1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আরো বড় সংকটের শঙ্কায় বিদ্যুৎ খাত

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৪ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হচ্ছে৷ বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের ‘আদানি পাওয়ার’-এর সঙ্গে বকেয়া পরিশোধ নিয়ে টানাপোড়েন৷

Bangladesch I Payra Power Plant
পটুয়াখালী পায়রা তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিদিন ১,৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ফাইল ফটোছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance

আদানি ৭ নভেম্বরের মধ্যে তাদের পাওনা পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে৷ নয়তো তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করবে বলে জানিয়েছে৷

বকেয়া আদায়ে ভারতের ‘আদানি পাওয়ার' আগেই তার একটি ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে৷ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ঝাড়খন্ডে বাংলাদেশের জন্য নির্মাণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুই ইউনিট থেকে প্রতিদিন বাংলাদেশকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিল আদানি৷ গত বৃহস্পতিবার ৭০০ ইউনিটের একটি কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ সোমবার বিদ্যুৎ দিয়েছে ৭০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি৷

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও জ্বালানি সংকটে আছে৷ ১,১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি কয়লা সংকটের কারণে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে৷ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপাল ও এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ারের একটি করে ইউনিট কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে৷ রামপালে ১,২৩৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির সরবরাহ অর্ধেকে নেমেছে৷ ১,২২৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার এসএস পাওয়ারের গড় উৎপাদন ৬১২ মেগাওয়াট৷ গ্যাস সংকটে মোট ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে৷ জ্বালানি তেলের সংকটে ২৭টি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলচালিত কেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে নভেম্বরে কম চাহিদার সময়েও দেশে লোডশেডিং করতে হচ্ছে৷ ফলে দেশে লোডশেডিং বেড়ে প্রায় ১০০০ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে৷

তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দাবি করছে, এখন পর্যন্ত তেমন লোডশেডিং নেই৷ যেহেতু এখন তাপমাত্রা কম, তাই চাহিদাও কম৷ তবে গরমের সময় কী হবে তা এখনই তারা বলতে পারছে না৷ তাদের হিসাবে সোমবার দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয় ১৩,৫০০ মেগাওয়াট৷ আর উৎপাদন দেখানো হয়েছে ১৩,৯৭৪ মেগওয়াট৷ তবে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের হিসাব তাদের সঙ্গে মিলছে না৷ পাওয়ার গ্রিডের হিসাবে সোমবার দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয়েছে ১২,০৫০ মেগাওয়াট৷ আর উৎপাদন দেখানে হয়েছে ১১,৯৪৭ মেগাওয়াট৷ এখানে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৯৮ মেগাওয়াট৷ আর এই উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে আদানি দিয়েছে ৭৩৩ মেগাওয়াট৷ আরো আমদানি করা বিদ্যুৎ হলো ভেড়ামারার ৯০৫ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরার ৫৮ মেগাওয়াট৷ মোট ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ হলো  ১৬৯৬ মেগাওয়াট৷ দেশের  বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে পাওয়া গেছে ১০,২৫১ মেগাওয়াট৷ দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে গ্যাস চালিত কেন্দ্রগুলো থেকে পাঁচ ৫,৩৩৯ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানি থেকে ১,৬১৩, কয়লা ২,৫৫০, জলবিদ্যুৎ ১৭৬ এবং সৌরবিদ্যুৎ ৫৭৩ মেগাওয়াট৷

দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৪৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে৷ সবগুলো কেন্দ্র মিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট৷ তবে এর মধ্যে বেশ কিছু কেন্দ্র মেরামতের জন্য বন্ধ আছে৷ আর জ্বালানির অভাবেও বন্ধ আছে বড় বড় কেন্দ্র৷

পওয়ার গ্রিড যে মাত্র ৯৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেখাচ্ছে, তা আসলে ঠিক নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ কারণ, তাদের হিসাবে পাঁচ শতাংশ সিস্টেম লস ধরলে ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট৷ তার চেয়েও বেশি ঘাটতি আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷

লোডশেডিংয়ের হিসাবের মধ্যে অনেক ফাঁকি আছে: প্রকৌশলী শামসুল আলম

This browser does not support the audio element.

বিদ্যুৎখাত বিশ্লেষক প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, ‘‘বিদ্যুতের ঘাটতি না থাকলে সারাদেশে লোডশেডিং হচ্ছে কেন?৷’’

তার কথা,  ‘‘লোডশেডিংয়ের যে হিসাব করা হয় তার মধ্যে অনেক ফাঁকি আছে৷ আসলে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা করা হয় না৷’’

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ চট্টগ্রামে কেথাও কোথাও দিনে ৮-১০ ঘন্টা পর্যন্ত৷ বরিশালের পিরোজপুর এলাকায়ও লোডশেডিং হচ্ছে৷  দেশের উত্তরাঞ্চলেও একই পরিস্থিতি৷ পাওয়ার গ্রিডের এক কর্মকর্তা জানান, ‘‘যেসব এলাকায় পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে লোডশেডিং হচ্ছে৷ চট্টগ্রামে ওই কারণে লোডশেডিং হচ্ছে৷’’

এদিকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়ও এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানান তিনি৷

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান বলেন, ‘‘আসলে এখন উৎপাদনে তেমন ঘাটতি নাই৷ তবে যে লোডশেডিং হচ্ছে তা সিস্টেমের কারণে৷ আর সামনে শীতকাল আসছে৷ তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে৷ তবে এই পরিস্থিতি থাকলে গরমের সময় সমস্যা হবে৷’’

বাংলাদেশে গরমের সময় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৭,০০০ মেগাওয়াটের বেশি৷ আর শীতের সময় ৯০০০ মেগাওয়াটে নেমে যায়৷ কিন্তু মূল সমস্যা হলো, উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নেই৷

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক বলেন,  ‘‘এখন গ্যাসের সংকট আছে৷ কয়লার সংসকট আছে৷ এলএনজিও পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না৷ কয়লার সংকটের কারণে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে৷ আদানির বিদ্যুৎ এখন কম আসছে৷ অর্ধেকে নেমে গেছে৷ এখন শীতকাল আসছে৷ বিদ্যুতের চাহিদা কমছে৷ কিন্তু এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গরমকালে সমস্যা হবে৷’’

সংকট কোথায়?

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ অনেকাংশে আমদানি নির্ভর৷ সরাসরি ভারত থেকে বিদ্যুৎ তো আমদানি করাই হয়,  বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে জ্বালানি কয়লা, গ্যাস, জ্বালানি তেল তা-ও আমদানি করা হয়৷ ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাত বলতে গেলে অন্য দেশের ওপরই নির্ভরশীল৷

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন বলেন, ‘‘আমরা যে পথে চলছি তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৯২ ভাগ আমদানি করতে হবে৷ আর এতে ডলারের ওপর চাপ অনেক বেড়ে যাবে৷’’

সৌরতে ঝুঁকছে জার্মানি

04:09

This browser does not support the video element.

তার কথা, ‘‘আমাদের গ্যাস আছে, কিন্তু উত্তোলন করছি না৷ আবার কয়লাও আমাদের আছে, তা-ও নানা কারণে উত্তোলন করা যাচ্ছে না৷ আবার সরাসরি আমরা বিদ্যুৎ আমদানিও করছি৷ ফলে বিদ্যুৎ খাত বলতে গেলে পরনির্ভর হয়ে পড়েছে৷ এটা অব্যাহত থাকলে এই সংকট থাকবেই৷''

‘‘আবার আমরা যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করেছি, তা অপরিকল্পিত৷ সেগুলো বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে৷ আদানির সঙ্গে চুক্তির সময়ও আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি৷ ফলে এখন আমরা সেটা নিয়ে ভুগছি,'' বলেন তিনি৷

আর প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, ‘‘এখন বিদ্যুৎ খাত চলছে পুরো পরিকল্পনাহীনভাবে৷ তারা জানে না কতো কয়লা তারা আনতে পারবে৷ গ্যাসের পরিস্থতি কী, তরল জ্বালানি কয় মাসের আছে? আগের সরকারের পরিকল্পহীনতাই তাদের টানতে হচ্ছে৷ আগে যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে৷ তবে এর মধ্যেও একটা কিছু করা যেতো৷’’

তার কথা, ‘‘আমাদের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে এখন ভাবা উচিত৷ কারণ, যেভাবে এই খাত গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে আসলে সংকট কাটবে না৷ অন্য দেশের উপর নির্ভর করে একটি খাত এভাবে চলতে পারে না৷ আমাদের কাঠামো ছাড়া আর কিছু নাই৷ আসলে এই পরিস্থিতি করা হয়েছে অন্যকে লাভবান করার জন্য৷’’

আদানি পাওয়ার

বকেয়া না পেলে ৭ নভেম্বরের পর থেকে আদানি পাওয়ার বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ না দেয়ার যে হুমকি দিয়েছে তার জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ৷

রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেছেন, ‘‘আমরা অক্টোবর মাসে ওদের (আদানি পাওয়ার) প্রায় ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছি, যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ৷ এছাড়া তাদের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ কোটি ডলারের এলসি করা হয়েছে৷ তারপরও তাদের এমন আচরণ খুব আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর এবং দুঃখজনক৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আদানি সত্যিই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিলে আমরা এটা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত আছি৷ গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তির মধ্যে না পড়ে, সে জন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছি৷’’

আর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘‘আদানি গ্রুপ টাকা পায়, এটা সত্য৷ তাদের পেমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে গতি বাড়ানো হয়েছে৷ আগের যেসব বিল বাকি আছে, তার জন্য মূলত দায়ী পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার৷ তারা বিশাল একটা ঘাটতি রেখে গিয়েছিল৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ পেমেন্ট আরো দ্রুত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷’’

বিদ্যুৎ খাত পরনির্ভর হয়ে পড়েছে: ড. এজাজ হোসাইন

This browser does not support the audio element.

পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম জানিয়েছেন, ‘‘আদানির যে বকেয়া রয়েছে, তার একটা পেমেন্ট দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷’’

আদানির দাবি, বংলাদেশের তাদের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ডলার৷ এই পাওনা কবে পরিশোধ করা হবে, সে ব্যাপারে একটি পরিষ্কার ধারণা চায় আদানি গোষ্ঠী৷ এর আগে বকেয়া পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল আদানি পাওয়ার৷ পাশাপাশি পাওনা পরিশোধের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ১৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র দেয়ার জন্য কোম্পানিটি বলেছিল৷

প্রকৌশলী শাসুল আলম বলেন, ‘‘আসলে আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের অসম চুক্তি হয়েছে৷ তারা যে দামে বিদ্যুৎ দেয় তার চেয়ে কম দামে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব৷ তাদের দামের চেয়ে ভারতেও বিদ্যুতের দাম কম৷  চুক্তির ফাঁদে ফেলে বেশি দাম নেয়া হচ্ছে৷ কয়লার বাজার দরের কথা বলে এখন আবার তারা বেশি দাম দাবি করছে৷’’

আর ড. এজাজ হোসাইন বলেন, ‘‘আদানির সঙ্গে চুক্তিটি রিভিউ করে দেখা উচিত৷ কোনো প্রতারণা হয়ে থাকলে আন্তর্জাতিক সালিসি  আদালতে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে৷’’

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান বলেন, ‘‘আদানি  সোমবারও অর্ধেক (৭৩৩ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ দিয়েছে৷ তারা পেমেন্ট পেলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ