সাত জানুয়ারি ২০১১ সালের একটি ছবি৷ সীমান্তের কাঁটাতারে উল্টো হয়ে ঝুলছে কিশোরী ফেলানী৷ অদূরে দাড়িয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দুই সদস্য৷
বিজ্ঞাপন
তুরস্কের সৈকতে ভেসে আসা সিরিয়ার তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দির ছবিটি নিশ্চয়ই সবার মনে আছে৷ ফেলানীর মত আয়লানের গায়ের জামাটিও ছিল লাল রংয়ের৷ পার্থক্য আয়লানের ছবি গোটা ইউরোপের নিষ্ঠুর শরণার্থী নীতিকে বদলে দিয়েছিল৷ কিন্তু তোলপাড় হলেও ফেলানীর ছবি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বর্বরতার চিত্রে বদল ঘটাতে পারেনি৷ গত এক দশকে বিএসএফের বন্দুকের নিশানায় পরিণত হয়েছেন চাপাই, নওগাঁ, রাজশাহী, লালমনিরহাটের সীমান্তের কয়েকশো মানুষ৷
ফেলানী হত্যার নবম বছর র্পূতির ঠিক একদিন পরই চাপাই সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ (যুগান্তর অনলাইন সংস্করণ, ৯ জানুয়ারি)৷ সবশেষ গত দুইদিনে ঝরেছে আরো পাঁচ জনের প্রাণ৷
এরমধ্যে গতকাল (বৃহস্পতিবার) নওগাঁর দুয়ারপাল সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন তিন বাংলাদেশি৷ ঠিক সেইদিন রাজধানীর একটি হোটেলে ভারতীয় ঋণের (এলওসি) আওতায় দুইটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশটির ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ৷ সমকালের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থল বন্দর মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের দুইটি প্যাকেজের চুক্তি সই হয় সেখানে৷ যেখানে ভারত ২ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা ঋণ দিবে৷ বাংলাদেশের সরকার অর্থায়ন করবে ১ হাজার ৩১২ কোটি টাকা৷ সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ‘রক্তের রাখি বন্ধনে’ আবদ্ধ বাংলাদেশ৷’’
বাংলাদেশের জন্য এই ঋণ কতটা জরুরি, যেই সড়ক উন্নয়ন করা হচ্ছে সেটি বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের পণ্য ট্রানজিটের জন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ কীনা এমন বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে৷ কিন্তু দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে যে উষ্ণতার সম্পর্ক বিরাজমান তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ ২০১৯ সালে একটি দেশের সীমান্তরক্ষীর হাতে আরেকটি দেশের ৪৩ জন নাগরিকের মৃত্যু (সূত্র, আইন ও সালিশ কেন্দ্র) কিংবা এক দশকে ৪৫৫ জনকে হত্যা (সূত্র, অধিকার) সেখানে কোনো আঁচই লাগতে দেয়নি৷ প্রশ্ন ওঠে দুই দেশের রাষ্ট্রীর পর্যায়ে এ নিয়ে আদৌ কোন আলোচনা হয়? নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গটি কি কখনও তুলেছেন?
আপাতদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ কেমন আচরণ করবে তা বাহিনীটির হাতেই ছেড়ে দিয়েছে ভারত৷ অন্যদিকে বাংলাদেশও তা মীমাংসার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে বিজিবির উপরই৷ ফলাফল, এক একটি মৃত্যুর পর বিজিবির মৌখিক প্রতিবাদ, বিএসএফের বড়জোর দুঃখপ্রকাশ৷
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঋণ চুক্তি হয়, ডজন ডজন সমঝোতা স্বাক্ষর হয়, এক দেশ আরেক দেশের কতটা কাছের তা নিয়ে দুই সরকারের প্রশংসার বিনিময় চলে৷ সীমান্ত হত্যাই শুধু বন্ধ হয় না৷ দুই দেশের সরকারই এই বিষয়ে অবাক করা নিরবতা আর নিষ্ঠুর উদাসীনতার পথ বেছে নিয়েছে যেন৷ নাগরিকের জীবনকে পাশ কাটিয়ে এই উষ্ণতা প্রদর্শনের প্রচেষ্টা কি দিনকে দিন মেকি হয়ে যাচ্ছে না? আপাত বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমান্তে এমন যুদ্ধ পরিস্থিতির পরিসংখ্যান মানুষের মনে যে ক্ষতের জন্ম দিচ্ছে তা কোনো দেশের জন্যেই মঙ্গল নয়৷ দুই দেশের সরকারের এই বোধ জাগ্রত হোক ঠিক এখনই, আর একটিও প্রাণ ঝরবার আগেই৷
এক্ষেত্রে ভারতে যৌক্তিক আচরণ যেমন কাম্য, তেমনি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের সরকারেরও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন৷ কেন সীমান্তের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তার আর্থ সামাজিক কারণটিও খতিয়ে দেখা হোক৷
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷