বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে এ পর্যন্ত ছয়টি মামলায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে৷ বিএনপি বলছে, তাঁকে চাপে রাখতেই মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে৷ ওদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, নাশকতা ও হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন খালেদা৷
বিজ্ঞাপন
৬ই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ-হরতালে এ পর্যন্ত ৮০ জন নিহত হয়েছে৷ এর মধ্যে পেট্রোল বোমা এবং আগুনে নিহত হয়েছেন ৫২ জন৷ এ সব নাশকতা ও হত্যার ঘটনায় মামলা হচ্ছে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে৷ এই মামলাগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে আসামি করা হয়েছে৷
খালেদাকে হুকুমের আসামি করে সর্বশেষ মামলাটি হয়েছে মঙ্গলবার, ঢাকার আদালতে৷ সোমবার নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে খালেদার গুলশান কার্যালয় ঘেরাওয়ের সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় করা হয়েছে মামলাটি৷
এর আগে ঢাকার আদালতেই হরতাল-অবরোধে ৪২ জনকে হত্যার ঘটনায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা হয় ২রা ফেব্রুয়ারি৷এছাড়া খুলনা, পঞ্চগড় এবং কুমিল্লাতেও চারটি মামলায় খালেদাকে হুকুমের আসামি করা হয়৷
আইজীবী মাহবুবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কোনো অপরাধে যদি কেউ প্ররোচনা দেন, তাহলে সেই অপরাধের মামলায় তাঁকে হুকুমের আসামি করা যেতে পারে৷ এর মানে হলো, অপরাধে প্ররোচনাদানকারীই হলেন হুকুমের আসামি বা অ্যাবেটর৷'' তিনি বলেন, ‘‘এই প্ররোচনা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ – দু'ভাবেই হতে পারে৷ আর প্ররোচনার উপায় নানা রকমের হতে পারে৷ অস্ত্র, ভাষা, বক্তব্য, বিবৃতি, আদেশ প্রভৃতি৷''
দণ্ডবিধির ১১৪, ১০৯ এবং ১৪৯ ধারায় হুকুমের আসামি বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান৷
তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার বক্তব্য, বিবৃতি বা আদেশে যদি হত্যা বা নাশকতার কথা না থাকে, তাহলে হরতাল-অবরোধে নাশকতা বা হত্যায় তাঁকে হুকুমের আসামি হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা কঠিন হবে৷কারণ আইনে হুকুমের আসামি হিসেবে প্রমাণ করতে হলে হুকুমদাতা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অপরাধ করতে প্ররোচনা দিয়েছেন বলে প্রমাণ করতে হয়৷''
এদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া শান্তিপূর্ণ অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাচ্ছেন৷ তিনি কোনো নাশকতা করছেন না বা নাশকতা করার নির্দেশও দিচ্ছেন না৷ সরকারের লোকজনই নাশকতা করে উল্টে বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে৷ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে তারা৷''
তবে তিনি বলেন, ‘‘সত্যিই যদি কেউ অপরাধের হুকুমদাতা হন, তাহলে অবশ্যই তিনি হুকুমের আসামি হবেন৷ তাঁর শাস্তি অপরাধীর সমান৷ আর খালেদার বিরুদ্ধে যাঁরা মিথ্যা মামলা করছেন, মামলা সাজাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে উল্টে মামলা হওয়া উচিত৷ কারণ বাংলাদেশের আইনে মিথ্যা মামলা করা অপরাধ৷''
তিনি দাবি করেন, ‘‘অতীতে আন্দোলনের নামে নাশকতা করার জন্য বরং শেখ হাসিনাকে তখন হকুমের আসামি করা যেত৷''
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সহ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন না৷ তিনি অবরোধ-হরতালের নামে পেট্রোল বোমা, আগুনে মানুষ পোড়ানো, মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন৷ তার বড় প্রমাণ হলো, তাদের কোনো নেতা-কর্মী মাঠে নেই৷ তাদের নেতারা দৃশ্যমানভাবে নয়, গোপনে বিবৃতি দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন৷সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে বোমা ও পেট্রোল বোমা হামলা, আগুন৷ আর তাতে সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এইসব হত্যা এবং নাশকতার দায় তাই খালেদা জিয়ার৷ সে'কারণেই তাঁকে হুকুমের আসামি করা হচ্ছে৷''
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘‘অতীতে শেখ হাসিনা গণআন্দোলন করেছেন৷ সেখানে যে টুকটাক সহিংসতা হয়নি তা নয়, তবে তা ছিল গণরোষের বহিঃপ্রকাশ৷ আন্দোলন সফল করার উপায় নয়৷ আন্দোলনে নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন৷ রাজনেতিক আন্দোলন হয়েছে৷ তাই সেই আন্দোলনকে সহিংস বলে শেখ হাসিনাকে দায়ী করা যাবে না৷ তাছাড়া বিএনপি যা করছে, তা সন্ত্রাস৷''
মনিরুজ্জামান মনির আরো বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে কেউ যদি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আন্দোলনের নামে এখনকার মত সহিংসতা করে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে৷ আন্দোলন করতে হবে মানুষকে সাথে নিয়ে, সহিংসতা দিয়ে নয়৷''
অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত জনজীবন
বাংলাদেশে টানা অবরোধ ও হরতালের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা৷ ক্রেতার অভাবে বেচাকেনা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে৷ শুধু অর্থনীতি নয়, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় মুষড়ে পড়েছে পরিবহন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন
পুরনো ঢাকার বাবু বাজারে কাগজ বোঝাই একটি ট্রাকে জ্বলছে দুষ্কৃতিকারীদের দেয়া পেট্রোল বোমার আগুন৷ গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ৷ ডাকা হচ্ছে হরতালও৷ অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে আলোচিত পেট্রোল বোমা৷ শুধু পেট্রোল বোমার আগুনেই পুড়ে মরেছে কমপক্ষে ৬৫ জন সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশ প্রহরায় চলছে পরীক্ষা
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়িাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পুলিশ প্রহরা৷ চলমান এ অবরোধ-হরতালে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা অন্যতম৷ বর্তমানে সারা দেশে চলা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন তাই অনেকটাই অনিশ্চয়তার মুখে৷ টানা অবরোধের মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে চলছে পরীক্ষা৷ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূরপাল্লার বাস নেই বললেই চলে
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলির ডাকা অবরোধে বাংলাদেশের প্রধান সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্ত৷ দুপুর বেলায় তোলা এ ছবিতে মহাসড়কটি প্রায় যানবাহন শূন্য৷ কিন্তু সাধারণ সময়ে এ সড়কটি থাকে যানবাহনে ভরা৷ বাংলাদেশে চলমান অবরোধে দূর পাল্লার গাড়ি চলাচল কমে গেছে বহুলাংশে৷ একের পর এক পেট্রোল বোমার ঘটনায় ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাচ্ছেন না অনেক মালিকই৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিজিবি-র টহল পর্যাপ্ত নয়
অবরোধের মধ্যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয়, মানে ঢাকার বাইরে বিজিবি-র টহল থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য৷ এছাড়া সম্প্রতি রাত ন’টার পরে বাস চলাচলে সকলকে নিরুৎসাহ করার কারণে বাস মালিকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় অস্বাভাবিক নয় যানজট
বাংলাদেশে চলমান এই অবরোধে ঢাকার ভেতরের সড়কের দৃশ্য অবশ্য আলাদা৷ যান চলাচল অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও, অনেক জায়গাতেই যানজট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসযাত্রীরা
ঢাকার ফার্মগেটে অফিস শেষে গাড়ির অপেক্ষায় বাড়িমুখী মানুষের ভিড়৷ টানা অবরোধে গণ পরিবহন ব্যবস্থা বেহাল হলেও, অর্থাৎ গাড়িঘোড়ার চলাচল কম থাকাতে দুর্ভোগ বেড়েছে অফিসমুখী ও অফিস ফেরত মানুষের৷ অফিসে যেতে বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে সাধারণ মানুষ তাই পড়ছেন দুর্ভোগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অবরোধে নদীপথের ভিন্ন চিত্র
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাটের চিত্র এটি৷ গত একমাসেরও বেশি সময়ের এই অবরোধে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো সহিংসতা ঘটেনি নদীপথে৷ তাই নদীপথে যান চলাচল প্রায় স্বাভাবিকই আছে৷ ঢাকা থেকে প্রধানত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যাচ্ছে না দূরপাল্লার বাসগুলো
বিএনপি ও সমমনা দলের জোটসমূহের ডাকা হরতাল-অবরোধে ঢাকার অন্যতম প্রধান বাস স্টেশন গাবতলীর দৃশ্য এটি৷ বেশিরভাগ দূর পাল্লার রুটের বাসই এ স্টেশনে পার্ক করে রাখা৷ হরতাল-অবরোধে দূর পাল্লার বাস চলাচল অনেকাংশেই বন্ধ আছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. Mamun
খদ্দেরহীন এক রেস্তোরাঁ
ঢাকার গাবতলী বাস স্টেশনের খদ্দেরশূন্য মোহাম্মাদীয়া রেস্তোরাঁ৷ অবরোধের কারণে এ রেস্তোরাঁর লোকবল ১৬ জন থেকে ৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ বাকি যে আটজন আছেন তাঁদেরও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না মালিক৷ গাবতলী স্টেশন থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচল কম থাকায় এ রেস্তোরাঁটি দিনের বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ
অবরোধ আর হরতালকারীদের প্রধান লক্ষ্য সড়কে চলাচলকারী বাস আর ট্রাক৷ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগেই যাত্রীবাহী বাস কিংবা ট্রাকে৷ এতে কমপক্ষে ৬০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পোড়ায় ক্ষত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন আরো শতাধিক সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
কমলাপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষায় যাত্রীরা
অবরোধে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল করলেও, সময়সূচি ঠিক রাখতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ৷ বিভিন্ন সময়ে অবরোধকারীদের রেল লাইনের ‘ফিশপ্লেট’ খুলে ফেলার কারণে কয়েকটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে৷ তাই বেশিরভাগ ট্রেনই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যাচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন৷
ছবি: DW/M. Mamun
খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা
টানা অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা৷ স্বল্প পুঁজির এ সব ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে যাওয়ায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেকেরই৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুঁজি ভেঙে চলছে যাঁর সংসার
ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকার ফুটপাথে কম্বলের ব্যবসা করেন গাজীরুল ইসলাম৷ দুপুরবেলা পর্যন্ত এ দিন তাঁর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭’শ টাকার একটি কম্বল৷ তাও তার কেনা দামের থেকে ৩০০ টাকা কম৷ লাভ তো দূরের কথা সংসার চালাতে এখন পুঁজি টুকুনিই ভরসা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রই যখন ভরসা
ঢাকার নবাবপুর থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ফিরছেন এক গাড়ি চালক ও তাঁর সহকারী৷ টানা অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে নিজেদের গাড়িতে এখন থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখবেন তাঁরা৷