চলতি বছর ইতোমধ্যে চারজন ব্লগার খুন হয়েছেন৷ নিয়মিত বিরতিতে ধীরে সুস্থে, বাছাই করে, অনুসরণ করে, মোক্ষম সময়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে৷ এভাবে কি আরো একটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে?
বিজ্ঞাপন
পরপর চারজন ব্লগার খুন হওয়ার পর গোটা বিশ্বেই আলোড়ন উঠেছে৷ বাংলাদেশ নামক মুসলিম অধ্যুষিত দেশটি আগে পরিচিত ছিল জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির শিকার একটি দেশ আর তৈরি পোশাক শিল্পের ‘হাব' হিসেবে৷ এখন পরিচিত হচ্ছে উগ্রপন্থিদের আখড়া হিসেবে৷ যেখানে যে কারো গলা কাটার অধিকার আছে তাদের৷
ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পরই খুনিদের বিচারের দাবি উঠেছিল চারিদিক থেকে৷ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন মার্কিন নাগরিকের হত্যা স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল৷ কিন্তু সেই ভাবনা উদ্বেগে পরিণত হতে বেশি দেরি হয়নি৷ সর্বশেষ গত আগস্টে বাড়ির মধ্যে খুন হয়েছেন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, যিনি অনলাইন জগতে পরিচিত ছিলেন নিলয় নীল নামে৷
বিস্ময়কর হচ্ছে, প্রকৃত খুনিদের ধরতে সরকারের অপারগতা৷ যারা খুন হয়েছেন, তারা নাস্তিক৷ আর নাস্তিকদের খুন করা যেন বাংলাদেশে এখন এক অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে৷ অন্তত পুলিশ এবং সরকারের ভূমিকাতে সেটাই মনে হচ্ছে৷ খুনিদের ধরার বদলে তারা বরং ব্লগারদের লেখালেখির ব্যাপারে সতর্ক করছে৷
বলতে পারেন, কেন ইতোমধ্যে কয়েকজনতো গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ হ্যাঁ, এটা ঠিক৷ চলতি বছর চতুর্থ হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজনকে ব্লগারদের খুনি সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে একজন রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক৷ তার পরিবার দাবি করেছে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিটি মানসিক ভারসাম্যহীন, চিকিৎসা নিচ্ছেন৷ আর তাঁকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তার অনেক আগে থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন৷ এরকম একজন ব্যক্তিকে একজন ব্লগার হত্যার ‘মাষ্টারমাইন্ড' হিসেবে দেখানো হচ্ছে, এখন পর্যন্ত৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
চলতি মাসে পাবনায় এক যাজককে হত্যা চেষ্টার পরপরই কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ কিন্তু সেই যাজক জানিয়েছেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের কেউ হত্যা চেষ্টার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না৷ অর্থাৎ যাঁরা হত্যার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ৷ তাহলে কি এসব গ্রেপ্তার লোক দেখানো?
ব্লগারদের ঠিক কারা খুন করছে, সেটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়৷ তবে গণমাধ্যম ঘাটলে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ‘নাস্তিক ব্লগারদের' ফাঁসির দাবিতে ঢাকায় তাণ্ডব করেছিল ‘হেফাজতে ইসলাম' নামের একটি উগ্রপন্থি সংগঠন৷ সেসময় ৮৪ ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের নাম নিয়ে একটি ‘হিট লিস্ট' তৈরি হয়েছিল, সেই লিস্টের বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে জবাই হয়েছেন৷ মার্চে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুর দুই সম্ভাব্য খুনিকে হত্যাকাণ্ডের পরপরই ধরে পুলিশে দিয়েছিলেন হিজড়ারা৷ তাদের একজন দাবি করে, হাটহাজারি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে সে৷ পুলিশ অবশ্য এই তথ্যটি সযতনে এড়িয়ে গেছে৷
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ব্লগার বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন৷ কেউ কেউ লেখালেখি ছেড়ে, লেখার ধরন বদলে, নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন৷ বোঝাই যায়, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এসব করা৷ সেটা খুব স্বাভাবিক৷ গতকাল দেখলাম ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম' ইমেল পাঠিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে, পরবর্তীতে কাদের হত্যা করা হবে, কি করা যাবে, যাবে না সেসব জানিয়ে৷ বোঝাই যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে তারা৷ হয়ত শীঘ্রই দেখতে হবে জবাই হওয়া নতুন কোন ব্লগারের রক্তে ডুবে থাকা মরদেহ৷ তাদেরকে রক্ষায় সত্যিই কী কেউ নেই?
আপনি কী এই ব্লগে নতুন কিছু যোগ করতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷