সাংবাদিকেরা যাতে প্রভাবশালীদের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো খবর প্রকাশ না করে সেজন্য অপহরণ ও নির্যাতন করে ভয় দেখানো হচ্ছে৷ শুধু তাই নয় খবর প্রকাশ করার পর হত্যারও হুমকি পাচ্ছেন কোনো কোনো সাংবাদিক৷
বিজ্ঞাপন
অপহরণের পর উদ্ধার চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে তাতে তাকে শুধু বলতে শোনা গেছে, ‘‘আমি আর নিউজ করব না প্লিজ, আমি আর নিউজ করব না প্লিজ৷’’ সারোয়ার এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷
চিকিৎসাধীন গোলাম সরোয়ারের সঙ্গে কথা বলা না গেলেও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ আলী জানান, ‘‘গোলাম সরোয়ারকে অপহরণ করা হয়েছিলো পেশাগত কারণেই৷ তিনি নিউজের কারণেই অপহৃত হন৷’’
গোলাম সরোয়ার ‘আজকের সূর্যোদয়ের’ স্টাফ রিপোর্টার এবং সিটি নিউজ নামে একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক৷ গত ২৯ অক্টোবর তাকে চট্টগ্রামের ব্যাটারি গলি থেকে অপরহরণ করা হয়৷ রোববার তাকে সীতাকুণ্ড এলাকার কুমিরা ইউনিয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়৷ উদ্ধারের পর তিনি সংবাদ মাধ্যমকে তার ওপর নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন৷
অপহরণকারীরা বার বার যখন অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল তখন তারা স্যার স্যার বলছিলো৷ তারা আরো বলছিল, ‘‘সাংবাদিকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরোয়ারকে তুলে এনেছি, হত্যার জন্য নয়৷’’ তারা তাকে নির্যাতনের সময় বার বার বলছিল, ‘‘আর নিউজ করবি’’?
এই ঘটনায় আমরা চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা ভয়ের মধ্যে আছি: সিইউজে সভাপতি মোহাম্মদ আলী
সরোয়ার কী সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন?
এখন প্রশ্ন তিনি কী নিউজ করেছিলেন যার জন্য তাকে অপরহণের পর নির্যাতন করা হলো৷ সেটা শুধু গোলাম সরোয়ারই বলতে পারবেন বলে জানান, চট্টগ্রাম কেতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন৷ অপহরণের পর জিডি করেছিলেন আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান জুবায়ের সিদ্দিকী৷ তিনিও একই কথা বলেন৷ তবে আলোচনায় আছে ২৩ অক্টোবর সিটি নিউজ নামের নিউজ পোর্টালে জমি দখলের একটি খবর৷ আর ওই খবরে বলা হয়, চট্টগ্রামে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক ব্যক্তি সরকারি জমি দখল করেছেন ৷ সিইউজে সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘‘এটা নিশ্চিত যে তাকে খবর প্রকাশের কারণেই অপহরণ করা হয়েছিল৷ আমরা পুলিশকে বলেছি এখন তারা অপহরণকারী ও এর নেপথ্যের গডফাদারদের চিহ্নিত করতে৷ এই ঘটনায় আমরা চট্টগ্রামের সাংবাদিকেরা ভয়ের মধ্যে আছি৷ সুস্থ হলে তার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারব কোন নিউজের কারণে তাকে অপহরণ করা হয়,’’ বলেন এই সাংবাদিক নেতা৷
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসিন জানান, ‘‘এখন আমরা তার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছি৷ তবে চাইলে তার পরিবারের কেউ মামলা করতে পারেন৷ তার শরীরের বাইরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নাই৷ আশা করছি তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন৷’’
তার শরীরের বাইরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নাই: ওসি মোহাম্মদ মোহসিন
সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র:
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে এই বছরেরই প্রথম ৯ মাসে ২০৯ জন সাংবাদিক হুমকি, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে ১৯ জন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে এবং ৩৫ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে৷ খবর প্রকাশের জন্য ৮১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরপত্তা আইনসহ অন্য আইনে মামলা হয়েছে৷ হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ২৩ জনকে৷ নিহত হয়েছেন একজন সাংবাদিক৷
এই বছরের প্রথম ছয় মাসে ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ৬৩ জনের বিরুদ্ধে এবং ২০১৮ সালে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই আট মাসে ৩৮ জন সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে৷
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, ‘‘এই ধরনের অনাকঙ্খিত ঘটনা আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে চরম অন্তরায়৷ সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনকারী সন্ত্রাসীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি৷’’
সংবাদ প্রকাশের কারণে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাও মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে তিনি মনে করেন৷ তার মতে, ‘‘এইসব ঘটনা একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে৷’’ তিনি বলেন, সাংবাদিকদের অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেল দিয়েছে৷ তবে তিনি সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল আচরণেরও আহ্বান জানিয়েছেন৷
৪ অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷