আরজি কর আন্দোলন কি এখন রাজনৈতিক?
১২ আগস্ট ২০২৫
গত বছরের ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালে কর্মরত জুনিয়র চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুন হয়েছিলেন। এরপর থেকে যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার মূল চালিকাশক্তি ছিলেন নিহত চিকিৎসকের সহকর্মীরা। ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট সামনে থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল।
আন্দোলনের সূচনা
আরজি কর আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল রাজ্যজুড়ে। কোনো রাজনৈতিক পতাকা ছাড়া সাধারণ মানুষ পথে নেমেছিলেন। কলকাতা সহ জেলা শহরগুলিতে রাত দখল করেছিলেন নারীরা। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের ইতিহাসে এই আন্দোলনকে অভূতপূর্ব তকমা দেয়া হয়েছে।
এই আন্দোলনের সঙ্গে বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন যুক্ত হয়েছিল। চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন ছিল আন্দোলনের পুরোভাগে। তৈরি হয়েছিল অভয়া মঞ্চ। আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলেন কোনো সংগঠনের ছাতার নীচে না থাকা মানুষজন। জুনিয়র চিকিৎসকদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও রাজনীতির হস্তক্ষেপ আন্দোলনে দেখা যায়নি।
প্রাথমিক পর্যায়ে আন্দোলনের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। এমনকী রাজনৈতিক দলের নেতারা জুনিয়র চিকিৎসকদের জমায়েতে হাজির হলে তাদের শুনতে হয়েছে গো ব্যাক ধ্বনি। কলকাতা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ও বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ফিরে যেতে হয়েছে সংহতি জানাতে এসে।
এক বছর পরে
কিন্তু আন্দোলনের এক বছরের মাথায় এই দৃশ্যে বদল দেখা যাচ্ছে। আন্দোলন দুটি ধারায় বিভাজিত হয়ে গিয়েছে। ৯ আগস্ট যখন নবান্ন অভিযান হয়েছে, সেই সময় কালীঘাট চলোর কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। নবান্ন অভিযানের ডাক নির্যাতিতা চিকিৎসকের মা-বাবা দিলেও পুরো বিষয়টিকে গোড়া থেকে সংগঠিত করতে দেখা গিয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। অভিযানের সময়ও তাকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে।
জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন নবান্ন অভিযান থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ফ্রন্টের অন্যতম নেতা দেবাশিস হালদারের বক্তব্য, "বিরোধী দলনেতা নিজে প্রেস কনফারেন্স করে এই কর্মসূচির কথা বলেছেন। পতাকা না থাকলেও এটা যে বিজেপির কর্মসূচি, সে কথা সবাই বলেছে। তাই এই কর্মসূচিতে আমরা যেতে পারিনি।"
এই আন্দোলনের মুখ হিসেবে দেখা হচ্ছে নিহত চিকিৎসকের বাবা ও মাকে। তারা প্রায় এক বছর চিকিৎসক ও নাগরিক সমাজের অরাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। এখন তারা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি এই আন্দোলন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল?
অভয়া মঞ্চের আহবায়ক চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ ডিডাব্লিউকে বলেন, "বন্যার জল থেকে বাঁচতে মানুষ খড়কুটোর মতো যা পায় আঁকড়ে ধরে, অভয়ার বাবা-মা সেভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী দলনেতার এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার নৈতিক অধিকার আছে বলে আমাদের মনে হয় না। তিনি যে দলের নেতা, তাদের সরকার কেন্দ্রে রয়েছে। অথচ রাজ্য সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিবিআই অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। তারাই আবার নবান্ন অভিযান কীভাবে করে?"
তিনি বলেন, "আমরা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাস্তার আন্দোলনে থাকব। নির্ভয়ার জন্য বিচার পেতে সাত বছর লেগে গিয়েছিল। এখানেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।"
অভয়ার আন্দোলনে চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন যুক্ত হয়েছিলেন। তাদের প্রতিনিধি অভিনেতা বাদশা মৈত্র ডিডব্লিউকে বলেন, "কোনো আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ নানাভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। নাগরিক সমাজ একভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, অভয়া মঞ্চ রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আন্দোলনকে দিশা দেখাতে পারে। কোনো রাজনৈতিক দল চাইলে এই বিষয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতেই পারে। অভয়ার বাবা-মা কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় না গিয়ে যদি সবাইকে নিয়ে চলতে পারেন, তাহলে আন্দোলন আরো শক্তিশালী হবে। কোনো আন্দোলন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে চলে গেলে, তার মধ্যে অনেক বিভাজন তৈরি হবে। রাজনৈতিক নেতারা প্রতিবাদে সামিল হতে পারেন, কিন্তু আন্দোলন যেন কোনো দলের না হয়ে যায়।"
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "আরজি কর আন্দোলন, যেটা গত সিকি শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় নাগরিক আন্দোলন, সেটা রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে চলে গেল। এর কারণ, সেটার উদ্দেশ্য আর সীমাবদ্ধ থাকল না শুধুমাত্র নারীসুরক্ষা নিশ্চিত করায়। সেটা আসলে রাজনীতিতে এইভাবে অনুপ্রবেশ করল যে, এই আন্দোলনকে ব্যবহার করেই বর্তমান সরকারকে সরিয়ে দিতে হবে। যতক্ষণ আন্দোলনটা নারী সুরক্ষার ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে ছিল, ততক্ষণ আন্দোলনের পিছনে যে জনসমর্থন ছিল, সেটা বজায় ছিল। কিন্তু সেটা যখন সরকার বদলের আন্দোলন হয়ে গেল, তখন সেটা থেকে মানুষ সরে গেল।"
সিনিয়র চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত আন্দোলনে বিভাজন বা রাজনীতিকরণের তত্ত্বে সহমত নন। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "একটা ঘটনার এক বছর পরেও মানুষ রাত জেগে মশাল মিছিল করেছে। একদল নবান্নঅভিযান করেছে, আর একদল জড়ো হয়েছে হাজরা মোড়ে। এমন আন্দোলন কবে হয়েছে? এত বড় একটা আন্দোলনে বিভিন্ন রকম মত থাকবেই, সেটাই স্বাভাবিক। সবকিছু একজোট হয়ে করা যায় না। এই ঘটনাটা এখনো প্রাসঙ্গিক এবং তা মানুষকে ভাবিয়ে চলেছে, এটাই বড় কথা।"
আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "এই ঘটনায় এত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এখনো বাকি আছে, যা আগামী ১৫০-২০০ বছরেও মানুষ জবাব খুঁজবে। পুরো আন্দোলনটাই এখানে রাজনৈতিক, সেখানে রাজনৈতিক দল অংশ নেবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার। এই বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির জঙ্গি আন্দোলন করা উচিত। আরজি করে যে ঘটনা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশের নারী ও শিশু সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনীতিকরা যদি এটা নিয়ে আন্দোলন না করেন, তাহলে কী নিয়ে করবেন।"