রোববারের পর সোমবারেও দুই দেশের সেনা যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে। নিহতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
যুদ্ধ থামার সামান্যতম ইঙ্গিত নেই। রোববারের পর সোমবার আরও ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার যুদ্ধ। এখনও পর্যন্ত ৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ১১ জন সাধারণ মানুষ।
বিতর্ক অনেক দিনের। ২০১৬ সালে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান সীমান্তে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে শেষ বড়সড় সংঘর্ষ হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে। রোববার ফের ওই অঞ্চলের দখল নিয়ে দুই দেশ কার্যত যুদ্ধে নেমে পড়েছে। দুই দেশের সেনাই সীমান্তে জড়ো হয়েছে। লাগাতার গোলাগুলি চলছে। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে নাগর্নো-কারাবাখ মুক্তাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধারাও রয়েছে। এখনো পর্যন্ত যুদ্ধে তাদেরই সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। যোদ্ধাদের সূত্র জানিয়েছে, শুধুমাত্র সোমবারের লড়াইয়ে তাদের ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার এবং সোমবার মিলিয়ে নিহত হয়েছেন ৮৪ জন।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
সাবেক দুই সোভিয়েত রাষ্ট্র আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরের দুইটি অঞ্চল ছিল। সোভিয়েতের পতনের পর এই দুইটি রাষ্ট্র আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু সীমান্তের নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। আজারবাইজানের অভিযোগ, বোইনি ভাবে ওই অঞ্চলের দখল রেখেছে আর্মেনিয়া। আর্মেনিয়ার বক্তব্য, নাগর্নো-কারাবাখ মুক্তাঞ্চল। বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরই দখলে রয়েছে এলাকা। ২০১৬ সালেও এই নিয়ে কার্যত যুদ্ধ শুরু হয়েছিল দু'টি দেশের মধ্যে। তবে রোববার থেকে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তা অতীতের সমস্ত সংঘাতকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দুইটি দেশেই মার্শাল আইন চালু হয়ছে। অর্থাৎ, যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য সেনার বিশেষ আইন বলবৎ হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ অবশ্য এই যুদ্ধ বন্ধের আবেদন জানিয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছে। মূলত ফ্রান্স এবং জার্মানির আবেদনের ভিত্তিতেই ওই বৈঠক ডাকা হয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ জানিয়েছে, বন্ধ ঘরে ওই বৈঠক হবে। সকলে শুনতে পারবেন না।
রাশিয়া অবিলম্বে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ বন্ধের আবেদন জানিয়েছে। চীনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্রও দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ দুই দেশের প্রতিনিধিকে অস্ত্র ছেড়ে বৈঠকে বসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু আপাতত অস্ত্র ছাড়ার ইঙ্গিত দু'টি দেশই দেয়নি।
অভিযোগ, এই যুদ্ধের পিছনে হাত রয়েছে তুরস্ক এবং সিরিয়ার। সিরিয়া বহু যোদ্ধাকে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সীমান্তে পাঠিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। অন্য দিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান বলেছেন, বিতর্কিত অঞ্চল থেকে আর্মেনিয়াকে সরে যেতে হবে। নইলে তাদের উপর আরও চাপ তৈরি করা হবে। অর্থাৎ, এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন করছে তুরস্ক।