ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের হাত থেকে বাঁচতে মানুষের সতর্কতার শেষ নেই৷ তার ওপর যাঁরা এ রোগে আক্রান্ত, তাঁদের হাজার রকম বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়৷ শর্করা জাতীয় খাবার তো নৈব নৈব চ! কিন্তু ‘আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার’-এর বেলায়?
বিজ্ঞাপন
ডায়াবেটিস রোগী হলে কম ক্যালরি যুক্ত খাবার, অপেক্ষাকৃত কম সোডিয়াম যুক্ত ফল, কম লবণ, কম তেল এবং বিশেষ করে চিনি মুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি৷ কিন্তু মিষ্টি খেতে কে না ভালোবাসে বলুন? তাই ডায়াবেটিস রোগীর খাবার মিষ্টি করতে এতদিন পর্যন্ত ‘আর্টিফিশিয়াল সুইেটনার' ব্যবহার করার একটা চল ছিল৷ বাংলায় যাকে আগে এক কথায় ‘স্যাকারিন' বলা হতো!
চায়ে, গরম দুধে, এমনকি রান্নাতেও এই কৃত্রিম মিষ্টি উৎপাদক এবং ‘ক্যালরি মুক্ত' সুইটেনার ব্যবহার করতেন অনেকে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা বহুমূত্র রোগীদের শেষ ভরসাটাকেও যেন ছিনিয়ে নিল৷
ইসরায়েলি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াইজমান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স'-এর দুই গবেষক এরান এলিনাভ এবং এরান সেগাল তাঁদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানালেন, ‘আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার'-এর নিয়মিত এবং অতিরিক্ত ব্যবহার ডায়াবেটিস টাইপ-২ হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়৷
মিষ্টিমিশ্রিত পানীয় ওজন বাড়ায়
অল্প বয়সিরা পান করা বলতেই বোঝে মিষ্টি পানীয়, অর্থাৎ পানির সাথে প্রচুর চিনি৷ কিন্তু তারা বোঝে না যে এর পরিণাম কতটা ভয়ঙ্কর! শুধুমাত্র অতিরিক্ত মিষ্টির কারণে ডায়াবেটিসের মতো কঠিন অসুখও হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/runzelkorn
মিষ্টি পানীয় থেকে সাবধান!
কোকাকোলা, ফান্টা বা এ ধরনের মিষ্টি পানীয় নিয়মিত পান করলে মানুষ স্থায়ীভাবে মোটা হয়ে যায়, অর্থাৎ পরে এই অতিরিক্ত ওজন কমানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে৷ বিশেষ করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে৷ বিভিন্ন ফলের রস, চা, মিল্ক শেক-এ যথেষ্ট পরিমাণে চিনি মেশানো থাকে যা পান করলে ওজন তো বাড়েই, সেই সাথে ডায়াবেটিস টাইপ- ২ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে খুব বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুধু সফ্ট ড্রিংক থেকে ৩০ কেজি চিনি
জার্মানিতে ছয় বছরের একটি বাচ্চা লিমোনেড বা ফান্টা জাতীয় মিষ্টি পানীয় পান করার মধ্য দিয়ে বছরে প্রায় ৫ কেজি চিনি শরীরে ঢুকিয়ে থাকে৷ আর ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে এই হিসেব বেড়ে দাড়ায় ৩০ কেজি৷ সেজন্যই জার্মানির ডায়াবেটিস সাহায্য সংস্থা স্কুল, কিন্ডারগার্টেন বা কাছাকাছি দোকানগুলোতে মিষ্টি পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করার পক্ষে৷
ছবি: picture alliance/dpa
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি শতকরা ২২ ভাগ
ডায়াবেটিস সাহায্য সংস্থার সভাপতি ও হানোভার শিশু হাসপাতালের প্রধান প্রোফেসর ড. টোমাস ডানে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, দিনে নিয়মিত মাত্র এক গ্লাস করে এ জাতীয় মিষ্টি পানীয় পানের ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে শতকরা ২২ ভাগ৷ তাই এসব পানীয়ের লোভনীয় বিজ্ঞাপণ দেখে না ভোলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/ZB
কৃত্রিম গন্ধ
কোকাকোলা, লিমোনেড বা ফান্টা জাতীয় পানীয়গুলোতে থাকে কৃত্রিমগন্ধ আর চিনি৷ ফলের রসগুলোতেও বেশিরভাগই থাকে ফলের রসের বদলে শুধু ফলের কৃত্রিম গন্ধ ও চিনি৷ মাল্টিভিটামিন জুস-এ থাকে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে চিনি, ফলে এ সব জুস পান করা পিপাসা মেটানোর জন্য কোনো ভালো সমাধান নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
বাবা-মায়ের উচিত বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই মিষ্টি জাতীয় সফ্ট ড্রিংক পান করার অপকারিতা সম্পর্কে জানানো৷ কারণ, পরে অতিরিক্ত মোটা হয়ে গেলে তা কমানো খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়৷ সময়মতো এদিকে নজর দিলে অনেক সমস্যার সমাধান নিজে থেকেই হয়ে যায়৷ এ বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞদেরও উচিত বাচ্চার বাবা-মাকে আগে থেকে জানানো, পরামর্শ ড. ডানের৷
ছবি: picture-alliance / dpa/dpaweb
তাজা ফলের জুস
মিষ্টি পানীর বদলে বাচ্চাদের কম চিনি মিশ্রিত পানীয়, চিনি ছাড়া চা এবং ঘন ও অতিরিক্ত মিষ্টি ফলের জুসের সাথে বেশি পরিমাণে পানি মিশিয়ে পান করানো যেতে পারে৷ তাজা ফলের রস প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে পান করা উচিত৷
ছবি: pressmaster/Fotolia
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
ডায়াবেটিস সাহায্য সংস্থার উদ্যোগে ডায়াবেটিস বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি প্রচারণা চালানো হয়৷ সুস্থ্য জীবনযাপনের জন্য লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, স্কুলের কাছাকাছি ছোট দোকানগুলোতে মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং পানীয় বিক্রি বন্ধ,প্রতিদিন পুরো এক ঘণ্টা শরীর চর্চা৷ অতিরিক্ত মোটা হওয়ার মতো এমন খাবার বা পানীয়র বিজ্ঞাপন স্কুলে বন্ধ করতে হবে৷ ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে খাবারের পাশেই লেখা থাকা প্রয়োজন খাবারে পুষ্টিগুণের তালিকা৷
ছবি: imago/imagebroker
টিভি দেখার সময় খাওয়া নয়
যখন তখন টিভির সামনে বসে চিপস বা এ জাতীয় খাবারের সাথে মিষ্টি জাতীয় পানীয় পান করা কমাতে হবে৷ অতিরিক্ত মোটা হওয়ার কারণে কিশোর-কিশোরীদের শুধু শরীরিক সমস্যা নয়, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কাও থাকে অনেক, মত বিশেষজ্ঞদের৷
ছবি: Fotolia/runzelkorn
8 ছবি1 | 8
মূলত তিন ধরনের ‘আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার' বাজারে পাওয়া যায় – অ্যাসপারটেম, সুক্রালোস এবং স্যাকারিন (দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত)৷ এরান এলিনাভ এবং এরান সেগাল জানান, এগুলি যদি বেশি পরিমাণে নেওয়া হয়, তবে শরীরে ‘গ্লুকোজ ইনটলারেন্স' দেখা দেয়, যা পরবর্তীতে ডায়াবেটিসের রূপ ধারণ করে৷
তার ওপর অ্যাসপারটেম নাকি শরীরের ‘হ্যাপি হরমোন' বা সেরোটোনিন-কে নষ্ট করে ফেলে, যা ‘লিবিডো' বা যৌন ইচ্ছাকে কমিয়ে দেয়৷
এলিনাভ এবং সেগাল-এর গবেষণাটি এখনও পর্যন্ত ইঁদুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, তাঁদের ধারণা এটা মানুষের শরীরেও একইভাবে কাজ করবে৷ স্কটল্যান্ডে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনটেগ্রেটিভ ফিসিওলজি'-র অধ্যাপক জন মেনজিস অবশ্য বললেন অন্য কথা৷ তাঁর কথায়, প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠন যেমন আলাদা, তেমনই খাওয়া-দাওয়ার ধরণও আলাদা৷ তাই কে কতটা পরিমাণ সুইটেনার খাচ্ছেন, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে৷
তাই ছোট্ট এই ‘ম্যাজিক বাটন' বা ‘বোতাম'-গুলো যে নামে মাত্রই ক্ষতিকারক – সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না৷
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত৷ আর ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷