গতবছর ৯ অগাস্ট সকালে একটা খবরে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। কলকাতা শহরের বুকে আরজি করের মতো একটা সরকারি হাসপাতালে রাতে ডিউটি করার সময় ধর্ষিতা হয়ে খুন হন পালমোনোলজি বিভাগের এক জুনিয়র ডাক্তার। এর পরেই এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। এই ঘটনার প্রতিবাদে, নির্যাতিতার বিচার চেয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন লক্ষাধিক মানুষ। আরজি করের সেই নৃশংস ঘটনার পাশাপাশি অগণিত মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনেরও আজ এক বছর পূর্ণ হলো। এই একবছরে কোথায়ে দাঁড়িয়ে আন্দোলন? কতটা বিচার পেলেন অভয়ার বাবা মা?
অভয়ার এক বছর
এক বছর পরেও তাদের বাড়ির সামনে ২৪ ঘণ্টার পুলিশি প্রহরা। বাড়িতে যখন তখন যাচিত, অযাচিত মানুষের আনাগোনা। কখনো সহৃদয় বন্ধু, কখনো মিডিয়া, কখনো বা সরকারি আধিকারিক দরজায় কড়া নাড়ছেন। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি এখনো। ডিডাব্লিউয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অভয়ার মা বলেছেন, "সেই ৯ অগাস্ট আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যতদিন ন্যায়বিচার দিতে পারব, ততদিন চুল আঁচড়াবো না। আমি একবছর চুল আঁচড়াই না। এটা দেখলে হয়তো আমার মেয়েটাই সবথেকে বেশি কষ্ট পেতো।"
৯ অগাস্ট বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনে আসতে থাকে একের পর এক বীভৎস তথ্য। এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এক লহমায় প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায় রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রাই। নিম্ন আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। তার পরেও অভয়ার বাবা মায়ের দাবি, প্রকৃত বিচার এখনো অধরা।
অভয়ার মায়ের দাবি, "ন্যায়বিচার বলতে আমরা বিচারই পাইনি কোনো। আমার মেয়ের মৃত্যুর আসল রহস্য কী? কেন তাকে হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় মারা হলো, খুন করা হলো, ধর্ষণ করা হলো? কারা করলো? আমরা এখনো কিছুই জানতে পারিনি। সবই অধরা।"
নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালাচ্ছেন তারা। কখনো চাপ, কখনো প্রলোভন আসছে রাজনীতির কারবারিদের থেকে। অভয়ার বাবার দাবি, "যারা পাশে থাকতে চান, তারা স্বাগত। রাজনৈতিক চাপ ছিল অনেক। সেই চাপ সামলেছি। আর রাজনৈতিক প্রলোভন এড়িয়ে চলি। আমরা চাই আমাদের মেয়ের তদন্তে স্বচ্ছতা আসুক। আমার মেয়ে ন্যায়বিচার পাক।" বলতে বলতে গলা বুজে আসে তার।
আরজি করে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন থেকে মামলার রায়
আরজি করে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন করার পাঁচ মাস নয় দিন পর রায় এলো। সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুন
৯ অগাস্ট ২০২৪: কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উদ্ধার হয়েছিল এক নারী চিকিৎসকের দেহ। অভিযোগ উঠেছিল, ওই চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পাঁচ মাস নয় দিন পরে ১৮ জানুয়ারি, শনিবার সেই ধর্ষণ-খুনের মামলায় রায় ঘোষণা হলো শিয়ালদহ আদালতে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিভিক ভল্যান্টিয়ার গ্রেপ্তার
১০ অগস্ট: ঘটনার তদন্তে নেমেই এক সিভিক ভল্যান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআইও তদন্ত চালিয়ে ধৃত সিভিক ভল্যান্টিয়ারকেই ‘একমাত্র অভিযুক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করে আদালতে চার্জশিট পেশ করে। তার দুই দিন পরেই নিহত ছাত্রীর বাড়িতে পৌঁছে তাঁর বাবা, মায়ের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত
১৩ অগস্ট: সিবি আই তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পাঁচ দিনের মাথায় সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকে এই বিষয়ে মামলা শুরু করে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নারীদের রাত দখলের ডাক
১৪ অগস্ট: কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা রাত দখলের ডাক দেন। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নামেন। নজিরবিহীন ‘নাগরিক আন্দোলন’ দেখে কলকাতা সহ সারা দেশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরজি করে হামলা
১৪ অগস্ট: মধ্যরাতেই দুষ্কৃতী তাণ্ডব চলে আরজি কর হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ে। ভেঙে তছনছ করে ফেলা হয় সরকারি সম্পত্তি সহ আন্দোলনকারীদের অবস্থান মঞ্চ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
লালবাজার অভিযান
২ সেপ্টেম্বর: কলকাতা পুলিশ কমিশনারের ইস্তফা চেয়ে মিছিল করে লালবাজার অভিযান জুনিয়র ডাক্তারদের। লালবাজারের দু-শো মিটার আগেই ব্যারিকেড করে আটকে দেওয়া হয় তাদের। সেখানেই অবস্থান শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। অবস্থান তার পরের দিন পর্যন্ত চলে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পুলিশ কমিশনারের কাছে
৩ সেপ্টেম্বর: জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে দেখা করেন। দাবিসনদ-সমেত তার হাতে তুলে দেন একটি ‘প্রতীকী শিরদাঁড়া’।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান শুরু
১০ সেপ্টেম্বর: সলটলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকের জন্য তাদের নবান্নে ডাকেন। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে। লাইভ স্ট্রিমিং না হওয়ায় সেই বৈঠক ভেস্তে যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চে
১৪ সেপ্টেম্বর: হঠাৎ করেই সবাইকে চমকে দিয়ে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্দীপ ঘোষ গ্রেপ্তার
১৪ সেপ্টেম্বরে: ধর্ষণ-খুনের ওই মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আদালতে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিতে না পারায় সন্দীপ এবং অভিজিৎ দু’জনেই জামিন পান। অভিজিতের জেলমুক্তি হলেও সন্দীপ এখনও জেল হেফাজতে রয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সরানো হলে পুলিশ কমিশনারকে
১৪ সেপ্টেম্বর, দুই দিনের ব্যর্থ চেষ্টার পর মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক হয়। সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াই এই বৈঠকে রাজি হন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেখানে খানিক ‘পিছু হটে’ সরকার। সরানো হয় পুলিশ কমিশনার বিনীতকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কর্মবিরতি উঠলো
২০ সেপ্টেম্বর: স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান তুলে কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আমরণ অনমশন শুরু
৫ অক্টোবর: ধর্মতলার মোড়ে আমরণ অনশন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সাত জুনিয়র ডাক্তারের পাশাপাশি বহু মানুষ অনশন মঞ্চে এসে প্রতীকী অনশনে অংশ নেন। ১৯ অক্টোবর অনশন মঞ্চে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ আসেন এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ফোনে কথা বলান। ২১ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দুই ঘণ্টার বৈঠকের পর ১৭ দিনের দীর্ঘ অনশনের অবসানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিবিআইের চার্জশিট
৭ অক্টোবর: ধর্ষণ ও খুনের মামলায় আদালতে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। কলকাতা পুলিশ যে পথে তদন্ত শুরু করেছিল, সিবিআইও সেই পথে হেঁটেই একজনকেই অভিযুক্ত হিসেবে দাড় করায়। ৪ নভেম্বর ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয় এবং ১১ নভেম্বর থেকে শিয়ালদহ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিচার শুরু
১১ নভেম্বর: আরজি কর মামলায় মোট ৫০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে শিয়ালদহ আদালতে। সেই তালিকায় রয়েছেন নিহত চিকিৎসকের পিতা, সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার, কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী অফিসার, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং নিহতের কয়েক জন সহপাঠী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রায় দিলেন বিচারক
১৮ জানুয়ারি: শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বান দাস রায় দিলেন। খুন এবং ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো সঞ্জয় রায়কে। আদালতে বিচারক অনির্বাণ দাস সঞ্জয়কে বলেন, আপনার বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ। আপনার অপরাধ প্রমাণিত। দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এই অপরাধে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাজা যাবজ্জীবন কারাবাস। সোমবার সাজা ঘোষণা করা হবে। সঞ্জয় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি নির্দোষ, তাকে ফাঁসানো হচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
16 ছবি1 | 16
আন্দোলনের এক বছর
আন্দোলন, প্রতিবাদ কলকাতা শহরে নতুন নয়। তবে গত অগাস্টে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন চরিত্রগত ভাবে আলাদা। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমেছিলেন এই ঘটনার বিচার চাইতে। অভয়া হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিমবঙ্গবাসীর 'ঘরের মেয়ে'। সেই আঁচ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও। প্রায় দুমাস লাগাতার আন্দোলন চলার পরে থিতিয়ে পড়ে সেই প্রতিবাদের তেজ।
তবে কি আন্দোলন ব্যর্থ? আরজি কর ঘটনার ১০ মাসের মধ্যে সেই কলকাতার বুকে দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজেফের বীভৎস ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসে। সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এই আন্দোলনের কোনো প্রভাবে নেই? মানুষের ক্ষোভ কি ধামাচাপা পরে গেল? অভয়ার মায়ের দাবি, এমন কিছুই হয়নি। "কোনো রাগ কমেনি। কিছু মানুষ হতাশ। সবারই তো কাজ আছে। কেউ হয়তো ভাবছেন আর কিছুই হবে না। কী হবে লড়াই করে, কিছুই তো হলো না। এক বছরে কেটে গেলো কোনো অপরাধী ধরা পড়লো না। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে তদন্ত হয় আমার মেয়ের ক্ষেত্রে সেভাবে তদন্তই হয়নি।"
এই আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা জুনিয়র ডাক্তার মঞ্চের দেবাশিস হালদার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "এরকম একটা আন্দোলনকে সফল বা ব্যর্থ বলার মূল্যায়নে আমি রাজি না। একটা সরকারি হাসপাতালের এক জুনিয়র ডাক্তার কলকাতার ব্যস্ততম অঞ্চল শ্যামবাজারের কাছে নিজের কলেজের সেমিনার রুমে নির্যাতিতা হলেন। এই রাগে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। অভয়ার বিচার চেয়েছিলেন। ব্যর্থতা যদি থেকে থাকে তাহলে তা রাষ্ট্রের। তারা অভয়াকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বাবা মাকে এখনো বিচার দিতে পারেনি।"
বিজ্ঞাপন
এক বছর পরে ৯ অগাস্ট
অভয়া ধর্ষিতা হয়ে খুন হন ৮ অগাস্ট মধ্যরাতের পর। খবর সামনে আসে ৯ অগাস্ট। কলকাতায় এই দুই দিন জুড়ে রয়েছে লাগাতার কর্মসূচি। শনিবার কলেজ স্কোয়ার থেকে শ্যামবাজারে আরজি কর পর্যন্ত হবে মিছিল। হাসপাতাল চত্বরে সারা রাত জাগবেন জুনিয়র ডাক্তাররা। উপস্থিত থাকবেন অভয়ার বাবা মা। রোববার নবান্ন অভিযানে যাবেন তারা। অভয়া মঞ্চের পক্ষ থেকে এদিন হাজরা মোড়ে জমায়েত। সেখান থেকে কালীঘাটের উদ্দেশ্যে মিছিল করবেন তারা।