আরব আমিরাতে প্রাক-ইসলাম যুগের খ্রিস্টান মঠের সন্ধান
৬ নভেম্বর ২০২২সিনিয়াহ দ্বীপের মঠটি পারস্য উপসাগরের তীরে প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে নতুন দিশা দেখাল৷ উম আল-কুওয়াইনের শেখডমের অংশ সিনিয়াহ৷ আমিরাতে পাওয়া দ্বিতীয় মঠ এটি৷ প্রায় এক হাজার ৪০০ বছরের মঠটি যখন তৈরি হয়, তখন মরুভূমির বিস্তার ঘটেনি৷ এখনকার মতো সমৃদ্ধ তেল শিল্পের সূচনাও হয়নি৷ আবুধাবি এবং দুবাইয়ের আকাশছোঁয়া অট্টালিকা তখন কল্পনার বাইরে ছিলো৷
সময়ের ইতিহাসের কাছে হারিয়ে গিয়েছে দুটি মঠ৷ পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন, খ্রিস্টানরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্ম নেন৷ ইসলাম পরবর্তীতে অনেক বেশি প্রচলিত হয়৷
আজ খ্রিস্টানরা বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংখ্যালঘু৷ এরই মাঝে পোপ ফ্রান্সিস বৃহস্পতিবার মুসলিম নেতাদের সঙ্গে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রচারের জন্য নিকটবর্তী বাহরাইনে গিয়েছেন৷
সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের সহযোগী অধ্যাপক টিমোথি পাওয়ার এই মঠ আবিষ্কারের কাজে যুক্ত৷ তার কথায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘একটি জাতির গলিত পাত্র'৷
তার কথায়, ‘‘হাজার বছর আগে এখানে অসাধারণ কিছু ঘটেছিল৷ সেই কথা জানা প্রয়োজন৷''
মঠটি সিনিয়াহ দ্বীপে অবস্থিত৷ এটি উম্ম আল-কুওয়াইনের খোর আল-বেইদা জলাভূমিকে রক্ষা করে৷ পারস্য উপসাগরের উপকূল বরাবর দুবাই থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩০ মাইল) উত্তর-পূর্বের আমিরাত দ্বীপ এটি৷
এর নামের অর্থ হল ‘ফ্ল্যাশিং লাইট', সম্ভবত তপ্ত সূর্যের প্রভাবের কারণ এই নাম৷ বালির স্তূপের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ে মরুভূমিতে৷ দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মঠটি খুঁজে পেয়েছেন৷
৫৩৪ এবং ৬৫৬ সালের মধ্যে মঠের ভিত্তিতারিখে নমুনার কার্বন ডেটিং করা হয়েছে৷ ইসলামের নবী মোহাম্মদ (সা:) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ সালে৷ বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা জয় করার পর ৬৩২ সালে মৃত্যু হয় তার৷
উপর থেকে দেখা গেলে বোঝা যাবে, সিনিয়াহ দ্বীপে খ্রিস্টান উপাসকরা চার তলার মঠের একটি একক ঘরের গির্জার মধ্যে প্রার্থনা করতেন৷ ভিতরের কক্ষগুলিতে ব্যাপটিজমাল হরফ রয়েছে৷ রুটি বেক করার জন্য একটি চুলা বা গোষ্ঠীবদ্ধ রীতিপালনের জন্য ওয়েফার রয়েছে৷ একটি বেদিও ছিল সেখানে৷ গির্জার মূল অংশে ওয়াইনের জন্য একটি ইনস্টলেশনও ছিল৷
মঠের পাশে চারটি ঘরের দ্বিতীয় ভবন রয়েছে৷ সম্ভবত চারপাশে মঠের উঠান ছিল৷ অনুমান করা হচ্ছে, গির্জা বা মঠের প্রথম বিশপের বাড়ি ছিল এটি৷
বৃহস্পতিবার সংযুক্ত আমিরাতের সংস্কৃতি ও যুব মন্ত্রী নওরা বিনত মোহাম্মদ আল-কাবি এবং উম্ম আল-কুওয়াইনের পর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান, আমিরাতের শাসকের ছেলে শেখ মজিদ বিন সৌদ আল মুল্লা এটি পরিদর্শন করেন৷
দ্বীপটি শাসক পরিবারের সম্পত্তির অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে৷ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশিরভাগ অংশ দ্রুত বিকশিত হয়েছে৷ তাই এই জায়গাগুলি দ্রুত আবিষ্কার করে সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে৷
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংস্কৃতি মন্ত্রক এই খননকাজে অর্থায়ন করেছে৷ খননের কাজ এখনো চলছে৷ প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন, গির্জা থেকে মাত্র কয়েকশ মিটার (গজ) দূরে, ভবনগুলি প্রাক-ইসলামি গ্রামের অংশ ছিল৷
দ্বীপের অন্য অংশে কাছাকাছি একটি গ্রামও রয়েছে, যেটিকে ব্রিটিশরা ১৮২০ সালে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল৷ এই অঞ্চলটি ট্রুশিয়াল স্টেটস নামে পরিচিত ছিল৷ এটিকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সূচনা বলা যায়৷ সেই গ্রামের ধ্বংসলীলা মূল ভূখণ্ডে উম আল-কুওয়াইনের আধুনিক কাঠামো তৈরি করেছে৷
ইতিহাসবিদরা বলেছেন, শুরুর দিকের গির্জা এবং খ্রিস্টান মঠগুলি পারস্য উপসাগর বরাবর বর্তমান ওমানের উপকূল এবং ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল৷ প্রত্নতাত্ত্বিকরা বাহরাইন, ইরাক, ইরান, কুয়েত এবং সৌদি আরবে অনুরূপ গির্জা এবং মঠ খুঁজে পেয়েছেন৷
নয়ের দশকের গোড়ার দিকে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম খ্রিস্টান মঠটি স্যার বানি ইয়াস দ্বীপে আবিষ্কার করেন৷ এটি আজ সৌদি সীমান্তের কাছে আবু ধাবির উপকূলে একটি প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং বিলাসবহুল হোটেলের জন্য বিখ্যাত৷ উম আল-কুওয়াইনে আবিষ্কৃত মঠের সময়কালেই সেটি তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা৷
উম আল-কুওয়াইনের খোর আল-বেইদা জলাভূমির প্রাথমিক জীবনের প্রমাণটি নিওলিথিক যুগের৷ পাওয়ার বলেন, অন্তত ১০ হাজার বছর ধরে এই এলাকায় মানুষের বসবাস ছিল৷
জলাভূমির কাছাকাছি এলাকাটি আমিরাতের বারাকুডা বিচ রিসোর্টে কম দামের মদের দোকানের জন্য বেশি পরিচিত৷ সাম্প্রতিক মাসগুলিতে, কর্তৃপক্ষ ‘মৃত্যুর বণিক' নামে পরিচিত একজন রাশিয়ান বন্দুকবাজের সঙ্গে যুক্ত একটি সোভিয়েত-যুগের কার্গো প্লেন ধ্বংস করতে বাধ্য হয়েছে৷ কারণ এটি ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে রিয়েল এস্টেট উন্নয়নের জন্য সিনিয়াহ দ্বীপে একটি সেতু তৈরি করছে৷
পাওয়ার বলেন, উন্নয়ন প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকে উত্সাহ দেয়ায় মঠটি আবিষ্কার করা গিয়েছে৷ এলাকাটিকে ঘিরে ফেলে সুরক্ষিত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি৷ তার কথায়, অতীতের কোন রহস্যগুলি দ্বীপের বালির পাতলা স্তরের নীচে লুকিয়ে রয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়৷
তার কথায়, ‘‘এটি সত্যিই একটি আকর্ষণীয় আবিষ্কার, কারণ এটি গুপ্ত এক ইতিহাস৷ এটির কথা ব্যাপক অর্থে সবাই জানেন না৷''
আরকেসি/জেডএইচ (এপি)