রোববার বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার তাতে তুরস্ক অংশ নিয়েছে বলে আর্মেনিয়ার অভিযোগ।
বিজ্ঞাপন
তুরস্ক তাদের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। নিহত হয়েছেন পাইলট। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে এ বার সরাসরি তুরস্কের দিকে আঙুল তুলল আর্মেনিয়া। তুরস্ক অবশ্য তাদের এই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে। তুরস্ক এবং আজারবাইজান দুই তরফই জানিয়েছে, সস্তা প্রোপাগান্ডার জন্যই এ ভাবে তুরস্ককে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে আর্মেনিয়া। অন্য দিকে সোমবারের পরে মঙ্গলবারও যুদ্ধ অব্যাহত প্রতিবেশী দুই দেশের। অভিযোগ, আর্মেনিয়া আজারবাইজানের একটি সীমান্ত অঞ্চলে শেলিং করেছে। অন্য দিকে আজারবাইজানও আর্মেনিয়ার একটি অঞ্চলে গুলি চালিয়েছে এবং বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। মঙ্গলবার দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষের শিকার হয়েছেন ১২ জন সাধারণ মানুষ। আহত ৩৫।
সোমবারই আর্মেনিয়া অভিযোগ করেছিল, তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানকে যুদ্ধে সাহায্য করছে। তুরস্ক পাল্টা উত্তর দিয়ে বলেছিল, বিতর্কিত অঞ্চল আজারবাইজানের। আর্মেনিয়া বেআইনি তা দখল করে রেখেছে। মঙ্গলবার ফের তুরস্কের দিকে আঙুল তুলল আর্মেনিয়া। অভিযোগ, আর্মেনিয়া বায়ুসেনার একটি এসইউ২৫ যুদ্ধবিমান তুরস্ক ধ্বংস করেছে। তুরস্কের এফ ১৬ যুদ্ধবিমান আকাশেই আর্মেনিয়ার যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে বলে অভিযোগ। বিবৃতি দিয়ে আর্মেনিয়ার সরকার এ খবর জানিয়েছে। বলা হয়েছে, ঘটনায় যুদ্ধবিমানের পাইলট নিহত হয়েছেন।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
তুরস্ক অবশ্য আর্মেনিয়ার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তুরস্ক এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। ফলে আর্মেনিয়ার যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার প্রশ্নই ওঠে না। এটা একান্তই আর্মেনিয়ার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। বস্তুত আজারবাইজানও আর্মেনিয়ার দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে। তারাও তুরস্কের মতোই বলেছে, আর্মেনিয়া মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করে বিশ্বের নজর কাড়তে চাইছে। তুরস্ক অবশ্য এ দিনও জানিয়েছে, বিতর্কিত অঞ্চল বেআইনি ভাবে আর্মেনিয়া দখল করে রেখেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একাধিক দেশ, রাশিয়া, চীন সকলেই আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের সাম্প্রতিক যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু যুযুধান দুইপক্ষ এখনও পর্যন্ত তাতে কান দেয়নি। আর্মেনিয়া মঙ্গলবারও দাবি করেছে, আজারবাইজান দীর্ঘদিন ধরেই এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা চাইছিল যুদ্ধ হোক। আজারবাইজান গত কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের সরঞ্জাম কিনেছে। ড্রোনের সাহায্যে সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতিও তারা আগেই নিয়েছে।
মঙ্গলবার আজারবাইজানের প্রতিরক্ষামন্ত্রক জানিয়েছে সীমান্তে দাসকেশান অঞ্চলে শেলিং করেছে আর্মেনিয়ার সেনা। অন্য দিকে আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রক জানিয়েছে সীমান্তে ভারদেনি অঞ্চলে গুলি চালিয়েছে আজারবাইজানের সেনা। একটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
গত দুই দিনে সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে। এ ভাবে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকলে আরও মানুষের মৃত্যু হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।