কোত্থেকে কোথায় চলে গেলাম! মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার খেলা দেখে যারা হতাশ হয়েছেন, তাদের সান্ত্বনার জন্য বলছি: বিশ্বায়িত বিশ্বে ফুটবল কী আকার ও আকৃতি ধারণ করেছে, তা এবারকার বিশ্বকাপ দেখলেই বুঝতে পারবেন: আকৃতি ও অবয়বের দিক থেকে সুইস আর ফরাসি দলের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখলেন কি? আজকের ফুটবলাররা হলেন আইটি বিশেষজ্ঞদের মতো: বিশ্বের সর্বত্র তাদের প্রয়োজন, বিশ্বের সর্বত্র তাদের বিচরণ৷ আর এই বাজারে চাকরি পেতে গেলে কী ধরনের কোয়ালিফিকেশন দরকার, অর্থাৎ কী ধরনের ফুটবল খেলা দরকার, সেটা এই আধুনিক গ্ল্যাডিয়েটর তথা ভাড়াটে সৈনিকদের সবাই জানেন – কেননা তাঁরা ক্লাব ফুটবল থেকে এসেছেন৷
রাশিয়া বিশ্বকাপেও সবাই তাঁদের দিকে তাকিয়ে৷ মেসি আর নেইমার৷ চলুন ২০১৪ বিশ্বকাপে তাদের কয়েকটি ম্যাজিক দেখে নিই ছবিঘরে৷
ছবি: Pedro Ugarte/AFP/Getty Images২০১৪ বিশ্বকাপে তারকার দ্যুতি কিন্তু প্রথমে নেইমারই দেখিয়েছেন৷ আসর শুরু হয়েছিল ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচ দিয়ে৷ আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়লেও পরে নেইমারের গোলেই ম্যাচে ফিরেছিল ব্রাজিল৷ গোল করার পর নেইমারের উল্লাস৷
ছবি: Reutersক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেদিন শুধু ব্রাজিলকে ম্যাচে ফেরাননি, আরেক গোল করে জয়ের দ্বারপ্রান্তেও নিয়ে গিয়েছিলেন নেইমার৷ গোলটি হয়েছিল পেনাল্টি থেকে৷ ছবিতে ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক স্টিপে প্লেটিকোসাকে নেইমারের শট রোখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reutersবিশ্বকাপ ২০১০ শুধু হতাশাই দিয়েছিল লিওনেল মেসিকে৷ সে আসরে আর্জেন্টিনা তো প্রত্যাশা মতো খেলতে পারেইনি, মেসিও পাননি বলার মতো কোনো সাফল্য৷ মেসির মতো খেলোয়াড় সেবার একটা গোলও পাননি, ভাবা যায়! ২০১৪-তে কিন্তু গোলখরা কাটাতে বেশি সময় নেননি৷ রিও ডি জেনেরোয় নিজেদের প্রথম ম্যাচে বসনিয়াকে ২-১ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা৷ দু’গোলের মধ্যে একটি ছিল মেসির৷
ছবি: Reutersদ্বিতীয় ম্যাচে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল ইরান৷ সহজ জয়ই ছিল প্রত্যাশিত৷ কিন্তু ইরান কোমর বেঁধে নামে গোল না খাওয়ার লড়াইয়ে৷ মেসি ছিলেন বলে রক্ষা৷ তাঁর একমাত্র গোলেই সেদিন জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টিনা৷ মেসির শট থেকে বল যাচ্ছে জালে, আপ্রাণ চেষ্টা করেও কিছু করতে করতে পারলেন না গোলরক্ষক আলী রেজা হাঘিঘি, শেষ রক্ষা হলো না ইরানের৷
ছবি: Reutersমেসি ছাড়া আর্জেন্টিনা প্রায় অচল – এটা এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত সত্য৷ ব্রাজিল দলে নেইমারের গুরুত্বও এখন এরকম৷ মেক্সিকোর বিপক্ষে নেইমার গোল পাননি৷ ব্রাজিলকে সেই ম্যাচ ড্র করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে৷ গ্রুপ পর্বে পাঁচ বারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের শেষ ম্যাচটি ছিল ক্যামেরুনের বিপক্ষে৷ এ ম্যাচেও নেইমারের গোলেই এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা৷
ছবি: Reutersক্রোয়েশিয়ার মতো ক্যামেরুনের বিপক্ষেও এক গোল করে সন্তুষ্ট থাকেননি নেইমার৷ এ ম্যাচেও জাগিয়েছিলেন হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা৷ কোচ স্কলারি অবশ্য নকআউট পর্বের কথা ভেবে দলের সেরা তারকাকে নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেননি৷ দু’গোল করার পরই তুলে নেন নেইমারকে৷
ছবি: AFP/Getty Images‘এফ’ গ্রুপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে নিজেদের শেষ ম্যাচে মেসির গোলেই এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা৷ তারপরও থামেননি আর্জেন্টাইন সুপারস্টার৷
ছবি: picture-alliance/dpaআর্জেন্টিনাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল নাইজেরিয়া৷ ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পরের মিনিটেই মুসার গোলে সমতা ফেরায় তারা৷ তারপর আবার মেসি-ম্যাজিক৷ ফ্রি-কিক থেকে গোল করে আবার আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন এই ফুটবলার৷ ছবিতে মেসির ফ্রি কিক নেয়ার দৃশ্য, বাঁক খেয়ে বল যাচ্ছে গোল পোস্টের দিকে৷
ছবি: Pedro Ugarte/AFP/Getty Images ব্যালান্স অফ পাওয়ার
জার্মানির প্রতিপক্ষ হিসেবে আলজেরিয়া, কিংবা আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ হিসেবে সুইজারল্যান্ডের নাম করলেই যে একগাদা গোল হবে এবং বিজয়ীর নাম আগে থেকেই বলে দেওয়া যাবে, আজ আর সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই৷ মঙ্গলবারের খেলায় সুইজারল্যান্ডের শাকা, শাকিরি অ্যান্ড কো. ফুটবলের ম্যানুয়ালের প্রতিটি স্কিলই শুধু নয়, আধুনিক ফুটবলের গতি, চাতুর্য ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পুরোটা প্রদর্শন করেছে৷ আরো বড় কথা, শারীরিক পটুতা কিংবা সহিষ্ণুতায় সুইস প্লেয়াররা সম্ভবত আর্জেন্টিনীয়দের থেকে অনেক এগিয়ে৷
সব মিলিয়ে এই প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায়ে যে একটির পর একটি গেম বাঁধাধরা ৯০ মিনিটে নিষ্পত্তি না হয়ে আরো ৩০ মিনিট, এমনকি পেনাল্টি শুটআউট অবধি গড়াচ্ছে, তার কারণ হল, সব ক'টি দল আজ একটি ব্যালান্স অফ পাওয়ার, শক্তির ভারসাম্যে পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে প্রথাগত খেলা দিয়ে যুদ্ধজয় করা সম্ভব নয়৷ জিততে গেলে আজ লাগে নেইমার, মেসি কিংবা টোমাস ম্যুলারের মতো কোনো ব্রহ্মাস্ত্র কিংবা মারণাস্ত্র৷ মুশকিল শুধু এই যে, বিপক্ষও সে কথা জানে এবং গোড়া থেকেই সেই মারণাস্ত্রকে – প্রয়োজনে বারংবার ফাউল করে – নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ তাহলে রবিন হুড-এর কী কর্তব্য?
লিওনেল ও আনহেল
আর্জেন্টিনার ভালোমানুষ বোম্বেটেরা খেলতে গিয়েছিল প্রতিবেশী হাল্লা রাজার দেশে, যার নাম ব্রাজিল৷ ব্রাজিলের সব মানুষ আর্জেন্টিনার ওপর হাড়চটা: স্টেডিয়ামে উপস্থিত সব ব্রাজিলীয় নির্দ্বিধায় সুইজারল্যান্ডকে সাপোর্ট করেছেন৷ এক জার্মান ভাষ্যকার তো বলতে বাধ্য হয়েছেন: সুইসরা কি নিজেরাই জানতো, তারা ব্রাজিলে কতোটা জনপ্রিয়? না, আর্জেন্টিনা বিদ্বেষকে সুইজারল্যান্ড-প্রীতি বলে ভাবলে ভুল করা হবে৷ কিন্তু ফলশ্রুতি হরেদরে এক: লিওনেল আর আনহেল-কে ঐ ‘ডাইনির হাঁড়িতে' খেলতে নামতে হয়েছে!
প্রিয় দলের প্রতি সমর্থন নানাভাবে প্রকাশ করেন ফুটবল ভক্তরা৷ কেউবা বেছে নেন উদ্ভট বেশভূষা, কেউবা নিজের মুখটা রাঙান পতাকার রঙে৷ আজকাল আবার লেন্সও পাওয়া যাচ্ছে পতাকার রঙে৷ ফুটবল ভক্তদের কিছু ব্যতিক্রমী বেশভূষা পাবেন এখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpaক্যামেরন এবং ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচ দেখতে আসা এক ব্রাজিলের ভক্ত এভাবেই সাজিয়েছেন নিজেকে৷ পুঁতির তৈরি বিকিনিতে বিশেষভাবে ব্রাজিলের পতাকা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ ফুটবল ভক্তদের ব্যতিক্রমী বেশভূষার কিছু নমুনা পাবেন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance/PIXSELLদেখলে মনে হবে, জার্মানির এক ফুটবলভক্ত চোখের মণিতে এঁকেছেন জাতীয় পতাকা৷ আসলে তিনি কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করছেন৷ আর সেই লেন্সটাতে রয়েছে পতাকার রং৷
ছবি: picture-alliance/dpaব্রাজিলে ঘানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ম্যাচের সময়কার গ্যালারির ছবি এটি৷ ঘানার সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে সে দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpaদেখে মনে হচ্ছে দলকে জেতাতে রীতিমত ঝাড়ফুঁক দিচ্ছেন ঘানার এই ফুটবল ভক্ত৷ ছবিটি ১৬ই জুন ঘানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার খেলার সময় তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpaইকুয়েডরের এক ফুটবল ভক্তের ফুটবল মাস্ক এটি৷ হন্ডুরাস এবং ইকুয়েডরের খেলা দেখতে এভাবেই মাঠে হাজির হন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpaএবারের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায় পার হতে পারেনি পর্তুগাল৷ কিন্তু এ জন্য কিন্তু ভক্তদের দোষ দেয়া যাবে না কিছুতেই৷ বরং তারা কিন্তু দলকে উজ্জীবিত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টাই করেছেন৷ এক পর্তুগিজ ফুটবল যুগল মাঠে এসেছিলেন এই লেবাসে৷
ছবি: picture-alliance/dpaইনি একজন মার্কিন সমর্থক৷ পর্তুগাল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খেলা দেখতে ২২শে জুন এভাবে মাঠে হাজির হন তিনি৷ সে খেলায় অবশ্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল টানটান উত্তেজনা৷
ছবি: picture-alliance/dpaউত্তর খুঁজতে কষ্ট করার দরকার নেই৷ এরা মেক্সিকোর সমর্থক৷ ২৩শে জুন তাঁরা একটু বাড়তিই উচ্ছ্বসিত ছিলেন৷ কেননা সেদিন তাঁদের দল ৩-১ গোলে হারায় ক্রোয়েশিয়াকে৷
ছবি: picture-alliance/dpaআগের ছবিতে যাদের কথা বলেছি, ইনিও তাঁদেরই একজন৷ তবে তাঁর লেবাস কিছুটা ভিন্ন৷ এমন বেশভূষা দীর্ঘসময় পরে থাকা কিন্তু সহজ কথা নয়৷ তবে ভক্তরা সবই পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaযাঁদের মাথায় চুল নেই তাঁরা এটাকে বাড়াবাড়ি মনে করতেই পারেন৷ তবে এই ফুটবল ভক্ত ব্রাজিল এবং ঘানার মধ্যকার ম্যাচ দেখতে এত বড় চিরুনি নিয়েই হাজির হন৷
ছবি: picture alliance/augenklick/firo Sportphotoজার্মানির এই দুই সমর্থক তাঁদের ঠোঁট রাঙিয়েছেন জাতীয় পতাকার আদলে৷ জার্মানিতে এমন চর্চা প্রচুর৷ খেলা শুরুর আগে ফুটবল ভক্তরা ছোট্ট করে গালে এঁকে নেন জাতীয় দলের পতাকা কিংবা ঠোঁট রাঙিয়ে নেন এভাবে৷
ছবি: DW/E.de Sá প্রথম ৯০ মিনিট দু'টি দল সমান সমান, দুই ষণ্ডের মতো শিং-এ শিং লাগিয়ে নীরবে ঠেলাঠেলি করে যাচ্ছে, কেউ এক পা এগোচ্ছে কিংবা পিছচ্ছে না৷ লিওনেল খামোখা কয়েকবার তার ক্ষিপ্রতা ও ড্রিবলিং দেখিয়েছে বটে, কিন্তু কেন, তা ঠিক বোঝা যায়নি, অর্থাৎ লোকে বোঝেনি যে, এ সবই একটা ফাইনাল অ্যাটাকের প্রস্তুতি৷ ষাঁড়াষাঁড়ি দেখতে দেখতে লোকে যখন হাই তুলতে শুরু করবে, বিপক্ষ দলের প্লেয়াররা যখন ভাববে, লিওনেলের দৌড় শুরু হলে আমাদের জনা তিন-চার গিয়ে তাকে একটা আধা-ফাউল গোছের কিছু একটা করলেই হল – ঠিক তখনই খাটো লিওনেলের সাগরেদ আনহেল – আনহেল ডি মারিয়া – ঢ্যাঙা আনহেল যে পেনাল্টি এরিয়ার ডানদিকে পুরোপুরি খালি, সেটা সপক্ষের কি বিপক্ষের কেউ খেয়াল করেনি – এক স্যাঙাৎ লিওনেল ছাড়া৷
ঘটনাটা ঘটলও সেভাবে: লিওনেল দু'তিনজনকে পাশ কাটিয়ে পেনাল্টি এরিয়ার ভিতরে ঢুকছে, তাকে হায়েনার দলের মতো তাড়া করেছে সুইজারল্যান্ডের ডিফেন্টাররা৷ লিওনেলের পাস চলে গেল ডানদিকে, আনহেলের পা এসে নীচু বল সোজা শটে ঢুকিয়ে দিল বিপক্ষের নেটে – আর আর্জেন্টিনার বোম্বেটেরা পৌঁছে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে৷ তাহলে লিওনেল আর আনহেল অতো চুপচাপ কেন?
আর কিছু নয়, পরের খেলাটা আবার বেলজিয়ামের সাথে কিনা!
প্রতিবেদন: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন