আরজি কর-কাণ্ডের পর স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে কলকাতা-সহ দেশজুড়ে নিরাপত্তার দাবিতে পথে নামছেন নারীরা।
বিজ্ঞাপন
এই আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছে 'মেয়েরা রাত দখল করো'। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী রিমঝিম প্রথমে ফেসবুকে মেয়েদের পথে নামার ডাক দেন। তিনি বলেছিলেন, কলকাতার যাদবপুরে এইট বি বাসস্ট্যান্ডের সামনে জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ জানানোর জন্য।
সেই পোস্ট ভাইরাল হয়। এখন কলকাতার প্রায় তিনশ'টি জায়গায় মেয়েদের রাত দখলের ডাক দেয়া হয়েছে। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই সর্বত্র এই ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বত্রই বলা হয়েছে, রাত সাড়ে এগারোটায় জমায়েত হয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে। সামাজিক মাধ্যমের পোস্টারে বলা হচ্ছে, স্বাধীনতার মধ্যরাতে নারী স্বাধীনতার জন্য এই জমায়েত। বলা হচ্ছে, 'জাস্টিস ফর আরজি কর'। সারারাত তাদের বিক্ষোভ দেখানোর কথা।
এই জমায়েতে কোনো দলের পতাকা থাকবে না, কোনো দলের প্রতীক থাকবে না বলে জানানো হয়েছে। রিমPfম সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ''কোনো ঘটনা ঘটলে কলকাতা তো প্রতিবাদের বার্তা দেয়। সেই বাবনা থেকে পোস্ট দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, পরিচিতজনেরা আসবেন। সেটা যে এরকম আকার নেবে ভাবিনি।''
'রিক্লেম দ্য নাইট'
এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যের লিডসে, নারী স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসাবে। সেসময় উত্তেজনার পর পুলিশের পরামর্শ ছিল, মেয়েরা যেন রাতে বাড়ি থেকে বাইরে না বেরোয়। তারই প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল, মেয়েদের রাত দখলের আন্দোলন।
অ্যামেরিকাতেও গত শতকের সাতের দশকে একটি নারীপন্থি সংগঠন এই আন্দোলনের ডাক দেয়।
আরজি কর হাসপাতালে ডাক্তারকে ধর্ষণ-খুন, রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন
আরজি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুন। এক সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ধৃত। অধ্যক্ষের ইস্তফা। বিক্ষোভে বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাসপাতালের ভিতরেই ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন
আরজি কর হাসপাতাল হলো উত্তর কলকাতার কেন্দ্রে। সেখানেই নাইট ডিউটির পর এক নারী জুনিয়র ডাক্তার হাসপাতালের চারতলায় সেমিনার রুমে গেছিলেন পড়াশুনো ও বিশ্রাম করতে। সেখানেই ধর্ষণের পর খুন করা হয় তাকে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ গোটা পশ্চিমবঙ্গ। মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন । প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ, প্রশাসন ও হাসপাতাল প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অভিযুক্ত গ্রেপ্তার
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিয়োগে পুলিশ সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে। সিসিটিভির ফুটেজ ও ঘটনাস্থলে পাওয়া তার হেডফোন থেকে পুলিশ সঞ্জয়কে চিহ্নিত করে ও গ্রেপ্তার করে। ঘটনার রাতে সে আরজি কর-এ ছিল। বাইরে থেকে মদ খেয়ে গভীর রাতে সে হাসপাতালে ঢোকে এবং সেমিনার হলে চলে যায়। সেখানেই সে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা করে বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অভিযুক্তকে নিয়ে তোলপাড়
সঞ্জয় রায় ছিল সিভিক ভলান্টিয়ার। তাদের কাজ হলো পুলিশকে সহায়তা করা, মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। এখানে নিরাপত্তা দেয়া দূরস্থান, সে এই নৃশংস কাজ করেছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ কমিশনার অবশ্য এই পেশার বিষয়টি এড়িয়ে বলেছেন, পরিবার চাইলে অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত করাতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী একই কথা বলেছেন। তবে তিনি সিবিআই তদন্তের অনুরোধ জানাননি। নিয়ম হলো, আদালত এই নির্দেশ দিতে পারে বা মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করতে পারেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাসপাতালে নিরাপত্তা কোথায়?
ভয়ঙ্কর এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি ধর্ষণ ও খুন করা হয়, তাহলে তো মেনে নিতে হবে, সেখানে কোনো নিরাপত্তাই নেই। কী করে অভিযুক্ত সেমিনার হলে গেল? কেন তাকে আটকানো হয়নি? কী করে তার অবাধ গতিবিধি ছিল? কেন সেমিনার রুমের ভিতর সিসিটিভি ক্যামেরা নেই?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদ, আন্দোলন
এই ঘটনার প্রতিবাদে আরজি কর, ন্যাশনাল মেডিক্যাল, কলকাতা মেডিক্যাল ও এনআরএসে জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করছেন। তারা জরুরি বিভাগের পরিষেবাও বন্ধ রেখেছেন। তাদের চার দফা দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে তারা জানিয়ে দিয়েছেন। জেলার হাসাপাতালের চিকিৎসকরাও আন্দোলন শুরু করেছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দাবি মেনে অপসারণ, অধ্যক্ষের ইস্তফা
আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ''পড়ুয়ারারা আমার ইস্তফা চেয়েছিলেন। আমায় নানা কটূক্তি করা হয়েছে। আশা করি এবার জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্র-ছাত্রীরা কাজে ফিরবেন।'' তবে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে ধর্ষিতার নাম নিয়ে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এর আগে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে এসিপি নর্থকে সরিয়ে দেয় সরকার।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলছে
আন্দোলনকারীদের দুইটি দাবি মানা হলেও ময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি মানা হয়নি। ফলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনের পরিধি বাড়ছে। আন্দোলনরতরা জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো দলের পতাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা যাবে না। কোনো নেতা এলে দলীয় পতাকা, স্লোগান ছাড়া আসতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অভিযুক্তের ফাঁসি দাবি
আন্দোলনকারীরা দাবি করেছেন, দোষীকে ফাঁসি দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিনিও চান দোষীর সর্বোচ্চ সাজা হোক। পুলিশ কমিশনারও সর্বোচ্চ সাজা চাইছেন। তা সত্ত্বেও পুলিশের ভূমিকার প্রবল সমালোচনা চলছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও একই দাবি করেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অপর্ণা সেনের প্রশ্ন
অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ''পুলিশ কী করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারে? তারা কী করে রক্তক্ত দেহ দেখার পরও বললো আত্মহ্যার ঘটনা?'' তার দাবি, ''পুলিশের ভূমিকা সন্দেহমুক্ত নয়। তার তদন্ত করতে হবে।''
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের আবেদন
কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে ফেসবুক পোস্ট করে সবাইকে তাদের উপর ভরসা রাখার আবেদন জানানো হয়েছে। তাদের দাবি, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে তদন্ত হচ্ছে। কলকাতা পুলিশ দ্রুত চার্জশিট দিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে বলেও জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোববারের মধ্যে কিনারা না হলে তিনি সিবিআই তদন্তের অনুরোধ জানাবেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দলগুলির বিক্ষোভ চলছে
বিরোধী দলগুলিও ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেমেছে। বাম ছাত্র-যুব নেতারা আরজি কর-এ গেছিলেন। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়েছে।বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পালও আরজি কর-এ যান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাড্ডাকে অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন আরজি কর হাসপাতালের পরিকাঠামো খতিয়ে দেখেন। তিনি সিবিআই তদন্তের দাবিও করেছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চার ডাক্তারকে নোটিশ
পুলিশ চার ডাক্তারকে নোটিশ পাঠিয়েছে। তারা ধর্ষিতা ও খুন হয়ে যাওয়া নারী চিকিৎসকের সঙ্গে নৈশভোজ করেছিলেন। অ্যাপের মাধ্যমে তারা কাবার আনিয়েছিলেন। ওই চারজনের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক একজন হাউসস্টাফ। এই ধর্ষণ ও হত্যার পিছনে আর কারো হাত আছে কিনা, তা পুলিশ খতিয়ে দেখতে চাইছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে
কলকাতার সরকারি হাসপাতালের নৈরাজ্য, দালালরাজ, অব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে কোনো গোলমাল হলে হইচই শুরু হয়। তারপর পরিস্থিতি আবার আগের চেহারায় পিরে যায় বলে অবিযোগ। এর মধ্যে গত জুলাইতে সিবিক ভলেন্টিয়াররা রোগীর আত্মীয়কে বেধড়ক মারধর করেছিলেন। তা নিয়ে হইচই হলেও এই সিভিক ভলেন্টিয়ারদের প্রতাপ কম হয়নি বলে রোগীর আত্মীয়রা অভিযোগ করেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
সুখেন্দু শেখর রায়ও প্রতিবাদে
তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় প্রথমে বলেছিলেন, তিনি মেয়েদের প্রতিবাদে সামিল হবেন। কারণ তারও এক কন্যা ও নাতনি আছে। মেয়েদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট নৃশংসতা হয়েছে। সকলে মিলে তা প্রতিহত করতে হবে।
এরপর বিজেপি আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় কটাক্ষ করে বলেন, এ সবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরোনো পরিচিত খেলা।
এরপর সুখেন্দু শেখর বলেছেন, ''বিজেপি-র আইটি সেল চরিত্র হনন করতে উদ্য়োগী হয়েছে। আমি তাই একা প্রতিবাদ জানাবো। আরজি করের ঘটনার যারা প্রতিবাদ করছেন, তাদের প্রতি আমার সমর্থন জানিয়ে আমি বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত যোধপুর পার্কে নেতাজি মূর্তির সামনে বসে থাকব। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় নিজের সরকারকে বর্বরোচিত বলে নিজে ধরনা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি।''
তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া
তৃমমূলের নেতা কুণাল ঘোষ এবং দেবাংশু ভট্টাচার্য দেবের অভিযোগ, এই আন্দোলন আসলে বকলমে বাম ও বিজেপি-র আন্দোলন। তার ফাঁদে না পড়ার জন্য তারা আবেদন জানিয়েছেন।
কুণাল বলেছেন, ''সিপিএম, বিজেপি-র বকলমা ইভেন্টে যাবেন না।'' দেবাংশু বলেছেন, ''লাল হায়েনারা কিন্তু হাইজ্যাক করার অপেক্ষায় বসে আছে।''
বামেরাও আন্দোলনে পথে নেমেছে। আরজি করে বাম ছাত্র-যুবরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।
দিল্লিতেও সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তাররা মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালন করেছেন। তারা স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, আরজি করের ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করে দোষাীদের শাস্তি দিতে হবে।