এলাকার অধিকাংশ হর্তাকর্তা সন্ত্রাস, সহিংসতা ও স্থিতিহীনতা থেকে লাভবান হচ্ছেন৷ এর ফলে শাসকরা অত্যাবশ্যক সংস্কার রুখে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখতে সচেষ্ট – বলে রাইনার সলিচের অভিমত৷
বিজ্ঞাপন
তিন বছর আগে যখন ‘আরব বসন্ত' শুরু হয়, তখন জনতার মুখ্য দাবি ছিল সরকার বদল৷ কায়রো, দামেস্ক কিংবা বেনগাজিতে আন্দোলনকারীরা মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, ক্ষমতায় অংশগ্রহণ এবং নিপীড়নের অন্ত ঘটানোর দাবিতেও পথে নেমেছিলেন৷ কিন্তু শেষমেষ ব্যাপারটা শুধু সরকারি ক্ষমতা দখল কিংবা বজায় রাখার প্রশ্নে পর্যবসিত হয়: জনতা চায় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে; সরকার সর্বশক্তি দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করে৷
এই দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হয়েছে বিভীষণ: ক্ষমতাসীনরা প্রায় সর্বত্র টিকে গেছেন; আর যেখানে তারা ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, সেখানকার মানুষদের অবস্থা আরো শোচনীয়৷ সিরিয়া আর ইরাকের কথা বাদ দিলেও, লিবিয়া কিংবা ইয়েমেন'এরও ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবার শঙ্কা আছে৷ অপরদিকে আইসিস, আল কায়েদা কিংবা অপরাপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেন আগের চাইতে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং দৃশ্যত সহজেই নতুন রংরুট সংগ্রহ করতে পারছে৷
নড়বড়ে সীমারেখা
পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিরা এককালে নিজেদের মর্জি অনুযায়ী যে সব সীমান্ত এঁকে দিয়েছিল, সেই সব সীমানা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠেছে৷ ইরাক কিংবা সিরিয়া'কে আজ আদৌ ‘‘রাষ্ট্র'' বলা চলে কিনা, তা নিয়েই দ্বিধা প্রকাশ করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা৷ দৃশ্যত গোটা আরব বিশ্ব চলেছে উল্টোপথে: আরব বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র দেখলে সেটা উপলব্ধি করা যায়৷ একদিকে সেই সব রাষ্ট্র, যেখানে সন্ত্রাস, যুদ্ধবিগ্রহ, দেশবিভাগ চলেছে; অন্যদিকে মিশর কিংবা বিভিন্ন উপসাগরীয় দেশের মতো সেই সব একনায়কতন্ত্র, যারা ক্রমেই আরো বেশিভাবে নিপীড়নের উপর নির্ভর করে শাসন চালাচ্ছে৷ কাজেই একটি মান্ধাতার আমলের অপবাদ আবার নতুন করে ধ্বনিত হচ্ছে: আরব জনতা নাকি গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়৷
গণতন্ত্রে অপারগ?
এই ‘‘যুক্তি'' যেমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ, তেমন জাতিবাদী৷ তবে এ'কথাও ঠিক যে, সুপ্রাচীন রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো'র দরুণ অধিকাংশ আরব দেশে আজ গণতন্ত্রীকরণ ও আধুনিকীকরণের উপযোগী পরিবেশ নেই৷ যে শ্রেণির কল্যাণে ইউরোপে সামাজিক পরিবর্তন এসেছিল, আরব বিশ্বের বহু দেশে সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্যক বিকাশ ঘটেনি৷ আরব শিক্ষাপদ্ধতি সাবেক আমলের এবং আধুনিক যুগের দাবিদাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেনি - এমনকি ধনী উপসাগরীয় দেশগুলিতেও নয়৷
আইএস বিরোধী লড়াইয়ের আঁচ জার্মানিতে
গত জুন মাসে ইরাকের মোসুল দখল করে নেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস বা আইসিস)৷ চরমপন্থি ইসলামি সংগঠনটির লক্ষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের একটা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ এদিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আঁচ লেগেছে জার্মানিতেও৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
জার্মানিতে সংঘর্ষ
সুদূর ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের তৎপরতার আঁচ জার্মানিতেও দেখা যাচ্ছে৷ উত্তরের হামবুর্গ ও সেলে শহরে মঙ্গলবার (০৭.১০.১৪) কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে উগ্রপন্থি মুসলমানদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Markus Scholz
গনসচেতনতার উদ্যোগে বাধা
জার্মানিতে বসবাসরত কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়াতে গত কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করেছে৷ কখন উগ্রপন্থিরা তাদের বাধা দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/Alexander Koerner
কোবানিতে তীব্র লড়াই
এদিকে সিরিয়ার কোবানি বা আইন আল-আরব শহরে আইএস জঙ্গিদের ব্যাপক হামলা চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে এক লাখেরও বেশি সিরীয় কুর্দি এলাকা ছেড়েছে৷ অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ তুরস্কে৷ আইএস জঙ্গিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দিদের আধা সামরিক বাহিনী ওয়াইপিজি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/SEDAT SUNA
আপাতত রক্ষা
কুর্দি এই নারী তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে আইন আল-আরব থেকে পালিয়ে এসেছেন৷ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহরটিতে আইএস-এর হামলা তীব্র হওয়ার পরপরই তাঁরা তুরস্কে আশ্রয় নেন৷
ছবি: DW/Alice Martins
আতঙ্ক
তখনও আইন আল আরব সীমান্তে চলছে তীব্র লড়াই৷ এই কুর্দি পরিবার আইন আল-আরব থেকে এসে তুরস্কের সীমান্তে অপেক্ষা করছে৷ ইরাকে কুর্দি নারীদের আইএস যেভাবে তুলে নিয়ে বিক্রি করেছে, তাড়াতাড়ি পালাতে না পারলে তাঁদেরও একই পরিণতি হতে পারে এই আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাঁদের৷
ছবি: DW/Alice Martins
অসহায়ত্ব
তুরস্কেও ভালো নেই আইন আল-আরব ছেড়ে আসা কুর্দিরা৷ খাবারদাবার, এমনকি খাওয়ার পানিও ঠিকমতো জোটে না৷ একটি সংগঠন তাই চাঁদা তুলে পানির বোতল কিনে এনে বিতরণ করছে শরণার্থীদের মাঝে৷
ছবি: DW/Alice Martins
দীর্ঘ অপেক্ষা
প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন একজন৷ আইন আল-আরব ছেড়ে আসা সিরীয়দের সে খাবারগুলো দিতে চান৷ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে্ তুরস্কের সেনাবাহিনী৷ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে৷ ওদিকে খাবারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে শরণার্থীরা৷
ছবি: DW/Alice Martins
যাত্রী চাই
সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুর্কি সরকার৷ এক মিনিবাস চালক তাই যাত্রীর অপেক্ষায়৷ শরণার্থীদের কেউ যদি তাঁর মিনিবাসে ওঠেন, তাতে নিজের তো সামান্য কিছু আয় হবেই, শরণার্থীদেরও উপকার হবে৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ সিরীয় তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে৷
ছবি: DW/Alice Martins
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইএস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইএস বা আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইএস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ আর ইরাকে নুরি আল-মালিকির সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট বিদ্রোহীদেরই পাশে ছিল৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে৷ তবে ওবামা সরকার এখন আইএস-এর বিরুদ্ধে৷ জঙ্গি সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Matthew Bruch
এবার আইন আল-আরব?
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আইন আল-আরব সাধারণের কাছে ‘কোবানি’ নামেই পরিচিত৷ তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের এ শহরের একটা অংশ এখন আইএস-এর দখলে৷ এবার কি তবে আইন আল-আরবও দখল করে নেবে আইএস? তারপর?
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে, সেই অনুপাতে অর্থনৈতিক সংস্কার হয়নি, কাজেই কর্মবিহীন, ভবিষ্যৎবিহীন এবং আশাবিহীন তরুণ জনতার কোনো অভাব নেই৷ এই পরিস্থিতিতে ধর্ম এবং জাতিগত সত্তাই মানুষকে উগ্রপন্থি করে তোলার, কিংবা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার শ্রেষ্ঠ পন্থা হয়ে ওঠে৷ এ'থেকে শুধু চরমপন্থি এবং সন্ত্রাসবাদিরাই নয়, কর্তৃত্ববাদি আরব শাসকবর্গও উপকৃত হন: সন্ত্রাস এবং হিংসা শাসকবর্গের ক্ষমতায় থাকার যুক্তি সরবরাহ করে৷
আরব বিশ্বের ক্রমান্বয় অবনতির কারণ আরব জনতা, তাদের জাতি ও সম্প্রদায়গত বিভাজন কিংবা তাদের ধর্মবিশ্বাস নয়৷ আরব বিশ্বের মূল সমস্যা হলো যারা বহু দশক যাবৎ দেশ শাসন করে আসছে, তাদের সংস্কারে অনীহা৷ এক্ষেত্রে টিউনিশিয়া কিংবা মরক্কো'র মতো মাত্র কয়েকটি দেশে সংস্কারের আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে৷ বাদবাকি নৃপতি, আমির এবং প্রেসিডেন্টরা তাদের ক্ষমতাকে সেকেলে কাঠামোর মধ্যেই ধরে রাখতে আগ্রহী৷ এরা যেমন ইসলামপন্থি, তেমনই উদারপন্থি ও গণতান্ত্রিক শক্তিদের দমন করে থাকেন৷ ফলে সৃষ্টি হয় নতুন অসন্তোষ, নতুন হতাশা এবং পরের আরব বসন্ত কিংবা বিপ্লবের আশা অথবা আশঙ্কা৷