আলাদা পরিবহণ ব্যবস্থাই কি নারীর নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট?
মানসী গোপালাকৃষ্ণন/এসবি৩০ অক্টোবর ২০১৪
টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের অনেক বড় শহরে নারীরা গণ পরিবহণ ব্যবস্থায় তাঁদের বসার আলাদা ব্যবস্থা চান৷ পুরুষদের সঙ্গে ভ্রমণ করে যৌন হয়রানির এড়ানোই এর উদ্দেশ্য৷ কিন্তু এটাই কি সমাধানের উপায়?
বিজ্ঞাপন
প্রায় ১৫ বছর আগে এক পুরুষ সাংবাদিক বোরখা পরে নারীর ছদ্মবেশে নতুন দিল্লির গণ পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিলেন৷ দিনের ব্যস্ত সময়ে বাসের ভিড়ের মধ্যে কিছু বিফল পুরুষ যেখানে নিজেদের যৌন চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে থাকে৷ এই অ্যাডভেঞ্চারের শেষে সেই সাংবাদিকের শরীরের পেছনের অংশ প্রায় অবশ হয়ে যায়৷ বিকৃতমনা সহযাত্রীদের অনেকেই চিমটি কেটেছে, অনেক পুরুষ তাঁর শরীরের কিছু অংশ খামচে ধরেছে৷ পাশে দাঁড়ানো এক বয়স্ক ‘ভদ্রলোক' তাঁর শরীরে হাত দিয়েছেন৷
সেই সাংবাদিক লিখেছিলেন, নতুন দিল্লির বাস বা ট্রেনে পুরুষদের আচরণ ক্ষুধার্ত নেকড়েদের মতো, যারা শিকার করে চলেছে৷ কোনো নারী কী পোশাক পরেছে, তাতে তাদের কিছু এসে যায় না৷ এমনকি বোরখার নীচে মুখ না দেখেও তারা যা করার করেছে৷ কাজে যাবার পথে কিছু যৌন উত্তেজনাই তাদের কাম্য ছিল৷
সেটা ছিল ১৫ বছর আগের কথা৷ কিন্তু কিছুই বদলায়নি৷ দিল্লির সরকার নারীদের জন্য আলাদা ট্রেন বা নারীদের বসার আলাদা ব্যবস্থা করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নিউ ইয়র্কের মতো যে সব শহরে পরিবহণ ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানেও নারীরা আলাদা জায়গা চাইছেন৷ বাস বা ট্রেনের ভিড়ের মধ্যে পুরুষদের সঙ্গে যাত্রা করার কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই৷
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ট্যাক্সি
সারা বিশ্বেই ‘ট্যাক্সি’ আজ শুধু যানবাহন নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের একটা জায়গা হয়ে উঠেছে৷ ট্যাক্সিটি নতুন, পুরনো, ভাঙা বা বিলাসবহুল – যাই হোক না কেন, সেটায় বসেই যাত্রী সে দেশটিকে, দেশের মানুষকে দেখতে, ও জানতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উজ্জ্বল হলুদ রঙের ট্যাক্সি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের হলুদ রঙের এই ট্যাক্সিগুলো পরিচিত ‘ইয়েলো ক্যাব’ নামে৷ বিশ্বখ্যাত এই ট্যাক্সিগুলো মজবুত এবং আয়তনে বেশ বড় হলেও, ১৯৮০ সালের পর থেকে আর তৈরি হয়নি৷ তাছাড়া পুরনো এই ট্যাক্সিগুলো চালাতে বেশি পেট্রোল লাগলেও, আজও নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মাঝে মাঝেই এগুলি চোখে পড়ে৷ শোনা যায়, ১৯৯৯ সালে এই হলুদ ক্যাবের দাম নিলামে ১৩৪,৫০০ অ্যামেরিকান ডলার পর্যন্ত উঠেছিল৷
ছবি: imago/Manfred Segerer
মেয়েদের জন্য গোলাপি রঙের ট্যাক্সি
মেক্সিকোয় বড় শহরগুলোর রাস্তা তেমন নিরাপদ নয়৷ তাই মেক্সিকো-সিটি এবং পুয়েব্লার পৌরসভা সেখানে ‘পিংক ক্যাব’ ট্যাক্সি চালু করেছে৷ উজ্জ্বল গোলাপি রঙের এই ট্যাক্সির চালকরা যেমন মেয়ে, তেমনি যাত্রীও শুধুই মেয়ে এবং শিশুরা৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে, নারীচালিত এই ট্যাক্সিতে জিপিএস, ইমারজেন্সি বোতাম এবং কসমেটিক্স বক্স – এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সবসময় থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতীতে ফিরে যাওয়া
কিউবার রাস্তায় এখনো পুরনো গাড়ি, মানে ‘ওল্ডটাইমার’ চলতে দেখা যায়৷ এদের মধ্যে অধিকাংশই মার্কিনি৷ ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকের এমন অনেক গাড়ি ইতিমধ্যেই ১০০,০০০ কিলোমিটারের ঘর পার করেছে৷ তাই আজকের এ যুগে ঐ গাড়িগুলোয় চড়া পর্যটকদের জন্য এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা৷ তার ওপর এগুলো ‘শেয়ার ট্যাক্সির’ মতো কাজ করায়, পথে যাত্রী ওঠা-নামা করে৷ ফলে স্থানীয়দের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় সহজেই৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
ইচ্ছে মতো যাত্রী তোলা
গণ প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসার ট্যাক্সিগুলিতে কতজন যাত্রী তোলা হবে – তার কোনো নিয়ম-কানুন নেই৷ ফলে ট্যাক্সিতে চালকের ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়৷ তবে এ ছবি শুধু আফ্রিকায় নয়, বাংলাদেশের রাস্তাতেও নিত্যদিনের দৃশ্য৷ আসলে বেশিরভাগ সময় যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য আর কোনো বিকল্প উপায় থাকে না বলেই শেষ পর্যন্ত এরকম ভর্তি ট্যাক্সিতে ওঠেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুবাইয়ের ‘লাইফলাইন’ জলট্যাক্সি
এখানে যতগুলো সেতু আছে, তারচেয়েও বেশি আছে জলট্যাক্সি৷ খাঁড়িগুলিতে অবশ্য শুধুমাত্র কাঠের তৈরি জাহাজগুলোরই চলাচলের অনুমোদন আছে৷ তবে ‘আব্রাস’ নামের ছোট্ট এই নৌকাটিও অন্ততপক্ষে ২০ জন মানুষকে তুলতে পারে৷ আর এই জলট্যাক্সিতে শ্রমিক, ম্যানেজার, পর্যটক – যেই উঠুন না কেন, সবার জন্যই ভাড়া মাত্র ২০ সেন্ট৷ সম্ভবত বিশ্বের আর অন্য কোথাও এত কম ভাড়ায় ট্যাক্সি চড়া যায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অমানবিক কাজ
জাপানে আবিষ্কৃত রিক্সা প্রথমে এশিয়ার দেশগুলিতে পরিচিতি পেলেও, ইতিমধ্যে সাইকেল রিক্সা হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর চল রয়েছে৷ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবশ্য টানা রিক্সা শহরের প্রায় সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ আজকের যুগে মানুষ-টানা রিক্সাকে রাজনীতিবিদ সহ অনেকেই অমানবিক বলে মনে করেন৷ তাই তাঁরা এ ধরণের রিক্সা একেবারেই তুলে দেওয়ার পক্ষে৷
ছবি: Gemeinfrei
সন্নাসীরাও ট্যাক্সিতে ওঠেন
থাইল্যান্ডে ট্যাক্সি চড়ে ঘুরে বেড়ানোটা বেশ মজার একটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’৷ তবে ওখানকার তিন চাকাওয়ালা ‘টুক-টুক’-এ চড়তে শক্ত নার্ভ আর স্থিতিশীল পাকস্থলী থাকা প্রয়োজন তা না হলে মুসকিল৷ অন্যদিকে আরামদায়ক গাড়ির মধ্যে লিমোজিন অন্যতম৷এই গাড়িতে ওঠার আগে পর্যটকদের ভাড়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ভালো৷ থাইল্যান্ডে সন্নাসীদের বিশেষ অবস্থানের কারণে তাঁরা এই ব্যয়বহুল লিমোজিনে উঠতে পারেন, তাও আবার বিনা পয়সায়৷
ছবি: picture-alliance/Sebastian Kahnert
বিরক্তিকর!
কম্বোডিয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য সাইকেল রিক্সা, মোফাট্যাক্সি, মিনিবাসের মতো নানান যানবাহন রয়েছে৷ তবে ‘পিকআপ’ হচ্ছে সস্তা যানবাহনের একটি৷ আরাম যার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে এতে চড়তে পারেন৷ তবে ‘পিকআপ’-এ চড়ার আগে এটা ধরেই নিতে হবে যে, তাঁকে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে কষ্ট করে বসতে হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
সবুজ চা পান
চীনের প্রধান শহরগুলোতে ট্যাক্সিই মূল যানবাহন৷ শুধুমাত্র পেকিংয়েই চলে প্রায় ৬৬,০০০ ট্যাক্সি৷ শুধু তাই নয়, ট্যাক্সিতে খুব কম খরচে এবং সহজে যাতায়াত করা যায়৷ তবে বেশিরভাগ ট্যাক্সি চালক ইংরেজি না জানায়, গন্তব্যস্থলটি চীনাভাষায় লিখে চালককে ধরিয়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ পর্যটকদের এটাও জানা দরকার যে চীনা ট্যাক্সি চালকরা যখন-তখন সবুজ চা পান করেন৷ তাই আপনাকেও যদি সেই চা খেতে বলা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জলের ওপর বিলাসবহুল ট্যাক্সি
ইটালির ভেনিস শহরে হাতে গোনা পিচ ঢালা সমান্তরাল রাস্তা রয়েছে৷ কারণ শহরটি রাস্তার বদলে সরু সরু খালে ভর্তি৷ দেড় হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের বুকে শহরটির গোড়াপত্তন হয়৷ আর তখন থেকেই ছোট ছোট নালা বা খালের ভেতর দিয়ে চলতো কাঠের তৈরি সোনালি-কালো গন্ডোলা৷ দাঁড় বেয়ে মাঝিরা এই রোম্যান্টিক নৌকা চালান, রাতের বেলায় যাতে ৪০ মিনিট চড়তে খরচ হয় ১০০ ইউরো৷ আজকাল অবশ্য ইলেক্ট্রিক জলট্যাক্সিও পাওয়া যায় ভেনিসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
পুরুষরা সরে যাও!
গণ পরিবহন ব্যবস্থায় পুরুষ ও নারীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বড়জোর কিছুকাল এটা কাজ করবে৷ কাজে যাবার সময় প্রতিদিন কেই বা বিদ্রূপ বা হয়রানির শিকার হতে চায়!
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে পুরুষ ও নারীকে এমন আচরণ শিখতে হবে, যার ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়৷ পুরুষদের নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে হবে৷ তাদের খেলনা হিসেবে দেখলে চলবে না, যে যখন খুশি, যেখানে খুশি তাদের গায়ে হাত বোলানো যায়৷ নারীদের সেই শ্রদ্ধার প্রয়োজনের কথা আরও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে শিখতে হবে৷ শুধু নিজের পরিবারের মধ্যে নয়, কাজের জায়গায়ও সব পুরুষদের তা বলতে হবে৷
শহরের প্রশাসনগুলিকেও তাদের কাজ করতে হবে৷ যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যে সব আইন চালু আছে, তার সম্পূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে৷ বাসে ভিডিও ক্যামেরা বসালে ও অন্ধকার জায়গায় আরও আলোর ব্যবস্থা করলে নারীরা অনেক নিরাপদ বোধ করবেন৷
তবে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কিছু সামাজিক মনোভাব এবং নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কিছু বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তন ঘটানো৷ পুরুষদের শেখাতে হবে, যে কোনো নারী বাড়ি থেকে বেরোনো মানে এই নয় যে সে ‘ধর্ষিতা হতে চায়'৷ নারীদেরও বুঝতে হবে, যে সব পুরুষই শিকারি নয় এবং ধর্ষণ করার জন্য নারী খুঁজছে না৷
আমরা একে অপরকে জানত চাই
ব্যাপারটা হলো পুরুষরা নারীদের সম্পর্কে কৌতূহল বোধ করে, নারীদের মনেও সেই কৌতূহল রয়েছে৷ বিশেষ করে এশিয়ার অনেক সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষকে আলাদা রাখা স্বাভাবিক মনে করা হয়৷ তারা নিজেদের মধ্যে তেমন কথা বলে না, ‘শুধু বন্ধু' হওয়ারও উপায় নেই৷ নারী-পুরুষদের আরও আলাদা রাখার চেষ্টা হলে বৈরি মনোভাব আরও বাড়বে, কৌতূহলও আরও তীব্র হবে৷ ক'জন পুরুষ নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শিখবে, যদি তারা কোনো নারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পায়?
এ প্রসঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ তখন আমি দিল্লিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি৷ সে সময়ে বোরখা পরা পুরুষ সাংবাদিক নিজের প্রতিবেদন লিখেছিলেন৷ প্রতি বছর নারীদের হোস্টেলে একটি পার্টি হতো, যখন সবার জন্য দ্বার খুলে দেওয়া হতো৷ পুরুষ ছাত্ররা আমন্ত্রণের জন্য মুখিয়ে থাকতো৷ ‘নারীদের গোপন জীবনযাত্রা' দেখার এই সুযোগের কথা বলেছিলো আমার এক বন্ধু৷
আমি যখন তাকে বললাম, যে আমার নারী ছাত্রী বন্ধুরা তাদের হোস্টেলের ঘরে যা করে তা হলো ঘুমানো, ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, ব্রেকফাস্ট খাওয়া এবং কলেজ যাওয়া, পড়াশোনা করা এবং হয়ত বা তাদের পুরুষ বন্ধুদের সম্পর্কে কিছু গল্প করা – তখন আমার সেই বন্ধু একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল৷ তার হয়ত ধারণা ছিল যে, নারীদের হোস্টেল মহারাজার হারেম ও প্লেবয় পত্রিকার ম্যানসনের মাঝামাঝি একটা কিছু হবে৷ যাই হোক, ওপেন ডে পার্টির দিন অনেক নারীর সঙ্গে তার আলাপ হতো৷ তখন সে বুঝলো, যে তারা কেউ ‘স্বর্গের দেবদুত' নয় বা কোনো পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্রের তারকাও নয়৷
সেই বন্ধুটি এখন আমাকে দেখায়, একজন পুরুষের ‘ভালো' আচরণ কেমন হওয়া উচিত৷ তাকে নিয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত৷