আর্মেনিয়ার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সেনা কাঠামো ধ্বংস করল আজারবাইজান। আজারবাইজানের প্রধানমন্ত্রী দাবি, আর্মেনিয়া তাদের তেলের লাইন ধ্বংসের চেষ্টা করছে।
বিজ্ঞাপন
আর্মেনিয়ার দুইটি রকেট লঞ্চপ্যাড ধ্বংস করলো আজারবাইজান। বুধবার আজারবাইজানের প্রশাসন এই দাবি করেছে। আর্মেনিয়াও আজারি দাবি মেনে নিয়েছে।
বুধবার আজারবাইজান জানায়, আর্মেনিয়ার একটি রকেট লঞ্চপ্যাড এবং একটি ব্যালেস্টিক মিসাইল সিস্টেম ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দাবি, ওই দুইটি লঞ্চপ্যাড থেকে গত কয়েক দিন ধরে আজারবাইজানের সাধারণ মানুষের উপর গোলাবর্ষণ করা হচ্ছিল। আর্মেনিয়া আজারবাইজানের এই দাবি মেনে নিয়েছে। তবে একই সঙ্গে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার দেশের সেনা কখনোই আজারবাইজানের সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেনি। কেবলমাত্র সেনা কাঠামোগুলিকেই টার্গেট করা হয়েছে।
নাগর্নো-কারাবাখে বিপদে সাধারণ মানুষ
নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ প্রবেশ করলো দশম দিনে৷ কিন্তু এখনও মিলছে না যুদ্ধবিরতির আভাস৷ দুই পক্ষের বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত হচ্ছে বসতবাড়িও৷ ঘটছে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের ঘটনা৷
ছবি: Reuters
প্রোপাগান্ডা চলছে
মাঠে চেয়ে বেশি লড়াই চলছে মুখে৷ দুই পক্ষই আশ্রয় নিচ্ছে বাগাড়ম্বরের৷ নিজেদের ছোঁড়া গোলায় সাধারণ মানুষ মারা গেলেও দুই পক্ষই অপর পক্ষকে দুষছে যুদ্ধের নিয়ম না মানার জন্য৷ হামলা নিয়ে দুই পক্ষের পালটা দাবিতে সংকট আরো বাড়ছে৷
ছবি: David Ghahramanyan/NKR InfoCenter/PAN Photo/Reuters
নাগরিক সেবা বন্ধ
কারবাখের প্রধান শহর স্টেপানকিয়ার্টে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে আজারবাইজান৷ এতে শহরটির বেশিরভাগ নাগরিক সেবা প্রায় বিধ্বস্ত৷ অনেক নাগরিকই বিদ্যুৎ, জলের সংকটে দিন কাটাচ্ছেন৷ ছবিতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
আজারাবাইজানে হামলা
আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী একাধিক শহরেও আর্মেনীয় বাহিনীর হামলার খবর পাওয়া গেছে৷ গ্যাঞ্জা শহরে হামলার কথা স্বীকার করেছে আর্মেনিয়াও৷ শহরটিতে হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকের হতাহতের খবরও পাওয়া গেছে৷
ছবি: Gor Kroyan/Reuters
নিত্যদিনের ভয়
বসতবাড়ি হারিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন বাঙ্কারে৷ কেউ কেউ যাওয়ার জায়গা না থাকায় আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তায়৷ ছবিতে রাস্তায় পড়ে থাকা বিধ্বস্ত একটি রকেটের ধ্বংসাবশেষ৷
ছবি: Reuters
পাহারায় বৃদ্ধা
বয়সের ভারে এই বৃদ্ধার নড়াচড়ারও সামর্থ্য নেই৷ নিজের বাসার দরজায় বসে আছেন বন্দুক হাতে৷ তবে মুখোমুখি সংঘর্ষের চেয়ে রকেট হামলাই এখন সবচেয়ে বড় ভয় স্টেপানকিয়ার্টের মানুষের কাছে৷
ছবি: Pablo Gonzalez/Agencia EFE/Imago Images
রাস্তাঘাটে রকেট
গত কয়েকদিনে এত বেশি রকেট হামলা হয়েছে শহরটিতে যে, এখন রাস্তা, মাঠ সর্বত্রই রকেট শেল পড়ে থাকতে দেখা যায়৷
নাগর্নো-কারাবাখের একটি শহর ও সাতটি গ্রাম পুনর্দখলের দাবি করেছে আজারবাইজন৷ কয়েকটি ভিডিওতে কারবাখের গ্রামে আজেরি সৈন্যদের পতাকা হাতে ঘুরতেও দেখা গেছে৷
ছবি: Karo Sahakyan/ArmGov/PAN Photo/Reuters
যুদ্ধবিরতি, সমঝোতা?
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুরু থেকেই দুই দেশকে যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়ে আসছে৷ তবে তাতে সাড়া মেলেনি৷ এরই মধ্যে দুই পক্ষ মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ৷
ছবি: via REUTERS
আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা
তুরস্ক এরই মধ্যে সরাসরি আজারবাইজানকে সমর্থন দিয়েছে৷ সীমান্তবর্তী ইরান এবং রাশিয়া দুই দেশকে আলোচনা ও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে৷ তবে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দীর্ঘদিন এ যুদ্ধ চলতে থাকলে প্রতিবেশী দেশগুলোও একসময় এতে জড়িয়ে পড়তে পারে৷ সেক্ষেত্রে বড় আকারের আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে৷
ছবি: Umit Bektas/Reuters
9 ছবি1 | 9
বাস্তব চিত্র অবশ্য ঠিক তেমন নয়। আজারবাইজানের একাধিক শহর আর্মেনিয়ার গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্যাঞ্জা সহ একাধিক শহর থেকে সাধারণ মানুষ পালিয়ে গিয়েছেন। বহু সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে, আজারবাইজানও একই কাজ করেছে। তাদের গোলায় কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে নাগর্নো-কারাবাখ। আর্মেনিয়ার হিসেব অনুযায়ী সব মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন অসংখ্যা মানুষ।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
রাশিয়া দুইটি দেশের কাছেই আরও একবার যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেছে। বস্তুত, গত শনিবার দুইটি দেশ মস্কোর মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল। প্রায় ১০ ঘণ্টা বৈঠকের পর দুইটি দেশই সাময়িক সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ফের দুই দেশই একের অপরকে আক্রমণ করতে শুরু করে। বুধবারেও গোলাবর্ষণ হয়েছে যথেষ্ট।
এরই মধ্যে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট তুরস্কের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আর্মেনিয়া এ বার আজারবাইজানের গ্যাস এবং তেলের লাইনগুলিকে টার্গেট করছে। সেখানে বিস্ফোরণ হলে আজারবাইজান যোগ্য জবাব দেবে। অন্য দিকে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তুরস্ক এবং আজারবাইজান যুদ্ধ বন্ধ করলে তাঁরাও সেই পথে হাঁটবেন। বস্তুত, বুধবার আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার স্বীকার করেছেন, যুদ্ধে দেশে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে সাধারণ মানুষও আছেন, সেনা জওয়ানরাও আছেন। এত দিন পর্যন্ত আর্মেনিয়া দাবি করছিল, তাদের দিকে পাঁচশর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়নি।