আর কত মৃত্যু হলে নিশ্চিত হবে ছাত্র সুরক্ষা?
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) রাতে যাদবপুরে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এ নিয়েই শুরু হয়েছে নয়া বিতর্ক।
ক্যাম্পাসের চার নম্বর গেটের কাছে রাত ১০টা নাগাদ আর্ট ফ্যাকাল্টি ইউনিয়ন রুমের সামনের জলাশয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অনামিকা মন্ডলকে। ২১ বছরের অনামিকা ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।
যে জায়গা থেকে অনামিকাকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সেই স্থান সিসিটিভির আওতায় নেই। এর ফলে সেদিন রাতে কী হয়েছিল, কীভাবে ওই ছাত্রী পুকুরের ধারে গেলেন, পড়ে গিয়েছিলেন কি না, এ ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন থাকলেও তার জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন, পুলিশ বাধা পাচ্ছে তদন্তে
ঘটনার দিন রাতে ড্রামা ক্লাবের অনুষ্ঠান ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, অনামিকা অনুষ্ঠানে ছিলেন। তারপর তিনি কোথায় গেলেন, তার সঙ্গে কারা ছিলেন, এ ব্যাপারে স্পষ্ট তথ্য এখনো মেলেনি।
অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছে পুলিশ। তাদের প্রাথমিক অনুমান, জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে অনামিকার। শরীরের বাইরে আঘাতের চিহ্ন নেই। গোয়েন্দা বিভাগ ও ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে।
ক্যাম্পাসের ভিতরেই এক পড়ুয়ার মৃত্যুতে ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য অমিতাভ দত্ত সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, "নিরাপত্তার সমস্যা আছে। আমরা সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। ইতিমধ্যে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেই ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়।"
যাদবপুরের নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা নতুন নয়। অতীতেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে দুই বছর আগে ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডুর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। মেন হোস্টেলে তাকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল পড়ুয়াদের বিরুদ্ধেই। এরপর সিসিটিভি বসানো থেকে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগের দাবি জোরালো হয়। সিসিটিভি থাকলে অনামিকার মৃত্যুর রহস্য এতক্ষণে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যেত বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু অভিযোগ, পড়ুয়াদের একাংশই সিসিটিভি সর্বত্র লাগানোর বিরোধী। তারা একে রাষ্ট্রের নজরদারি হিসেবে দেখছেন। ক্যাম্পাস সূত্রে খবর, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাত পর্যন্ত নেশার আসর বসে। এখানে যেমন পড়ুয়ারা থাকেন, তেমনি দেখা যায় বহিরাগতদের। অভিযোগ উঠেছে, ওপেন এয়ার থিয়েটার থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট আর্টস বিল্ডিং চত্বরে বসে অনেকে নেশা করেন।
মৃত ছাত্রী অনামিকা নেশার ঘোরে জলে পড়ে গিয়েছেন কি না, সেটা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তার দেহের নমুনার ভিসেরা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এমন সন্দেহের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক সংশয়। প্রশ্ন উঠেছে, ড্রামা ক্লাবের অনুষ্ঠানে যারা ছিলেন, তারা কেন অনামিকার ব্যাপারে কিছু বলতে পারছেন না? ছাত্রীকে অচৈতন্য অবস্থায় কারা প্রথম দেখতে পান? হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়ার পরে আরো দুজন পড়ুয়া অচৈতন্য হয়ে পড়েন বলে সূত্রের খবর। তারা কি নেশাগ্রস্ত ছিলেন?
আদালতের নির্দেশে উদ্যোগ
সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি লাগানোর ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিল। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে আর্থিক সাহায্য করার কথাও বলেছিল আদালত। এই নির্দেশের পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আরো ৭০টি সিসিটিভি বসানো হবে। নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যাও বাড়ানো হবে। এজন্য খরচ হবে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটার সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় সংবাদ মাধ্যমে বলেন, "সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ ও সিসিটিভির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বাজেট তৈরি করে রাজ্য সরকারকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো সেখান থেকে জবাব পাওয়া যায়নি।"
ছাত্রীর মৃত্যুর পরে ফের কঠোর নির্দেশিকা জারি করেছেন কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসের মধ্যে নেশা করার সময়ে ধরা পড়লে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনেক সাধারণ মানুষ দুই বেলাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাঁটেন। তারা আর হাঁটতে পারবেন না। ছাত্রদের একাংশের দাবি, অতীতে এই ধরনের নির্দেশিকা জারি হলেও বাস্তবের ছবিটা বদলায়নি।
ছাত্র শিবিরে তরজা
স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পরে দুই বছর কেটে গেলেও কেন পর্যাপ্ত সংখ্যায় সিসিটিভি লাগানো হয়নি, এ প্রশ্ন উঠছে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ শুক্রবার এ ব্যাপারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ডেপুটেশন দেয়। তাদের দাবি, বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় সিসিটিভি লাগাতে বাধা দিচ্ছে। তাদের জন্যই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
রাজ্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্বের গবেষক সঞ্জীব প্রামাণিক ডিডাব্লিউকে বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষকে বলে আসছি ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ করা দরকার। যেহেতু দুটো মৃত্যু ঘটে গিয়েছে, তাই শুধু কর্তৃপক্ষকে বলার মধ্যে আটকে থাকবো না। আমরা বিষয়টি নিয়ে সমস্ত স্তরে অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক গবেষক কর্মচারী সবার সাথে আলোচনা করছি যে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি আমরা। এইবার দাঁড়িয়ে কোথাও অন্তত একটা রাশ টানা হোক। সহ উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। সিপিএমের শিক্ষক সংগঠন, এসএফআই এবং কিছু বামপন্থী সংগঠন তারা এসব চায় না। ছাত্র-ছাত্রীদের বিপথে চালনা করেই তাদের সমর্থন পায় এরা।"
গেরুয়া শিবিরের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ছাত্রী মৃত্যুর প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে বিক্ষোভ দেখায়। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় নেশার আসর বন্ধ করতেই হবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্রী ও এবিভিপি সদস্য পাপিয়া সেন ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাবেন না যে সিসিটিভি নেই। সিসিটিভি লাগালে নাকি ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রীকে সুরক্ষা দেওয়া। তারা সুরক্ষা দিতে পারছেন না। আবার ক্যাম্পাসের গেট রাত্রি দুটো পর্যন্ত সারারাত মানুষের জন্য খোলা থাকে। এটা কোন বিশ্ববিদ্যালয় ঘটে?"
মনো সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, "ছাত্রীর মৃত্যু দুর্ঘটনা না অন্য কিছু সেটা আমরা জানি না। সেটা তদন্তে উঠে আসবে। তবে ক্যাম্পাসে যদি নেশার আসর বসে, তার দায়িত্ব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। আমরা সরকারকে প্রশ্ন করি না, এত মদের দোকান আশপাশে হচ্ছে কেন। এছাড়া যেসব নিষিদ্ধ মাদকের কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলো ক্যাম্পাসে আসছে কী করে, নারকোটিক ব্যুরো তাদের দায়িত্ব পালন করছে কি না, সেটা দেখতে হবে।"
এ সব ছাপিয়ে সিসিটিভি বিতর্ক বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএফআই আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক সৌগত তরফদার ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা সিসিটিভি লাগানোর বিরুদ্ধে নই। নজরদারির বিরুদ্ধে। স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পরেও আমরা একথা বলেছিলাম। কোনটা পাবলিক ও কোনটা প্রাইভেট এলাকা, সেটাকে পৃথক করে সিসিটিভি বসাতে হবে। সব জায়গায় সিসিটিভি লাগানো মানে সর্বক্ষণ নজরদারির আওতায় রাখা। নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা যে কম, সেটা বলা হচ্ছে না। সেদিনের অনুষ্ঠানের সময়ে চার নম্বর গেটে একজন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন, অনুষ্ঠানে কেউ ছিলেন না। পর্যাপ্ত সংখ্যায় নিরাপত্তারক্ষী না থাকায় সমস্যা হচ্ছে।"
মোহিত বলেন, "সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। এতে বোঝা যাবে, কীভাবে একটা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ঘটনাকে রোখার চেষ্টা থাকতে হবে। পারস্পরিক সহানুভূতির পরিবেশ ক্যাম্পাসে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগে ঘাটতি আছে।"