তালাক, তালাক, তালাক – শুনলেই মনে পড়ে যায় ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘নিকাহ'-র কথা৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন যে শুধুমাত্র একটি শব্দের তিনবার উচ্চারণে ভেঙে যেতে পারে, সেটা প্রথমবার ঐ ছবিতেই দেখেছিলাম, হয়েছিলাম বিস্মিত৷
বিজ্ঞাপন
আর সে বিস্ময় আমার আজও কাটে না, যখন দেখি পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এই তিন তালাকের প্রথা বা ‘তালাক-ই-বিদায়ী' বিবাহবিচ্ছেদ আইনত বন্ধ হয়ে গেলেও, ভারতে থেকে গেছে৷ আজও ভারতবর্ষের মুসলিম আইনে পুরুষের জন্য রয়েছে বিবাহবিচ্ছেদের একক ইচ্ছার আইন, অর্থাৎ তালাক দেয়ার ‘লাইসেন্স'৷ মধ্যযুগীয় এই আইন অনুযায়ী, যে কোনো সময়ে বিবাহ অস্বীকার করতে পারে একজন স্বামী৷ আর এর জন্য অভিযোগ নিয়ে আদালতে যাওয়া বা স্ত্রীর প্রতি আনা অভিযোগ প্রমাণ করারও প্রয়োজন নেই তাঁর৷ ‘তালাক' – এই শব্দটা তিনবার উচ্চারণ করলেই কেল্লা ফতে!
ভালোবাসার যত্ন
‘ভালোবাসা’-র মানুষকে কাছে পাওয়ার জন্য প্রথমদিকে যেমন আবেগ, উৎসাহ আর আগ্রহ থাকে, ধীরে ধীরে তেমনই তা ম্লান হয়ে যায় যা খুবই স্বাভাবিক৷ তারপরও কীভাবে সম্পর্ককে মধুর, আনন্দময় রাখা যায় – সে বিষয়ে এই ছবিঘরে পাবেন কিছু ‘টিপস’৷
ছবি: Highlight
মিলেমিশে কাজ করা
প্রায়ই দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে একসাথে বাইরে থেকে ফিরলেন৷ কিন্তু খাবার তৈরি বা সংসারের অন্য কাজে লেগে গেলেন স্ত্রী৷ আর স্বামী টিভি চালিয়ে বসলেন সোফায়৷ এমনটা না করে বরং সংসারের কাজকর্ম দু’জনে মিলেমিশে শেষ করে, পরে একসাথে দু’জন মিলে টিভি দেখুন বা গল্প করুন৷ সারাদিন কে কী করলেন একে অপরেকে জানান৷
ছবি: Fotolia/Yuri Arcurs
ক্রুটি বড় করে না দেখা
একসাথে থাকতে গেলে অনেক সময় ছোটখাটো অভ্যাসগুলো অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ একজন হয়ত সব সময় মোজা খুলে বিছানায় রেখে দেন৷ অপরজন চুথপেস্টের ঢাকনা লাগাতে যান ভুলে৷ অনেক পরিবারে এ সব ছোটখানো বিষয় নিয়ে অযথা ঝগড়া শুরু হয়৷ তাই এই সব বিষয়গুলো এড়িয়ে চললে জীবন কিন্তু অনেক মধুর হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/dkimages
স্বীকৃতি
সব মানুষই মাঝে মাঝে তাঁর কাজের স্বীকৃতি চায়, এমনকি সংসারের কাজের ক্ষেত্রেও৷ তাই মাঝে মধ্যে একে অপরকে সে কথা জানান৷ আরো রোম্যান্টিক হয়, যদি কথাটা জানানো যায় ছোট্ট একটি ‘নোট’ লিখে অথবা এসএমএস-এর মারফত৷ দেখবেন পরের দিন কাজের আগ্রহ তো বাড়বেই, তার সঙ্গে আপন মানুষটিকে মনে হবে আরো কাছের৷
ছবি: Fotolia/mars
প্রশংসা
অনেকদিন একসাথে থাকার ফলে সব কিছুই কেমন যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে যায়৷ তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, নতুন পোশাক বা হেয়ার স্টাইলে আপনার সঙ্গিকে সুন্দর লাগছে – এ কথা বলতে একদম সংকোচ করবেন না৷ আসলে এমন ছোটখাটো প্রশংসার ‘এফেক্ট’ কিন্তু অনেক বড় হয়৷ অর্থাৎ ‘প্রশংসা ছোট তবে তার এফেক্ট বড়’৷
ছবি: Fotolia/Subbotina Anna
ভালোবাসার স্পর্শ
ভালোবাসা গাছের মতো, যত যত্ন করা যাবে ততই বাড়বে৷ ভালোবাসার স্পর্শে ডালপালা ফলে-ফুলে ভরে যায়, আর অযত্নে যায় শুকিয়ে৷ অনেক দম্পতি মনে করেন, ‘ভালোই তো আছি, আবার ভালোবাসা দেখাতে হবে কেন? অথচ ভালোবাসা দেখালে দাম্পত্য জীবন হতে পারে মধুময়৷ ঠিক গাছের মতোই যত্ন নিন৷ হঠাৎ করেই ফুল বা ছোটখাটো উপহার দিয়ে আপনার প্রিয়া বা প্রিয়তমকে দিন চমকে!
ছবি: Nelson Almeida/AFP/Getty Images
‘হবি’ বা সখ
মাঝে মাঝে কখনো নিজেরা একসাথে এমন কিছু করুন, যাতে অন্য ধরণের গল্প বা আলোচনা হতে পারে৷ একসাথে সাইকেল চালাতে বা হাঁটতে যেতে পারেন৷ খোলা আকাশের নীচে প্রাণ খুলে হাসুন বা কথা বলুন৷ একে অপরের সাথে সব কিছু ভাগাভাগি করার নামই যে বন্ধুত্ব, আর সেটাই তো দীর্ঘ ও সুখি দাম্পত্যের আসল কথা৷
ছবি: Foto: Ahrtal-Tourismus Bad Neuenahr-Ahrweiler e.V.
রাগ পুষে রাখতে নেই
রাগ, অভিমান ছাড়া কি দাম্পত্য জীবন মধুর হয়? রাগ, দুঃখ, অভিমান তো থাকবেই৷ কিন্তু তাই বলে রাগ যেন বেশিক্ষণ না থাকে৷ দিনের শেষে রাগ ভুলে অপরের কাছে এগিযে যান৷ রাগ বা মান ভাঙানোর উত্তম সময় সেটা৷ তা না হলে দু’জনকেই হয়ত না ঘুমিয়ে সারাটা রাত কাটাতে হবে, যার প্রভাব পড়বে পরবর্তীতেও৷
ছবি: Fotolia/drubig-photo
কিছুটা দূরত্ব
মাঝে মধ্যে দাম্পত্য জীবনের সব কিছুই একঘেয়েমি মনে হতে পারে৷ তাই স্বামী তাঁর সহকর্মী বা পুরনো বন্ধুদের সাথে কখনো আড্ডায় যেতে পারেন৷ স্ত্রী তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু-বান্ধবী বা কাছের কোনো মানুষের সাথে শপিং বা সিনেমা দেখতে যেতে পারেন৷ এতে নিজেদের অনেকটা হালকা মনে হবে৷ মাঝে মাঝে একটু দূরত্ব কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একে-অপরকে কাছে পাওয়ার আনন্দ বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
বিবাহিত জীবনের জন্য পুরস্কার
দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের জন্য বেশ কয়েকটি দেশে পুরস্কার দেওয়ার রীতি রয়েছে৷ পোল্যান্ডের কোনো দম্পতির ৫০ বছর পূর্ণ হলে তাঁদের প্রেসিডেন্ট পদক দেওয়া হয়৷ অ্যামেরিকায় ৫০ বছর হলে হোয়াইট হাউস থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়৷ আর ইংল্যান্ডে ৬০ বছরের বিবাহবার্ষিকী পালন করা কোনো দম্পতিকে রানির কাছ থেকে বার্তা পাঠানো হয়৷
ছবি: Fotolia/contrastwerkstatt
ঝগড়া এড়িয়ে চলুন!
ঝগড়া অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে৷ ডেনমার্কের কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন যে, যাঁরা খুব বেশি ঝগড়া করেন তাঁদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি৷ কাজেই ঝগড়া এড়িয়ে চলুন!
ছবি: goodluz - Fotolia
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পরে
খাওয়ার আগে কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যাবেন না৷ পারলে মিষ্টি কিছু খেয়ে নেবেন৷ কারণ ওহাইয়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞনীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, শরীরে শর্করার পরিমাণ কম হলে একে-অপরের প্রতি রাগ, ক্রোধ কেমন যেন আক্রমণাত্বক হয়ে ওঠে৷ বলা বাহুল্য, গ্লুকোজ বা শর্করা মানুষের শরীরে জ্বালানির মতো কাজ করে৷
ছবি: Highlight
11 ছবি1 | 11
এখানে বলে রাখে দরকার, শরিয়তেও কিন্তু তালাক দেয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে একমাত্র স্বামীকে৷ স্ত্রীর জন্যে স্বামীকে তালাক দেয়ার কোনো অনুমতি নেই৷ তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে সেই অধিকার দিয়ে থাকেন, তাহলে স্ত্রী স্বামীর দেয়া সেই ‘এক্তিয়ার' বা ক্ষমতা অনুযায়ী তালাক গ্রহণ করতে পারেন৷ শরিয়তের পরিভাষায় একে ‘তালাক-এ-তৌফিজ' বলা হয়৷ তবে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বলে প্রমাণিত হন, এবং তার ফলে স্ত্রী তাঁর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে অপারগ হন, তাহলে স্ত্রী বিচারকের কাছে অথবা মুফতি বোর্ডের কাছে গিয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন৷ সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিবাহবিচ্ছেদও হতে পারে৷ কিন্তু স্ত্রী কোনো অবস্থাতেই স্বামীকে তিনবার ‘তালাক' উচ্চারণ করে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন না৷ অথচ দেখুন, বিয়েটা তো একান্তভাবেই স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার৷ তাহলে বিবাহবিচ্ছেদের সময় স্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই কেন? আরো বড় কথা হলো, শুধুমাত্র ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এ আইন কেন থেকে গেছে? ভারতের অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের আইন আলাদা৷ সমাজ যেভাবেই দেখুক না কেন, আজকাল বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের ঘটনা আকছার ঘটছে ভারতে, চোখে পড়ছে আদালতের নির্দেশে আলাদা থাকা বা ‘জুডিশিয়াল সেপারেশন'-এর ঘটনাও৷ তাহলে? তাহলে কি শুধুমাত্র ‘মুসলিম পার্সোনাল ল' বলেই ভারতের সরকার, ভারতের সমাজ এতদিন চোখ বন্ধ করে আছে? কেন? মুসলমান নারীর আত্মমর্যাদা, তাঁর অধিকার কি হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী নারীর তুলনায় কম? নাকি ‘হিন্দু ভারতের' শাসকগোষ্ঠী মুসলিম আইনে হাত দিতে ভয় পান? ভয় পান শরিয়তের বিরুদ্ধাচারণ করতে? আমার তো মনে হয় এ প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা আজ সত্যিই অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে৷
আরো একটা কথা না বলে পারছি না৷ ডিভোর্স – তা পুরুষ বা নারী – যার মর্জিতেই হোক না কেন, যে-ই দিক না কেন, বিবাহবিচ্ছেদে আসলে কেউ জেতে না৷ ডিভোর্সের অর্থ এটাই যে স্বামী-স্ত্রী একটি সম্পর্ক রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ এই হারের দায়িত্ব দু'জনেরই৷ তাই দু'জনেরই থাকতে হবে এই হারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, সম অধিকার, তা তাঁরা যে ধর্মেরই হোন না কেন৷