১৯১৫-১৭ সালে অটোমান সাম্রাজ্যে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর হত্যালীলাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে জার্মান সংসদ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷
বিজ্ঞাপন
অতীতের কুকর্ম স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া ও সম্ভব হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ যে কোনো রাষ্ট্রের পরিণত চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটায়৷ নাৎসি আমলে জার্মানির ইহুদি নিধন যজ্ঞে ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষকে ঠান্ডা মাথায় যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, আজকের জার্মানি এখনো তার প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে৷
অনেকের মতে, গত শতাব্দীতে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও জার্মানি তার ঐতিহাসিক দায় এড়াতে পারে না, কারণ, জার্মানি তখন অটোমান সাম্রাজ্যের সহযোগী ছিল৷ এমনকি খোদ হিটলার আর্মেনীয়দের গণহত্যা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার অভাব থেকে শিক্ষা নিয়ে ইহুদি নিধন যজ্ঞ চালানোর উৎসাহ পেয়েছিলেন বলে কিছু মহলে অভিযোগ ওঠে৷
সেই ঘটনার প্রায় ১০০ বছর পর জার্মান সংসদ এই মর্মে এক প্রস্তাব অনুমোদন করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ বলা বাহুল্য, তুরস্ক এই উদ্যোগের প্রবল বিরোধিতা করছে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে জার্মানিকে সাবধান করে দিচ্ছে৷
আর্মেনিয়া অবশ্য জার্মানির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তুরস্কের চাপ উপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে৷
জার্মান সংসদের এই উদ্যোগ অবশ্যই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়৷ ডয়চে ভেলে এর পক্ষে ও বিপক্ষে দু'টি সংবাদভাষ্য প্রকাশ করেছে৷
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
গত শতাব্দীর শুরুতে বিশাল এক এলাকা ছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে৷ তার পূর্ব প্রান্তের প্রদেশে ছিল আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৭ থেকে ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাস৷ সেটা ১৯১৫ সাল৷ তাদের আনুগত্য নিয়ে অটোমান কর্তৃপক্ষের মনে আগেই সংশয় দেখা দিয়েছিল, কারণ, স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেই আর্মেনীয়দের এক জাতীয় আন্দোলন শুরু হয়েছিল৷ সে সময়েই ১ থেকে ৩ লক্ষ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয় বলে ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন৷
১৯১৪ সালে অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়৷ সেই সময় আর্মেনীয়দের ‘ঘরশত্রু'-র তকমা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা অভিযান শুরু হয়৷ দু'টি আইন অনুমোদন করে আর্মেনীয়দের ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করে তাদের স্থানান্তর শুরু করে অটোমান কর্তৃপক্ষ৷ নানাভাবে তাদের বিরুদ্ধে হত্যালীলা চালানো হয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
এখনকার রাষ্ট্র আর্মেনিয়ার হিসেব অনুযায়ী ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ৷ অতএব এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে আর্মেনিয়া মনে করে৷
প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের নেতৃত্বে আজকের তুরস্ক ‘গণহত্যা' শব্দটির চরম বিরোধী৷ তাদের বয়ান অনুযায়ী, সে সময়ে গৃহযুদ্ধের কারণে ৩ থেকে ৫ লক্ষ আর্মেনীয় এবং প্রায় সমান সংখ্যক তুর্কি প্রাণ হারিয়েছিল৷ অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গণজাগরণের সময় আর্মেনীয়রা হামলাকারী রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল৷ এমনকি ২০১৪ সালে এর্দোয়ান এই ঘটনা সম্পর্কে শোক প্রকাশ করে আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্যে ওই অধ্যায়কে ‘দুই দেশের সম্মিলিত কষ্ট' হিসেবে মেনে নেয়ার আহ্বান জানান৷ আর্মেনিয়া অবশ্য সেই বয়ান প্রত্যাখ্যান করে৷
হলোকস্টের স্মরণে জার্মানি যা করেছে, করছে
১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ইউরোপে৷ এরপর থেকে হলোকস্টের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মরণে রাখতে এই গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করে আসছে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
ডাখাউ
মিউনিখের কাছে ডাখাউ-এ প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল নাৎসিরা৷ আডল্ফ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর গড়ে তোলা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী বা এসএস-এর সদস্যরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সেই ইহুদি নিধন শিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বন্দি করতো৷ তারপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো তাঁদের৷ পরবর্তীতে নাৎসিদের স্থাপন করা অন্যান্য ক্যাম্পগুলো ঐ ডাখাউ-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসিদের ব়্যালি গ্রাউন্ড
ন্যুরেমব্যার্গে নাৎসি আমলের সবচেয়ে বড় প্রচারণা ব়্যালিটি অনুষ্ঠিত হতো৷ প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা একটি ‘গ্রাউন্ডে’ নাৎসিদের বার্ষিক কংগ্রেস এবং এই ব়্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন৷ ছবিতে অসমাপ্ত কংগ্রেস হলটি দেখতে পাচ্ছেন৷ এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর এবং ডকুমেন্টেশন সেন্টার৷
ছবি: picture-alliance/Daniel Karmann
হলোকস্টের মূল পরিকল্পনা
বার্লিনের ভানজে লেক এলাকার এই ‘ভানজে হাউস’-টিতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল৷ নাৎসি সরকার ও এসএস বাহিনীর মোট ১৫ জন সদস্য ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি এই ভবনে মিলিত হয়ে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ জার্মান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সব ইহুদিদের তাড়ানো ও তাঁদের শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এখানেই৷ ১৯৯২ সাল থেকে ভবনটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনে ফ্রাঙ্কের স্মৃতি বিজড়িত
আনে ফ্রাঙ্ককে এখন অনেকেই চেনেন৷ তাঁর ডাইরিও পড়েছেন অনেকে৷ আনে ফ্রাঙ্ক সহ প্রায় ৫০ হাজার ইহুদিকে ব্যার্গেন-বেলজেনের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/Klaus Nowottnick
হিটলারকে মারার ব্যর্থ পরিকল্পনা
জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অপশাসন প্রতিরোধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ-এর নেতৃত্বে একটি দল হিটলারের ওপর বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু হত্যা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলে, সেই রাতেই বার্লিনের এই ‘বেন্ডলারব্লক’ ভবনে স্টাউফেনব্যার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এই ভবনটি এখন ‘জার্মান রেসিস্টেন্স মেমোরিয়াল সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হত্যা স্মরণ
হেসে রাজ্যের হাডামারে একটি হাসপাতালের প্রায় ১৫ হাজার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়৷ এরকম ‘অক্ষমদের’ নাৎসি সরকার ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণা করেছিল৷ তাই তাঁদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষাক্ত ওষুধ প্রবেশ করানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়৷ পুরো জার্মানিতে এভাবে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধীকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী৷ পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে হাডামারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিস্তম্ভ
হলোকস্টের স্মরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৬০ বছর পর, বার্লিনের ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কাছে ‘মেমোরিয়াল টু দ্য মার্ডার্ড জিউস অফ ইউরোপ’ নামের এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়৷ নিহতদের স্মরণে সেখানে কংক্রিটের ২,৭১১টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে৷ ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, এমন বহু মানুষের নামও লেখা আছে একটি জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমকামী হত্যা স্মরণ
বার্লিনের ঐ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘টিয়ারগার্টেন’ নামক একটি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে চার মিটার উঁচু এই স্মৃতিফলক৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিদের হাতে নিহত সমকামীদের স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়৷ এই স্তম্ভের মধ্যে থাকা একটি পর্দায় চোখ রাখলে দুটি ছবি দেখা যায়৷ একটিতে চুমু খাচ্ছেন দু’জন পুরুষ, অন্যটিতে দুই নারী৷
ছবি: picture alliance/Markus C. Hurek
সিন্টি ও রোমা হত্যা স্মরণ
বার্লিনের সংসদ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে ২০১২ সালে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়৷ নাৎসি আমলে নিহত প্রায় পাঁচ লক্ষ সিন্টি ও রোমার স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মতিস্মারক হিসেবে ‘শ্টলপারশ্টাইন’
নব্বইয়ের দশকে শিল্পী গুন্টার ডেমনিগ নাৎসি নির্যাতনের শিকাররা যে সব বাড়িতে বাস করতেন, সেগুলোর সামনে রাস্তার ওপর সোনালি পাতের ছবির মতো এই স্মৃতিস্মারক বসানো শুরু করেন৷ এতে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাঁর নাম, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার তারিখ লেখা আছে৷ ইউরোপের ১৮টি দেশে এরকম ৪৫ হাজারেরও বেশি ‘শ্টলপারশ্টাইন’ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউনিখের ব্রাউন হাউস
নাৎসি আমল শেষের এত বছর পরও সে সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তৎপর জার্মানি৷ তাই তো ৩০ এপ্রিল, ২০১৫-তে আরও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে জার্মানি৷ মিউনিখ শহরে হিটলারের অফিসের অদূরে যেখানে নাৎসিদের প্রধান কার্যালয় ছিল, সেই ব্রাউন হাউসে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার ফর দ্য হিস্টরি অফ ন্যাশনাল সোশ্যালিজম’ নামের এই সেন্টারটির উদ্বোধন করা হবে৷