের বাস্তব সমাপ্তি ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বীরগাথা
কোরিয়া যুদ্ধের পর দশকের পর দশক ধরে পিয়ংইয়ং-এর প্রচারণা যন্ত্র কিম ইল-সুং-কে ঘিরে এক কিংবদন্তির মায়াজাল সৃষ্টি করেছে৷ কিমের ছোটবেলা আর ত্রিশের দশকে জাপানিদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের ভিত্তিতে তাঁকে এক অদ্বিতীয় সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে৷ ১৯৮০ সালের পার্টি কংগ্রেসে কিম ঘোষণা করেন যে, তাঁর পুত্র কিম জং-ইল তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আমৃত্যু শাসক
১৯৯২ সালে কিম ইল-সুং তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে ও প্রকাশ করতে শুরু করেন৷ নাম দিয়েছিলেন ‘এক শতাব্দীর স্মৃতি’৷ স্মৃতিকথায় কিম দাবি করেছেন যে, তিনি ছয় বছর বয়সে একটি জাপানি বিরোধী প্রতিবাদসভায় যোগদান করেন ও আট বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট হন৷ ১৯৯৪ সালে কিমের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিকথা অসমাপ্তই থেকে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/JIJI Press
‘দ্য কিম ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিম’
পিতার মৃত্যুর পর কিম জং-ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেন৷ ইতিপূর্বে তিনি বহু বছর ধরে ক্ষমতাশীল ওপরমহলের সদস্য ছিলেন৷ তাঁর ১৬ বছরের শাসনে দরিদ্র দেশটি দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে৷ কিন্তু কিম ও তাঁর পরলোকগত পিতাকে নিয়ে ব্যক্তিপূজার ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/KCNA via Korean News Service
উঠতি তারকা
রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে একটি সামরিক শিবিরে কিম জং-ইল-এর জন্ম হয়েছিল বলে উত্তর কোরিয়ার বাইরে ইতিহাসবিদদের ধারণা৷ কিন্তু কিমের সরকারি জীবনী অনুযায়ী, তাঁর জন্ম কোরিয়ার পবিত্র পাইচু পর্বতে, ১৯৪২ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে, অর্থাৎ তাঁর বাবার জন্মদিনের ঠিক ৩০ বছর পরে৷ কিমের জন্মের সময় নাকি আকাশে একটি নতুন তারা ও একটি যমজ রামধনু দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
পারিবারিক জটিলতা
কিম জং-ইল তিনজন পৃথক মহিলার সঙ্গে মোট তিন পুত্র ও দুই কন্যার জনক হন৷ ১৯৮১ সালের এই ছবিটিতে কিমকে তাঁর পুত্র কিম জং-নাম-এর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যিনি ২০১৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উত্তরাধিকারী
২০০৯ সালে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম খবর দেয় যে, কিম জং-ইল তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কিম জং-উনকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছেন৷ ২০১০ সালে একটি সামরিক কুচকাওয়াজে দু’জনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল৷ পরের বছর কিম জং-ইল পরলোকগমন করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Yu
পিতাপুত্র
পিয়ংইয়ং-এর কাহিনী অনুযায়ী, ২০১১ সালে কিম জং-ইল-এর মৃত্যুর সময় একাধিক রহস্যজনক ঘটনা ঘটে৷ পবিত্র পাইচু পর্বতের উপর একটি হ্রদে জমা বরফ বরফঝড় চলাকালীন হঠাৎ বিকট আওয়াজ করে ফেটে যায়৷ অপরদিকে পাহাড়ের গায়ে এক অগ্নিময়ী বার্তা ফুটে ওঠে৷ কিম জং-ইল-এর মৃত্যুর পর পিয়ংইয়ং-এ তাঁর বাবার মূর্তির পাশে কিম-এর একটি ২২ মিটার উঁচু মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রহস্যময় অতীত
ক্ষমতা গ্রহণের আগে কিম জং-উন পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরেই ছিলেন৷ তাঁর সঠিক বয়স নিয়েও বিতর্ক আছে৷ তবে তিনি ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়৷ তাঁর শিক্ষা সুইজারল্যান্ডে বলে কথিত আছে৷ ২০১৩ সালে তিনি সাবেক মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যান-এর সঙ্গে পিয়ংইয়ং-এ মিলিত হয়ে দুনিয়াকে চমকে দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কিমাশ্চর্য
আগের কিমদের মতো কিম জং-উনকে নিয়েও নানা ‘কিম’-বদন্তি, অর্থাৎ কিংদন্তি রয়েছে৷ ২০১৫ সালে উত্তর কোরিয়ার শিক্ষকদের জন্য একটি নতুন ম্যানুয়ালে নাকি দাবি করা হয় যে, কিম তিন বছর বয়সেই গাড়ি চালাতে পারতেন৷ ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার খবর: পাইচু পর্বতের উপর কিম-এর জন্য একটি স্মৃতিসৌধ সৃষ্টি করা হবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Kctv
পারমাণবিক উচ্চাশা
পিতা ও পিতামহের চাইতে অনেক কম বয়সে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও কিম শক্ত হাতে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন৷ ২০১৭ সালে বিদেশে আততায়ীর হাতে তাঁর সৎভাই কিম জং-নাম-এর মৃত্যুর পর নির্মম একনায়ক হিসেবে পশ্চিমে কিম জং-উন-এর ভাবমূর্তি আরো দৃঢ় হয়েছে৷ এছাড়া কিম তাঁর দেশের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার অভূতপূর্ব ভাবে বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন৷