একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘রাজাকার ' ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যাসহ পাঁচটি অভিযোগের বিচার করে আদালত৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এই রায় ঘোষণা করেন৷ অন্য দু'জন সদস্য হলেন – বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক৷ রায়ে বলা হয়, মোবারকের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷
এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার টানমান্ডাইল গ্রামের ৩৩ জনকে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী আব্দুল খালেককে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷ তবে অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মোবারককে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷
প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান রায়ের পরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘দুটি অভিযোগে মোবারক দোষী প্রমাণিত হয়েছে৷ আমরা সন্তুষ্ট৷ সে যে রাজাকার ছিল – এটি আমরা সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে বোঝাতে পেরেছি৷'' ওদিকে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ৷
একাত্তরে মোবারক ও তার সহযোগীদের হাতে নিহত আব্দুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম ২০০৯ সালের ৩রা মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে মামলা করেন৷ ঐ মামলায় মোবারক আগাম জামিন নিলেও, ২০১২ সালের ৬ই জুন যুদ্ধাপরাধের মামলাটি ট্রাইব্যুনালে আসার পর, তদন্ত শেষে গত বছর অভিযোগ দাখিল করা হয়৷ এরপর ১২ই মার্চ ট্রাইব্যুনাল তার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠায়৷ পরে মামলার সাক্ষী এবং যুক্তি-তর্ক শেষে চলতি বছরের ২রা জুন মামলার বিচারকাজ শেষ হয়৷
একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি বৃহস্পতিবার রাতে কার্যকর করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো৷ মোল্লার ফাঁসি নিয়ে তৈরি আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
অবশেষে ফাঁসি
৪৮ ঘণ্টা ধরে নানা নাটকীয় পরিস্থিতির পর ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাতে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ এর আগে মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে বিচারকের নির্দেশে তা স্থগিত হয়৷ মোল্লাকে এভাবে ফাঁসি না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, জার্মানি সহ অন্যান্যরা৷
ছবি: picture-alliance/AA
শেষ দেখা
বৃহস্পতিবার ফাঁসির রায় কার্যকরের কিছুক্ষণ আগে কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরিবারের সদস্যরা৷ এসময় জেলগেটে কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বলেন, ‘‘ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই আমার পিতাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Reuters
গ্রেপ্তার, দম্ভোক্তি
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০০৮ সালে ঢাকার একটি থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা৷ পরবর্তীতে কারাগারে দাঁড়িয়ে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘বাংলাদেশ হয়েছে বলে অনেকের মাতব্বরি বেড়ে গেছে৷’’
ছবি: Reuters
যত অভিযোগ
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট ৬টি অপরাধ বিবেচনায় নেয়া হয়৷ এগুলো হলো পল্লবি এলাকার গণহত্যা, কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালিব হত্যা, কেরানীগঞ্জের ভাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড, আলুব্দি গণহত্যা এবং মিরপুরের হযরত আলি পরিবারে গণহত্যা৷ এর সঙ্গে লুটতরাজ, ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগও আছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Archiv Rowshan Jahan Shathi
প্রথমে যাবজ্জীবন, পরে মৃত্যুদণ্ড
ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে কাদের মোল্লার অপরাধ প্রমাণিত হয়৷ এর প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে৷ সেসময় কাদের মোল্লা আদালত থেকে বের হওয়ার সময় ‘বিজয় চিহ্ন’ দেখান৷ এতে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ পরবর্তীতে আপিলের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
দাফন সম্পন্ন
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদুপরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।’’
ছবি: Mustafiz Mamun
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সৃষ্টি হওয়া শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে আবারো ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ৷ মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সেখানে উপস্থিত জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে৷
ছবি: Reuters
‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো’’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো৷ ৪২ বছর পরে হলেও একজন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর হলো৷’’ তিনি আশা করেন, সব যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডই কার্যকর হবে৷
ছবি: privat
জার্মানির প্রতিক্রিয়া
এর আগে, বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
৬৪ বছর বয়সি মোবারক একাত্তরে আখাউড়ার রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসনের তৈরি রাজাকারের তালিকাতেও তার নাম রয়েছে৷
একাত্তর পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করলেও, পরে মোবারক স্থানীয় আওয়ামী লীগে যোগ দেয়৷ ২০১১ সালে অবশ্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে৷
এ পর্যন্ত মোট ১২ জনের ফাঁসির দণ্ড
২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়৷ ২০১৩ সালের ২১শে জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচচু রাজাকারের ফাঁসির রায় দেয়া হয়৷ তিনি এখনও পলাতক৷
এরপর পর্যায়ক্রমে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলেও, উচ্চ আদালত তাঁকে ফাসির দণ্ড দেয়, যা কার্যকর হয়েছে ইতিমধ্যেই৷
জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালত তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়৷
জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার এই দণ্ড বহাল আছে৷
জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ সেই দণ্ড মাথায় নিয়েই মারা যায় গোলাম আযম৷
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসির দণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷