ট্রাম্পের অ্যামেরিকা ও শি জিনপিং-এর চীনের উগ্র ভূমিকার মাঝে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে৷ করোনা সংকটের অর্থনৈতিক কুপ্রভাব রুখতে ইইউ শীর্ষ নেতারা ঐকমত্যের চেষ্টা চালাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
করোনা সংকটের শুরুতে ইউরোপের দেশগুলি দিশাহারা হয়ে নিজস্ব সীমানা বন্ধ করে নিজস্ব পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করেছিল৷ সংকট সামলাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় কোনো ভূমিকা ছিল না বললেই চলে৷ তারপর ইইউ এই সংকটের ফলে জর্জরিত অর্থনীতি সামাল দেবার উদ্যোগ শুরু করে৷ শেষ পর্যন্ত জার্মানি ও ফ্রান্সের শীর্ষ নেতারা বিভেদ ভুলে ইইউ-র ছত্রছায়ায় বিশাল অঙ্কের এক অর্থনৈতিক প্রণোদনার প্রস্তাব দিয়েছেন৷ তবে সেই উদ্যোগকে ঘিরে এখনো সম্পূর্ণ ঐকমত্য অর্জন করা সম্ভব হয় নি৷ শুক্রবার ইইউ শীর্ষ নেতাদের ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে মতপার্থক্য দূর করে এ ক্ষেত্রে ঐকমত্যের চেষ্টা চালানো হবে৷ তবে এ দিনই চূড়ান্ত ফলাফলের আশা করা হচ্ছে না৷
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, করোনা সংকটের জের ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে মারাত্মক মন্দার মুখে পড়েছে৷ এই সংকট থেকে বের হতে জরুরি ভিত্তিতে ইইউ বাজেট ও পুনর্গঠন তহবিল সম্পর্কে ঐকমত্যের প্রয়োজন৷ বৃহস্পতিবার জার্মান সংসদে দেওয়া এক ভাষণে ম্যার্কেল আরও বলেন, ইউরোপীয় প্রকল্প কতটা ভঙ্গুর, এই মহামারি তা দেখিয়ে দিচ্ছে৷ তিনি আত্মসমালোচনার সুরে বলেন, ইউরোপীয় উদ্যোগের ফলে জাতীয় স্তরে প্রাথমিক পদক্ষেপ সেই দুর্বলতা তুলে ধরেছে৷
করোনা সংকটের অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে ইইউ বাজার থেকে ৭৫,০০০ কোটি ইউরো ঋণ নেবার প্রস্তাব রেখেছে৷ বিশেষ করে ইটালি ও স্পেনের মতো দেশের বাইরের সহায়তা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে৷ ইউরোপীয় কমিশন এর দুই-তৃতীয়াংশ অনুদান ও এক তৃতীয়াংশ ঋণ হিসেবে বণ্টন করার প্রস্তাব রেখেছে৷ সেইসঙ্গে ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী ইইউ বাজেটের অঙ্ক বাড়িয়ে এক লাখ দশ হাজার কোটি ইউরো করার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে৷ গত ফেব্রুয়ারি মাসের ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে এ বিষয়ে ঐকমত্য অর্জন করা সম্ভব হয় নি৷ এর মধ্যে জার্মানি সুর নরম করলেও অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডসের মতো কিছু দেশ ঋণের বোঝা ভাগ করে নেওয়ার ঘোর বিরোধী৷ তবে নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বলেছেন, শেষ পর্যন্ত আপোশের প্রয়োজন হবে৷ সরাসরি আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে দুর্বল দেশগুলিকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অঙ্গীকার করতে হবে বলে তিনি মনে করেন৷
মতপার্থক্য সত্ত্বেও ইইউ শীর্ষ নেতাদের উপর দ্রুত ঐকমত্য অর্জনের জন্য চাপ বাড়ছে৷ মহামারির সরাসরি প্রভাবের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বর্তমান ভূমিকার কারণেও ইউরোপের সমৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়েছে৷ এই অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্পষ্ট পদক্ষেপ না নিলে ইউরোপের মানুষের মনে ক্ষোভ বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে৷ জুলাই মাসের মধ্যে সেটা সম্ভব না হলে শরৎকালের মধ্যে ইইউ দেশগুলির অর্থনৈতিক সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন৷
এসবি/জেডএইচ (রয়টার্স, এএফপি)
করোনায় দেউলিয়া যারা
করোনা মহামারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত বিশ্ব বাণিজ্য৷ নিরবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো৷ এমনকি অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করছে৷
ছবি: DW/I. Banos-Ruiz
কারা টিকে থাকছে?
অনেক জায়গাতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দুয়ার এখনও বন্ধ৷ এমন পরিস্থিতিতে কত প্রতিষ্ঠানে চিরতরে হারিয়ে যাবে আর কতগুলো শেষ পর্যন্ত ফিরবে তা অনিশ্চিত৷ এই মুহূর্তে দেউলিয়া ঘোষণা করার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে না অনেকেই৷ বলা হচ্ছে বিশ্ব এখনও এই সংকট পরিস্থিতির মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে৷ পুরো পরিস্থিতি অনুধাবন আর আসল ধাক্কাটি সম্ভবত টের পাওয়া যাবে আগামী বছরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Gateau
ছোটরা বেশি বিপদে
করোনার কারণে সবচেয়ে বড় লোকসান পড়েছে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো৷ যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জে ক্রু নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে৷ হংকং এবং জার্মান ভিত্তিক ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা এসপ্রি বলেছে, এশিয়া থেকে সব স্টোর তারা গুটিয়ে নিবে৷ অনলাইন বেচাকেনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় কোভিড-১৯ এর ধাক্কা লাগার আগে থেকেই অবশ্য এই কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছিল৷ মহামারি তা আরো ত্বরান্বিত করছে মাত্র৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/L. Ying
নড়বড়ে বড়রাও
দেউলিয়া আইনে সুরক্ষা পেতে আবেদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্যান মার্কাসের মতো বৃহৎ ডিপার্টমেন্ট স্টোর৷ মে মাসেই ‘চাপটার ইলেভেন ফাইল’ করেছে জেসি পেনি৷ ১১৮ বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানটির স্টোর আছে ৮০০ টি৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই তালিকায় এমন নামীদামি কোম্পানির নাম সামনের দিনে যোগ হবে আরো৷ এমনকি জার্মানির সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর গ্যালারিয়া কার্স্টার্ড কাউফহফ এর মত প্রতিষ্ঠানও সেই পথে হাঁটছে বলে গুঞ্জন রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কে বাঁচাবে?
যুক্তরাজ্যে এক জরিপে দেখা গেছে চলতি বছর প্রতি দশটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ তাদের সেবার চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে অথচ তহবিল আগের চেয়ে কমে গেছে৷ আর এক্ষেত্রে সামাজিক সহযোগিতা কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যারা কাজ করে তারাই পড়ছে সবচেয়ে বিপাকে৷ এমনকি ন্যাশনাল ট্রাস্ট এর মত খ্যাতনামা গ্রুপও এই ধাক্কা অনুভব করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Güttler
রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধ্বস
বিভিন্ন জায়গায় রেস্টুরেন্টগুলো তাদের চেয়ার গুটাতে শুরু করেছে৷ বলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এই ব্যবসায় শুধু দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চেইনগুলোই হয়তো টিকে থাকবে৷ তবে কিছু বড় চেইনও নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে৷ যেমন ভাপিয়ানোর মত জনপ্রিয় চেইনটি জার্মানিতে দেউলিয়া আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ মারিদো নামের আরেকটি কোম্পানি তাদের তৃতীয় রেস্টুরেন্ট বন্ধ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/SvenSimon/F. Hoermann
পর্যটনে বেঁচে থাকার লড়াই
অ্যামেরিকার গাড়ি ভাড়া দেয়া প্রতিষ্ঠান হার্তজ৷ গতমাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বিদায় নিয়েছেন৷ দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছে তারা৷ উত্তর অ্যামেরিকাজুড়ে ছাঁটাই করেছে ১০ হাজার কর্মী৷ পর্যটন খাতে জড়িত বাকিরাও স্বস্তিতে নেই৷ জার্মানির বিমান প্রতিষ্ঠান লুফটহানসা সরকারের কাছ থেকে ৯০০ কোটি ইউরোর সহায়তা তহবিল নিয়েছে৷ ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া কোন রকমে টিকে আছে ‘ভল্যানটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ অধীনে৷
ছবি: Imago/R. Peters
পেট্রোলিয়ামের কদর নেই
চাহিদা কমে যাওয়া বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে ঠেকেছে৷ এর সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর এখন ত্রাহি পরিস্থিতি৷ এপ্রিলে ডায়মন্ড অফশোর ড্রিলিং, হোয়াইটিং পেট্রোলিয়াম, আল্ট্রা পেট্রোলিয়াম ফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের কাছে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন জানিয়েছে৷ তবে তারা যে একেবারে বিদায় নিচ্ছে তা নয়৷ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটলেই এই প্রতিষ্ঠাগুলো ব্যবসায় ফিরবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
ছবি: Imago-Images/ITAR-TASS
মাঠে যখন দর্শক নেই
দর্শকের বদলে খেলোয়াড়রা, শিল্পীরা নিজেদের নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন ক্যামেরার সামনে৷ তাতে কি ক্ষতি পোষাবে? এর সঙ্গে জড়িত ক্লাব, কর্তৃপক্ষ আর বিভিন্ন কোম্পানি বঞ্চিত হচ্ছে টিকিট আর বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে৷ জার্মানির পেশাদার ফুটবল দল কাইজার্সলাউটার্ন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই তালিকা সামনের দিনে ক্রমশ লম্বা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Anspach
আসল পরিস্থিতি সামনে
বিরাট অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে উন্নত দেশগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু আসল পরিস্থিতি ধরা দিবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে৷ কেননা ততদিনে অনেকেরই প্রণোদনার টাকা ফুরাতে শুরু করবে৷ কোম্পনিগুলো দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতপাড়ায় লাইন ধরবে, বাড়বে কর্মহীন মানুষের বহরও৷ এমন আভাসই দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা৷
ছবি: Reuters/D. Ryder
দেউলিয়া হলে কি সব শেষ?
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারো কাছে গর্বের, কারো কাছে লজ্জার৷ অনেক ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোম্পানি বা ব্যক্তি নতুন প্রস্তুতি নিয়ে আরো শক্তিশালী রূপে ফিরে আসতে পারে৷ হেনরি ফোর্ড তার কোম্পানি শুরুর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন৷ ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় জিএম, ক্রাইসলারের মত কোম্পানিও দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছিল৷ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতেও এমন কিছু খারাপ খবর আসবে যা হয়তো পরবর্তীতে ভাল কিছুর জন্ম দিবে৷