1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টক শো: নেপথ্যের যত কথা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৩ অক্টোবর ২০১৮

টেলিভিশন টক শো-তে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পাশাপাশি উত্তেজনাপূর্ণ ও সংঘাতময় পরিস্থিতিও দেখে থাকেন দর্শকরা৷ রাজনৈতিক আলোচনার বিকল্প মঞ্চ হয়ে ওঠা এই প্ল্যাটফর্মকে আইনি কাঠামোয় আনার উদ্যোগে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা৷

ছবি: Channel 24

টক শো-তে সেনাপ্রধানকে নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিয়ে চাপের মুখে পড়া জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই এক নারী সাংবাদিককে ‘চরিত্রহীন' বলে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন৷

এর মধ্যে টক শো-তে ‘মিথ্যা, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর' তথ্য বললে জেল-জরিমানার বিধান রেখে আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা৷ 

সেনাপ্রধানকে নিয়ে জাফরুল্লাহর ‘অসত্য তথ্য' তুলে ধরার ‘সময় টিভি'র ওই টক শো‘র উপস্থাপক ছিলেন সাংবাদিক এহসান জুয়েল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টক শো‘র বিষয় আগেই আমরা নির্ধারণ করে আলোচকদের জানিয়ে দিই৷ কিন্তু কেউ যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যান বা এমন তথ্য উপস্থাপন করেন, যা আগে আমরা শুনিনি, তাহলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না৷ হয়ত পরে আমরা যাচাই-বাছাই করতে পারি৷ অনেক সময় প্রোডাকশন টিম থেকেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কোনো তথ্যের সত্যতা নিয়ে সঠিক তথ্য দেয়৷ কিন্তু সব সময় তো আর তা সম্ভব হয় না৷ তবে টক শো-তে তো একাধিক পক্ষ থাকে৷ তারাও অনেক সময় পরস্পরের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷'' 

আর মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের একাত্তর টেলিভিশনের টক শো ‘একাত্তর জার্নাল’-এর ওই দিনের সঞ্চালক ছিলেন মিথিলা ফারজানা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ধরনের উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, কারণ, আমাদের অধিকাংশ টক শো-ই রাজনৈতিক৷ বেশিরভাগ টক শো-তে যেটা করা হয় দুই পক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আসা হয়৷ অনেক ক্ষেত্রে চেষ্টা করা হয় আলোচনাটিকে উত্তপ্ত করে তোলার জন্য৷''

‘‘টক শো নিয়ে এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই হয়’’, মন্তব্য করে মিথিলা ফারজানা বলেন, ‘‘বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, দর্শকরা এই উত্তেজনা পছন্দও করেন৷ আর সে কারণেই টক শো-তে উত্তেজনা, মারামারির ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়৷"

মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যে মন্তব্য করেছেন তা কোনোভাকেই গ্রহণযোগ্য নয় মন্তব্য করে এই সাংবাদিক বলেন, ‘‘আমরা ব্যক্তিগত আক্রমণ আশা করি না৷''

টক শো-তে সত্য-মিথ্যা

গত ১৪ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘সম্প্রচার আইন ২০১৮-র নীতিগত অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম  সাংবাদিকদের জানান, প্রস্তাবিত আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ব্যাপারে বিকৃত ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশের দায়ে তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকার জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে৷ এছাড়া  টক শো-তে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রচার করলে একই সাজার কথা বলা আছে এই আইনে৷

প্রস্তাবিত এই আইন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে গাজী টিভি-র কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর এবং টক শো ‘জি ডায়ালগ'-এর উপস্থাপক অঞ্জন রায় বলেন, ‘‘কেউ যদি মিথ্যা তথ্য দেয়, সেটা অবশ্যই অপরাধ৷ কিন্তু যাঁরা টক শো-তে আসেন তাঁদের যদি এই ধরনের নৈতিকতা থাকে যে, তাঁরা মিথ্যা তথ্য দেবেন না, তাহলে এই ধরনের বিষয় সামনে আসত না৷ এই আইন যদি প্রতিহিংসার জায়গা থেকে ব্যবহার করা হয়, তা হবে খুবই দুঃখজনক৷ এখন যেহেতু অনেক কিছুই হচ্ছে, সম্প্রচার নীতিমালা, ডিজিটাল আইন, এ কারণে বিষয়টি আইনি পর্যায়ে সামনে এসেছে৷ কিন্তু আমার কথা হলো, আমরা যদি নৈতিক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, সেটি মনে হয় আইনের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে৷''

তার সঙ্গে একমত নন একাত্তর টিভির কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও টক শো উপস্থাপক মিথিলা ফারজানা৷ তিনি মনে করেন, প্রস্তাবিত আইনে এক ধরনের কঠোরতা আছে৷ ফারাজানা বলেন, ‘‘কখনো কখনো দেখা গেছে বক্তা বলছেন, তথ্য দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁর কাছে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই৷ নিয়ন্ত্রণ না হলেও সেই তথ্যগুলো কীভাবে যাচাই-বাছাই হবে? কারণ, এটা তো একটা পাবলিক ফোরাম৷ তবে তথ্য সঠিক কি সঠিক নয়, তা যাচাই-বাছাই কে করবেন? কমিশন যাচাই-বাছাই করবে বলে শুনছি৷ তবে আসলে তা এখনো স্বচ্ছ নয়৷ সামনে নির্বাচন৷ এই সময়ে এই আইন মানুষের মধ্যে চিন্তা বা দুশ্চিন্তার জন্ম দেবে বলে আমার কাছে নিশ্চিতভাবেই মনে হয়৷''

অঞ্জন রায়

This browser does not support the audio element.

এই আইন হলে তা ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে বলে মনে করেন সাপ্তাহিক-এর সম্পাদক ও টক শো আলোচক গোলাম মোর্তোজা৷ তিনি বলেন, ‘‘যে কোনো প্রচারমাধ্যম যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো অসত্য তথ্য প্রচার করে, তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ব্যবস্থা নেওয়া৷ এটা সাধারণভাবে বলা যায়৷ কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়ালে বা অসত্য তথ্য দিলে যে আইনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে যে কোনো বক্তব্যকে, যে কোনো কথাকে এই আইনের মধ্যে ফেলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়৷ আমার কাছে যেটা সঠিক, সেটা আপনার কাছে সঠিক মনে না-ও হতে পারে৷ আপনি মনে করলেন আমি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছি৷ তার ভিত্তিতে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা৷ যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই৷ আপনি যদি আপনার মতো করে একটা লেখা লেখেন, মতামত দেন, তখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা মনে করতে পারেন, আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করলেন৷''

তাঁর মতে, আইনটি এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যাতে চাইলে যে কোনো কথাকেই আইনের মধ্যে ফেলা যায়৷

‘‘এখন আমার কথা হলো, কথা বলা বা বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য এত আইন-কানুন, নিয়ম না করে সরকার ঠিক করে দিলেই পারে, কোন কথা বলা যাবে, কোন কথা বলা যাবে না৷ এতে সরকারেরও পরিশ্রম কমে যায়, আমাদেরও আতঙ্ক কমে যায়৷''

টক শো নিয়ে সরকারের ভাবনা

টেলিভিশন টক শো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা হরণের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়েও এই প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি৷

২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘যাঁরা টক শো-তে সরকারের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলেন, তাঁদের মনিটর করা হবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ তাঁদের ব্যাপারটাও আমরা দেখব৷ তবে সরকারের সমালোচনা করা যাবে৷''

গত ২০ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সংসদে আলোচনায় তিনি বলেন, ‘‘আজকাল টেলিভিশনে তো মধ্যরাত পর্যন্ত টক শো, কত রকমের আলোচনা, যে যাচ্ছেন সে-ই আলোচনা করতে পারছেন৷ কই, কেউ গিয়ে তো তাদের গলা চেপে ধরছে না৷ কেউ তো তাদের বাধা দেয়নি৷''

মিথিলা ফারজানা

This browser does not support the audio element.

টক শো নিয়ে সাধারণের ভাবনা

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা আব্দুস সালাম আজাদী পেশায় সাংবাদিক৷ স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি তিনি৷ রাত জেগে টক শো দেখা যেন তাঁর এক নেশা৷ সালাম আজাদী বলেন, ‘‘আমার বিবেচনায় টক শো হলো টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান৷ আর বিশেষ করে রাজনৈতিক টক শো দর্শকদের আকর্ষণ করে বেশি৷ এর মাধ্যমে দর্শকরা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেন৷''

তাঁর মতে, টক শো-তে প্রায় সব দলের নেতারাই যান এবং যে যাঁর রাজনীতির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন৷

‘‘এতে দর্শক হিসেবে আমরা যুক্তিগুলোর গ্রহণযোগ্যতা অথবা অসারতা বুঝতে পারি৷ পক্ষ-বিপক্ষ দুই দিকের মতই জানতে পারি৷''

তবে টক শো সঞ্চালকদের কেউ কেউ অনেক সময় নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেন, যা ঠিক নয় বলে মনে করেন তিনি৷

তবে টক শো নিয়ে খুব বিরক্ত তরুণ সাইফুল বাতেন টিটো৷ তাঁর মতে, টক শো-র আলোচনা মানুষকে বিভ্রান্ত করে৷ বিশেষ করে রাজনৈতিক টক শো-তে যুক্তির চেয়ে বক্তারা অন্ধভাবে দলের পক্ষে অবস্থান নেন৷ নিরপেক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ মতামত খুব কমই পাওয়া যায়৷

‘‘আর সঞ্চালকদের একটি বড় অংশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন না৷ উপস্থাপকদের একাংশের দক্ষতা বা যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়৷''

টক শো আলোচক বাছাই নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে টিটো’র৷ তিনি বলেন, ‘‘একজনকে দেখা যায় সন্ধ্যায় এক চ্যানেলে ধর্ম, রাত ৭টায় আরেক চ্যানেলে অর্থনীতি আবার রাত ১২টায় আরেক চ্যানেলে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন৷ টক শো-তে আলোচনা যেন তাঁর পেশায় পরিণত হয়েছে৷

‘‘আর এই টক শো-গুলোর অধিকাংশ এমন সময় প্রচারিত হয়, তা তরুণ দর্শকদের টানতে ব্যর্থ হয়৷ কিন্তু তাঁরাই মূল টার্গেট গ্রুপ হওয়া উচিত৷''

জরিপ কী বলে?

বাংলাদেশে টেলিভিশন টক শো-র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে একটি জরিপ হয়৷ সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান এটা করেছিলেন৷

ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৫০ জন দর্শকের মধ্যে প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা করেছিলেন তাঁরা৷ তাতে দেখা যায়, দর্শকদের ৯৮ ভাগ নিয়মিত টক শো দেখেন, ৭৮ ভাগ মনে করেন চ্যালেনগুলো টক শো-তে তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষেই মত প্রচার করে৷ আর ৫২ ভাগ মনে করেন, টক শো-র ৫২ ভাগ সঞ্চালক নিরপেক্ষ নন৷

উত্তরদাতারা তাঁদের পছন্দের টক শো-র কথা বলতে গিয়ে ১৩টি চ্যানেলের ১৫টি টক শো-র কথা বলেন৷ তাতে বোঝা যায়, পছন্দের দিক দিয়ে দর্শকদের বৈচিত্র্য আছে৷ ওই জরিপে পছন্দের তালিকায় একাত্তর টেলিভিশনের ‘একাত্তর জার্নাল' এবং ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের  ‘আজকের বাংলাদেশ' শীর্ষে ছিল৷ এরপরেই ছিল বাংলাদেশের প্রথম টক শো ‘তৃতীর মাত্রা'৷

এর বাইরে আল জাজিরার স্ট্রিম এবং বিবিসি হার্ডটকের দর্শক আছে বাংলাদেশে৷ সিএনএন-এর আমানপোরের নাম বলেছেন কয়েকজন৷

এই জরিপে টক শো-র বাস্তব চিত্রই উঠে এসেছে বলে মনে করেন গোলাম মোর্তোজা৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশটা রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত৷ আর সেই বিভাজনটা পেশাজীবীসহ সব ধরনের মানুষের মধ্যেই তীব্রভাবে আছে৷ ডাক্তার, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সমাজের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে রাজনৈতিক বিভক্তি নেই৷ আর তার প্রকাশ ঘটে টক শো-তে৷ ঘটনা সত্যি কি মিথ্যা সেই আলোচনার চেয়ে টক শো-তে আলোচক ও উপস্থাপকদের একটি অংশ সরাসরি দলীয় অবস্থান নিয়ে কথা বলেন৷ তাঁরা বাস্তব বিশ্লেষণ থেকে অনেক দূরে থাকেন৷ অনেক ক্ষেত্রেই দর্শক যে সঠিক বিশ্লেষণ আশা করেন, তা পান না৷''

আলোচক

বাংলাদেশে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৪৪টি৷সবগুলো সম্প্রচারে নেই৷ যেগুলো আছে তার মধ্যে চারটি সংবাদ চ্যানেল, বাকিগুলো মিশ্র ঘরানার৷ ৩৫টি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে থাকলেও এবং তারা ২৪ ঘণ্টায় দুটি করে টক শো প্রচার করলেও সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০টি৷  প্রতিটি টক শো-তে যদি দুই জন করেও আলোচক থাকেন, তাহলে তার সংখ্যা দাড়ায় ১৪০ জন৷

এই সব টক শো-তে কিছু আলোচককেই ঘুরে ফিরে দেখা যায়৷ একই ব্যক্তি হয়ত একই দিনে একাধিক চ্যানেলে অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম সব বিষয় নিয়েই কথা বলছেন৷ তাহলে কি টক শো-তে আলোচক সংকট দেখা দিয়েছে? একাত্তর জার্নালের সঞ্চালক মিথিলা ফারজানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি একমত যে, আমাদের দেশে ভালো বক্তার যথেষ্ট অভাব আছে৷ গণমাধ্যম টেলিভিশনে কথা বলার জন্য প্রজন্ম তৈরি হয়৷ আমরা তো মাত্র টেলিভিশন সাংবাদিকতার একটা প্রজন্ম পার করেছি কিনা সন্দেহ আছে৷ টেলিভিশনে বা টক শো-তে কথা বলার জন্য এক ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন হয়৷ অনেকে কোনো বিষয়ে ভালো জানেন, ভালো বোঝেন, কিন্তু ভালো বলতে পারেন না৷ 

এহসান জুয়েল

This browser does not support the audio element.

‘‘আর এটাও সত্য যে, একটি সমাজে ভালো  বক্তা আসলে কতজন থাকে? ধরি ৩০টি টিভি চ্যানেল, সবার ২-৩টি করে টক শো আছে৷ দুটি করে ধরলে ৬০টি৷ প্রতিদিন কমপক্ষে ১২০ জন আলোচক প্রয়োজন৷ এবার এক মাসের কথা চিন্তা করুন৷ ফলে ঘুরে ফিরে আমরা কিছু আলোচককে সব সময়ই বিভিন্ন চ্যানেলে দেখতে পাই৷''

টক শো-তে এই আলোচক নির্ধারণে আবার চাপেরও কথা শোনা যায়৷ মালিকপক্ষের চাপ, সরকারের পক্ষ থেকে চাপ, আবার যারা টক শো-র আলোচক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চান তাঁদের চাপ৷ ওয়ান ইলেভেনের সময় এই প্রতিবেদক একুশে টেলিভিনের প্ল্যানিং এডিটর হিসেবে কাজ করতেন৷ টক শো উপস্থাপনা এবং আয়োজনের নীতিনির্ধারকের জায়গা থেকে অনেক চাপ প্রত্যক্ষ করেছেন৷ একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয় তখন, কাদের টক শো-তে আলোচক হিসেবে ডাকা যাবে আর কাদের ডাকা যাবে না৷ এ নিয়ে গাজী টিভির অঞ্জন রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ৷ ১৬ কোটি মানুষ৷ তাই কেউ চাইতেই পারেন যে, তিনি টেলিভিশনে আলোচনা করবেন, সবাই তাঁকে দেখবে৷ সেই জায়গা থেকে অনেকেই হয়ত নানাভাবে চেষ্টা করেন টক শো-তে অংশ নিতে৷  তবে যাঁরা আলোচক নির্ধারণ করেন, বিষয়টি তাঁদের চাপ সহ্য করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে৷ওয়ান ইলেভেনের সময় তালিকা দিয়ে দেয় হতো উপর মহল থেকে, কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই৷''

এ বিষয়ে আরটিভির টক শো গোলটেবিল-এর প্রযোজক বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের বহুদিনের সংস্কৃতি হচ্ছে, আমরা এক ধরনের ভীতির মধ্যে থাকি, চাপ বোধ করি৷ এই চাপটা সরকারের দিক থেকে থাকে না৷ তবে সরকার বা কর্তৃপক্ষের কাছের মানুষ এমন জায়গা থেকে যদি ফোন করেন যে, আপনি অমুক আলোচককে না রেখে অমুককে রাখতে পারতেন৷ বা উনি যা বলেছেন তা ব্যাপারটির সঙ্গে যায় না, ঠিক না৷ এই ধরনের যখন কেউ ফোন করেন তখনতো আমরা এক ধরনের চাপ অনুভব করি আসলে৷''

টক শো-তে কেন রাজনীতির প্রাধান্য?

টক শো-গুলোতে রাজনীতির প্রাধান্য থাকে৷ সমসাময়িক ঘটনার বাইরে রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয় প্রাধান্য পায় না৷ আর রাজনৈতিক টক শো-র দর্শকও বেশি৷ বিষয়ভিত্তিক টক শো খুব বেশি দেখা যায় না৷ এর কারণ জানতে চাইলে গোলাম মোর্তজা বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতিপ্রিয়৷ রাজনৈতিক আলোচনা শোনা, নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত দেওয়া নিয়ে এখনকার মানুষের যেন একটা জন্মগত প্রবণতা আছে৷ শহর থেকে গ্রামে একই প্রবণতা৷ আমরা রাজনীতিরই বেশি সমালোচনা করি, রাজনীতিবিদদেরই বেশি সমালোচনা করি, কিন্তু বাংলাদেশে রাজনীতিবিদরাই বড় তারকা৷ দেখা যাবে, যে কোনো বিচারে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াই সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি৷’’

‘‘বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু রাজনৈতিক আলোচনা দেখতে চায়, তাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও রাজনৈতিক টক শো করে৷ এছাড়া সম্ভবত টক শো হলো কম খরচের অনুষ্ঠান৷ তাই টিভি চ্যানেলগুলো এর দিকে ঝুঁকছে৷''

এ বিষয়ে অঞ্জন রায় বলেন, ‘‘মানুষের আগ্রহের বাইরেও রাজনীতি এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায়৷ আর  বলার জন্য এটাকে অনেকেই খুব জটিল মনে করেন না৷ অর্থনীতি, সমাজনীতি বা অন্য বিষয়ভিত্তিক টক শো করার জন্য আমাদের এক ধরনের দক্ষতার অভাব আছে৷ এটা স্বীকার করতেই হবে৷''

বেলায়েত হোসেন

This browser does not support the audio element.

কানেকটিং পিপল

টক শো-তে এখন প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসছে৷ শুরুতে স্টুডিও'র বাইরে শুধু ফোনেই কোনো আলোচক ও ব্যক্তিকে সংযুক্ত করা যেত৷ এখন প্রযুক্তিগত সুবিধা থাকায় সরাসরি কাউকে বাসা, কর্মস্থল বা অন্য কোনো জায়গা থেকেও সংযুক্ত করা যায়৷ বাংলাদেশে অধিকাংশ টক শো-ই লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার হয়৷ আগে ধারণ করা টক শো খুবই কম৷ আর এই লাইভ টক শো-তে এখন মোটামুটি যে কাউকে যে কোনো জায়গা থেকে যুক্ত করা যায়৷ লাইভ সম্প্রচার যন্ত্র এখন সহজে বহনযোগ্য (ব্যাকপ্যাক), এছাড়া কেবল কানেকশন, স্কাইপ, মেসেঞ্জারের মতো বিষয়গুলোও একে সহজ করে দিয়েছে৷ এখন টক শো-তে অনেক মানুষ যুক্ত হচ্ছেন স্টুডিওর বাইরে থেকে৷

এর বাইরে এখন টক শো-র আগে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত বের করতে অনেক টেলিভিশন স্টেশনের গবেষক দল রয়েছে৷ আর টিভির টক শো প্রযোজক বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘‘গোলটেবিলের বিষয় নির্ধারণে আমরা সমসাময়িক বিষয়কে প্রাধান্য দিই৷ আমাদের গবেষণার জন্য একটি দল আছে৷ তারা এটা দেখেন৷ তার আলোকেও বিষয় নির্ধারণ করা হয়৷''

এই জায়গাটিকেই এখনো বড় একটি সমস্যা মনে করছেন টক শো-র আলোচক গোলাম মোর্তজা৷ তিনি বলেন, ‘‘কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ টেলিভিশনের টক শো শুরুর আগে বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য গবেষণা টিম নেই৷''

তাহলে টক শো-র উন্নতির জায়গা কোথায়?  বাংলাদেশের প্রথম টক শো চ্যানেল আই'র তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘‘আসলে টক শো-তে খুব একটা পরিবর্তন করার সুযোগ আছে এমনটি নয়৷ তবে আমরা গিমিক দেওয়ার চেষ্টা করি৷ আমি হয়ত কাউকে স্কাইপে বা অন্য কোনোভাবে কানেক্ট করলাম বা আমি আউটডোরে গিয়ে শুটিং করলাম৷ এভাবে যতগুলো করা সম্ভব তৃতীয় মাত্রা কিন্তু সবগুলোই করেছে৷ কোনো সমস্যা নেই৷ দিনশেষে এটা কিন্তু কথার অনুষ্ঠান৷ আপনি যদি ভালো গেস্ট দেন, ভালো কনটেন্ট দেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন, তাহলে কিন্তু মানুষ অনুষ্ঠান দেখে৷ এর বাইরে আপনি ১০ জনের সঙ্গে কথা বললেন, কানেক্ট করলেন, তাতে কিছু যায় আসে না৷ আমরাও কিন্তু ফোনে নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি৷ কিন্তু দেখা যায় যে, মূল যাঁদের কথা শোনার জন্য মানুষ টেলিভিশনের সামনে বসে আছে, তাঁদের আলোচনাটা শোনা হয় না৷ অনেকে আবার কন্ঠ শোনাবার জন্য প্রশ্ন করেন৷ অথচ সিরিয়াস দর্শকদের অনেকে আবার প্রশ্ন করেন না৷ আমরা সবগুলো ফরমেই এক্সারসাইজ করেছি৷ ভবিষ্যতেও হয়ত করব৷ দিন শেষে আপনি দর্শকের জন্য কতটা ভালো কথা-বার্তা দিতে পারছেন সেটাই বিবেচ্য বিষয়৷''

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ