প্যারাগুয়ের উত্তরে অ্যাটলান্টিক রেন ফরেস্ট৷ সেই ক্রান্তিমণ্ডলীয় অরণ্যের মাঝখানে চলেছে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা আচে রেড ইন্ডিয়ান উপজাতির মানুষদের বাঁচার সংগ্রাম৷ মূল প্রশ্নটা হলো: মাটে চা, নাকি সয়াবিন?
বিজ্ঞাপন
অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে প্যারাগুয়ের রেন ফরেস্ট অর্থাৎ বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনানী, যার মাত্র স্বল্পই অবশিষ্ট রয়েছে: সাবেক অরণ্যভূমির মাত্র ১৩ শতাংশ, সাকুল্যে ৫০০ হেক্টর বনভূমি৷ ‘আচে' উপজাতির মানুষরা আর শুধু শিকার করে কিংবা ফলমূল কুড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারছেন না৷ কাজেই তারা আগের মতো ‘মাটে' চায়ের চাষ শুরু করেছেন, তাদের পূর্বপুরুষরা যেমনটা করতেন৷
এক্টর রিভারোলা তাদের দেখান, কোথায় ‘মাটে' ভালোভাবে বাড়ে৷ এক্টর ডাব্লিউডাব্লিউএফ পরিবেশ সংগঠনের হয়ে কাজ করেন৷ এক্টর পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু চাষবাস আর জঙ্গলের কাজও বোঝেন৷ জঙ্গলের মাটিতে আর কোনো পুষ্টি নেই৷ মাটে গাছগুলো জঙ্গলের মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করে৷ প্যারাগুয়ের মানুষদের কাছে বুনো মাটে, জঙ্গলের মাটে আবার বিশেষ উপাদেয়৷ সারা দেশে মাটে চা খাওয়া হয়৷ এখানকার এই মাটে গাছগুলো আচে-দের একটা রোজগারের পথ খুলে দেবে৷
পুয়ের্তো বারা পল্লিতে ৪০টি পরিবারের বাস – এবং লোকসংখ্যা আরো বেড়েই চলেছে৷ পশুপালন ও ভুট্টা চাষ থেকে প্রধানত উপার্জন হয়৷ সেজন্য তাদের খানিকটা জঙ্গল কাটতে হয়েছে – স্রেফ বাঁচার প্রয়োজনে৷ পুয়ের্তো বারা আচে পল্লির হোসে কুয়াতেগি বলেন: ‘‘এই চাষবাস দিয়ে আমরা আমাদের পেট ভরাতে পারি৷ শুধু খাদ্য নয়, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা৷ এ ভাবে আমরা আমাদের পল্লির জন্য নানা উদ্যোগ নিতে পারি৷''
অন্যরা জমি বেচে দিয়েছে বড় খামারচাষি কিংবা কোম্পানিগুলোর কাছে৷ সে জমিতে আজ শুধু সয়াবিনের চাষ হয়৷ এক্টর রিভারোলা-র ভাষ্যে: ‘‘জমি বিক্রি করার জন্য উপজাতি মানুষদের সয়া উৎপাদনকারীদের চাপের মুখে পড়তে হয়৷ তারা আরো বেশি জমি কিনে নেয়, আরো দ্রুত বন কেটে আবাদ করে – আবার সেই টাকাতেই আরো জমি কেনে৷''
জার্মানদের কাছে চায়ের কদর
বাঙালির আড্ডা চা ছাড়া জমে না, জার্মানদের আড্ডায় কী থাকে জানেন কি?
ছবি: imago/Joachim Schulz
নানা স্বাদের চা
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চায়ের জনপ্রিয়তার কথা আমরা সকলেই জানি৷ আর বাঙালিদের আড্ডা মানেই ‘চা’৷ চায়ের সাথে সিঙাড়া, চানাচুর বা ঝালমুড়ি হলে তো কথাই নেই৷ তবে জার্মানরাও যে চা পান করতে পছন্দ করেন, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই৷ জার্মানিতে ১৯ শতকে রাশিয়া থেকে প্রথম চা আনার মধ্য দিয়েই চায়ের সাথে জার্মানদের পরিচয় ঘটে৷ আর বর্তমানে জার্মানিতে তিন হাজার রকমের চা পাওয়া যায়৷
ছবি: imago/imagebroker/Kröger
কফির পরিবর্তে চা
বেশির ভাগ জার্মান সকালে নাস্তার সাথে কফি পান করেন৷ কেউ কেউ বলেন, কফি ছাড়া নাকি তাদের ঘুমই ভাঙেনা৷ স্বাস্থ্য-সচেতন অনেক জার্মানই আজকাল চায়ের দিকে ঝুঁকছেন, চা’কে প্রাধান্য দিচ্ছেন৷ তবে শুধু সকাল আর বিকেল নয়, দিনের যে কোনো সময়ই জার্মানদের চা পান করতে দেখা যায়৷ যে কোনো ক্যাফেতেও কফির পাশাপাশি চা থাকে৷ এখানকার মানুষ চায়ের পুরো স্বাদ পেতে হালকা চা পছন্দ করেন৷
ছবি: Fotolia/yassend
সবুজ চা
চীন হলো চায়ের আদি জন্মস্থান৷ বেশিরভাগ গ্রিন টি আসে চীন থেকে৷ জার্মানরা গ্রিন টি বা সবুজ চা বেশ পছন্দ করেন, যাতে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা শরীরের জন্য প্রয়োজন৷ সবুজ চা’কে অনেক সময় জাদুর ওষুধ বলা হয়ে থাকে৷ যা নিয়মিত পান করলে ক্যানসার, আল্সহাইমার, ব্লাড প্রেশার, ডায়েবেটিস এর মতো কঠিন অসুখকে দূরে রাখতে সাহায্য করে৷
ছবি: Fotolia/gaai
বাংলাদেশের চা
চা আমদানী করা হয় ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, ইটালি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্যান্য অনেক দেশ থেকে৷ বাংলাদেশে ১৬৩টি চা বাগান রয়েছে৷ তার মধ্যে ১৪৮টি বাগানই শুধু সিলেটের বিভিন্ন এলাকায়৷ বাংলাদেশের চা ইংল্যান্ড, অ্যামেরিকা, জার্মানি ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হয়৷ হয়তো অতটা বিস্তৃত আকারে নয়, আর সে কারণেই হয়তো জার্মানির চায়ের দোকানে বাংলাদেশের লেবেল আটা চা কখনো চোখে পড়েনি৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
মেয়েদের জন্য বিশেষ ‘চা’
পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, দাঁত ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব বা এ ধরণের শরীর খারাপ লাগলে তার জন্যও রয়েছে ভেষজ চা৷ বলা যায়, মানুষের শরীরের যে কোনো ধরনের ছোটখাটো সমস্যা সারাতে রয়েছে নানা প্রকারের চা৷ প্রকৃতির এই অফুরন্ত দানের মধ্যে মেয়েদের জন্য রয়েছে ‘যোগী’ চা বা ‘পাওয়ার’ চা৷ জার্মানির অনেক ফিটনেস সেন্টারে যোগব্যায়ামের পর ‘ইয়োগী’ চায়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে৷
ছবি: Fotolia/Robert Kneschke
মন্ত্রীসভায় ‘চা’
জার্মান শিক্ষামন্ত্রী ইয়োহানা ভাংকা সাপ্তাহিক মন্ত্রীসভায় নিজের কাপে চা ঢালছেন৷
ছবি: Odd Andersen/AFP/Getty Images
কোনটা চাই, পাতা ‘চা’ না ‘টি’ ব্যাগ?
কাজ কম এবং দামে সস্তা বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টি ব্যাগ ব্যবহার করেন জার্মানরা৷ আর রয়েছে বিভিন্ন ফলের ফ্লেভার দেওয়া চা, ওয়াইট বা সাদা চা, আদা চা, লেবু চা৷ তবে সৌখিন চা প্রেমিরা পাতা চা দিয়েই চা তৈরি করেন৷ বলা বাহুল্য, সে চা খেতে অবশ্যই ভালো এবং দামেও তিন চারগুণ বেশি৷ চায়ের স্বাদ বজায় রাখতে সাধারণ চিনির বদলে মেশানো হয় ব্রাউন সুগার বা ক্যান্ডি সুগার৷ আমরা যাকে মিশ্রি বলে থাকি৷
ছবি: Mehr
বিশেষ চায়ের জন্য বিশেষ দোকান
প্রায় সব সুপারমার্কেটেই ৮ থেকে ১০ রকমের চা পাওয়া যায়, তবে চায়ের গুণগত মান বজায় রাখতে বিশেষ চায়ের জন্য রয়েছে আলাদা দোকান, যেখানে শুধুই চা বিক্রি করা হয়৷ নানা স্বাদ, রং আর গন্ধের চাইনিজ গ্রিন টি সৌখিন জার্মানরা পছন্দ করেন৷ যেমন ভালো জাতের গ্রিন টি ‘লুং শিং’-এর দাম কেজি প্রতি ৮০ ইউরো৷ গ্রিন টি ওজন কমাতে বা ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে সাহায্য করে বলে মেয়েদের কাছে বেশ প্রিয়৷
ছবি: cc-by-sa/Oskari Kettunen
‘চা’ শুধু পানীয় নয় – এর চেয়েও বেশি কিছু
জার্মানিতে শীতকালে চায়ের কদর অনেক বেশি৷ শীতের রাতে মোমের আলো আঁধারির রোম্যান্টিক পরিবেশে সুন্দর করে এক কেটলি চা বানিয়ে অনেকে আস্তে আস্তে তা পান করেন, বেশ রোম্যান্টিক পরিবেশে৷ কখনো বা চালিয়ে দেন ল্যাপটপে ভীষণ পছন্দের একটা ছবি, যেটা অনেকবারই হয়তো দেখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মসলা চা
শুধু শীতকালে বা বড়দিনের সময় বাজারে আসে মশলা চা৷ যাতে মেশানো থাকে আদা, এলাচ, দারুচিনি, লং, তেজপাতা জাতীয় গরম মশলা৷ বড়দিনের সময়টাতে বা প্রচণ্ড শীতে জার্মানদের কাছে এই চায়ের বেশ চাহিদা- যা নাকি শরীর গরম রাখতে খানিকটা সাহায্য করে৷
ছবি: DW/V.Kern
চা বানানোর রেসিপি
চায়ের বিশেষ দোকানগুলোতে চা কেনার সময়ই একটি তথ্যপুস্তিকা সাথে দিয়ে দেওয়া হয়৷ যাতে দেয়া থাকে কোন চায়ের পাতা কতক্ষণ গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে, বা গরম পানির তাপমাত্রা কত হলে চায়ের পুরো গুণাবলী বা স্বাদ থাকবে ইত্যাদি৷ চায়ের স্বাদ বা রং অনেক সময় চায়ের কাপ বা কেটলির ওপরও নির্ভর করে-এরকম পরামর্শও দেওয়া হয়ে থাকে৷ আবার কিছু কিছু দোকানে চা কেনার আগে টেস্ট করে দেখারও ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
চা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছেও প্রিয়
আজকাল সব দেশেই নানা ধরণের বিভিন্ন ডিজাইনের চায়ের সরঞ্জাম পাওয়া যায়৷ চা রাখার পাত্র বা চা পান করার পাত্রগুলোকে কখনো মনে হয় যেন ‘ডেকরেশন পিস’৷ অনেক জার্মান বাড়িতেই কয়েক রকমের চা দেখা যায়৷ যাদের ওজন নিয়ে সমস্যা তারা চায়ের প্রতি বেশি ঝুঁকছেন৷ তাই এই প্রজন্মের স্বাস্থ্য সচেতন ছেলেমেয়েদের কাছে চা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷
ছবি: Getty Images
শরীর এবং মনে এনে দেয় প্রশান্তি
বেছে নিন সুন্দর একটি কেটলি, ভেতরটা ফুটন্ত পানি দিয়ে ধুয়ে নিন৷ এক চা চামচ লুং শিং আর আধা চা চামচ দার্জিলিং চা মিশিয়ে কেটলিতে দিয়ে গরম পানি ঢেলে দিন৷ ২ থেকে তিন মিনিট ভিজিয়ে রেখে তুলে ফেলুন আর কেটলির চায়ে মিশিয়ে দিন কয়েক ফোটা তাজা লেবুর রস৷ মুখে দিন এক টুকরো ক্যান্ডি সুগার৷ সেই সাথে আস্তে আস্তে পান করুন এই মাত্র তৈরি করা চা৷ দেখবেন কিছুক্ষণ পর শরীরটা কেমন ঝরঝরে লাগছে৷ সেই সাথে মনটাও!
ছবি: imago/Joachim Schulz
13 ছবি1 | 13
সপ্তাহে দু'দিন শিকার
অ্যাটলান্টিক রেন ফরেস্টের মোট ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে আজও এমন সব সংরক্ষিত এলাকা আছে, যেখানকার পরিবেশ আজও অক্ষত, সেখানে আজও অনেক জীবজন্তু দেখতে পাওয়া যায়৷ আচে রেড ইন্ডিয়ান উপজাতির যে চার হাজার ছ'শো হেক্টর জঙ্গল আছে – সেই জঙ্গল থেকেই তারা বাঁচে৷ সপ্তাহে দু'দিন করে পুরুষেরা শিকারে যায়৷ তারা ঠিক জানে, কখন কোন জন্তুটিকে মারা চলবে৷ বহু শতাব্দী ধরে তারা এভাবেই শিকার করে আসছে৷ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার-এর পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা সবে কিছুদিন হলো আচে উপজাতির মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ এখানকার আচে-রা আজও প্রকৃতির কোলে বাস করেন৷ পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা সে কাজে তাদের সাহায্য করতে চান৷
আচে-রা যাতে আগের মতোই জঙ্গলে বসবাস করতে পারেন, সেজন্য ডাব্লিউডাব্লিউএফ-এর কর্মীরা তাদের চেনাচ্ছেন: কোন গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কোনগুলো কাটা চলবে: শুধু বড় বড় সয়া কোম্পানিগুলোর কাছে জমি বিক্রি না করলেই হলো৷ ডাব্লিউডাব্লিউএফ-এর প্যারাগুয়ে শাখার লুসি আকিনো বলেন:
‘‘মানুষরা যে নির্বিকারে গাছ কেটে চলে, পরিবেশের জন্য কিছুমাত্র কিছু না করে – তাতে আমার ভীষণ রাগ হয়৷ এ দেশে শিল্প-কলকারখানার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে, যার বলে ক্রমেই আরো বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে৷ যাদের টাকা আছে, তারা আরো বেশি চায়, আর গরিবরা ক্রমেই আরো বেশি গরিব হয়ে পড়ছে৷''
আচে-রা বড় বড় সয়া উৎপাদনকারীদের হাত থেকে তাদের জঙ্গল বাঁচাতে চায়৷ কিন্তু সেটা সম্ভব হবে কিনা, তা নির্ভর করবে পরবর্তী প্রজন্মের উপর৷