হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ্ আহমদ শফির একটি ভিডিও বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বেশ আলোচনা চলছে৷ সেখানে তিনি নারীদের নিয়ে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
ক্যানাডা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ'-এর অনলাইন সংস্করণে ভিডিওটির কথাগুলো লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে৷ এরপর সেটা ফেসবুকে শেয়ার করেছেন পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক শওগাত আলী সাগর৷ এতে দেখা যাচ্ছে, আল্লামা শফি তাঁর বক্তব্যে মহিলাদের তুলনা করেছেন ‘তেঁতুল'-এর সঙ্গে৷ তিনি বলেন, ‘‘মহিলাদেরকে দেখলে দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়, বিবাহ করতে ইচ্ছা হয়৷ লাভ ম্যারেজ/কোর্ট ম্যারেজ করতে ইচ্ছা হয়৷''
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী শওগাত আলী সাগরের স্ট্যাটাসের নীচে লিখেছেন, ‘‘এই শফি আজীবন গ্রামীণ ব্যাংক সহ এনজিওদের বিরুদ্ধে বলেছে, এসব প্রতিষ্ঠানকে সুদখোর বলেছে, বলেছে মেয়েদের ঘরের বাইরে বের করেছে এনজিও৷ এবার কিছু বলেনি, কারণ ইউনূসের সাথে রাজনীতি মিলে গেছে৷ এমনই সৎ ধার্মিক সে৷ আর ইউনূস নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলেন৷ এই শফি পোশাক শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে অশ্লীল কথা বললেও চুপ থাকেন৷ কারণ তাঁরও রাজনীতি মিলে যায় এই ধর্মান্ধটার সাথে৷''
হেফাজতের ১৩ দফা, অস্থির বাংলাদেশ
ঢাকায় শনিবার (০৬.০৪.১৩) মহাসমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম৷ ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে এই সমাবেশ করে তারা৷ হেফাজতের এসব দাবির বিপক্ষে অবস্থান অনেকের৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ
আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলোর হিসাবে শনিবারে ঢাকার মতিঝিলে জড়ো হন লক্ষাধিক মানুষ৷ হেফাজতে ইসলাম এর সমর্থক তারা৷ সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী এই সমাবেশ থেকে তাদের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
কী আছে ১৩ দফায়?
শাহবাগের কথিত ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে যত ভাস্কর্য আছে সব ভেঙে ফেলা এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধের মতো দাবি রয়েছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
আক্রান্ত নারী সাংবাদিক
শনিবার মহাসমাবেশ চলাকালে হেফাজতে ইসলামের লোকজন ঢাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়৷ তারা হামলা চালিয়েছে একুশে টেলিভিশনের নারী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর৷ পুরুষদের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এই অজুহাত তুলে তারা শারমিনকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পেটায়৷ সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য সাংবাদিকের ওপর হামলার দায় অস্বীকার করেছে হেফাজত৷
ছবি: Getty Images
সমর্থন, ধন্যবাদ
হেফাজতের এই মহাসম্মেলনে সরাসরি সহায়তা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জোট সঙ্গী জাতীয় পার্টি৷ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য হেফাজতে ইসলামকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর৷
ছবি: Reuters
‘নতুন কোন আইন নয়’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ইসলাম অবমাননার অভিযোগ বিচারের জন্য নতুন কোনো আইন করার পরিকল্পনা সরকারের নেই৷ একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে হাসিনা বলেন, ‘‘সরকার হেফাজতের সবগুলো দাবিই দেখবে৷ এর মধ্যে কোনোটি গ্রহণযোগ্য হলে তা পূরণ করা হবে৷ আর যেসব দাবি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’, সেগুলো পূরণ করা হবে না৷’’
ছবি: dapd
‘দাবি মানার কোন কারণ নেই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘হেফাজতের যে সব দাবি, তা মেনে নেয়ার কোন কারণ নেই৷ তারা দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়৷ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলাও ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে৷ এই হুমকিকে ভয় পায়না স্বাধীনতা এবং প্রগতির পক্ষের শক্তি৷’’
ছবি: AP
‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নারী স্বাধীনতা, প্রগতি, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ঐতিহ্য ও বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি বিরোধী৷ তাদের দাবি মেনে নিলে দেশ অন্ধকার যুগে চলে যাবে৷ দেশে মোল্লাতন্ত্র চালু হবে৷ তা এদেশের মানুষ মানবেনা৷’’
ছবি: Reuters
নারী সমাজের প্রতিবাদ
নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং হেফাজতের নারী প্রগতি বিরোধী দাবির বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন নারী সমাজ৷ ঢাকায় একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা বলেছেন, বাংলাদেশকে মধ্য যুগে ফিরিয়ে নেয়ার চক্রান্ত সফল হবেনা৷ হেফাজত আর জামায়াত শিবির এক হয়ে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়৷ কিন্তু তাদের এই ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হবেনা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে’
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা মনে করেন, হেফাজতে ইসলাম নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেশের অগ্রগতি রুখতে চায়৷ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘‘প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷’’
ছবি: REUTERS
ব্লগার গ্রেপ্তার
হেফাজতের শনিবারের মহাসমাবেশের আগেই অবশ্য ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য ও কটূক্তি’র অভিযোগে চার ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ অনেকে মনে করেন, সরকার দৃশ্যত হেফাজতের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করতে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করছে৷ আরো কয়েকজন ব্লগারকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
লুৎফুন নাহার লতা লিখেছেন, ‘‘সকল নারীদের উচিত এই নষ্ট শফির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা৷'' মাহমুদুর রহমান খোকনের মন্তব্য, ‘‘অশিক্ষিত হলে যা হয়৷''
তবে ফিরোজ আহমেদ নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী আল্লাম শফির কয়েকটি বক্তব্য খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন৷ যেমন আল্লামা শফি মেয়েদের চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর কথা বলেছেন যেন তারা পরবর্তীতে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসেব রাখতে পারে৷ এ প্রসঙ্গে ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন, ‘‘জগতের সকল মুহাদ্দিস, যারা হাদীস বিষয়ে পণ্ডিত, তাঁরা হযরত আয়েশার কাছে ঋণী অসংখ্য হাদীস বয়ান করার জন্য৷ অজস্র ছাত্র ছিল তাঁর, এবং অনেকগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের জন্যই না কেবল, সেগুলোর ব্যাখ্যা যেমন তিনি করেছেন, তেমনি খুব সততা আর দৃঢ়তার সাথে রাজনৈতিক স্বার্থে তৈরি হওয়া অনেক দুরভিসন্ধিমূলক হাদিসের প্রতিবাদও করেছেন, সেগুলোর যুক্তির অসাড়তা বুঝিয়ে দিয়েছেন৷''
ফিরোজ আহমেদ বলছেন, আল্লামা শফি মেয়েদের বাজার করতে নিষেধ করেছেন৷ অথচ নবীর আমলে মেয়েরা যে বাজারে যেত, কেনাবেচা করত, তার অজস্র নজির রয়েছে৷ এমনকি খলিফা উমরের আমলে শিক্ষাগত যোগ্যতার গুনে শিফা বিনতে আবদুল্লাহকে বাজার পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়েছিল!
এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের বক্তব্য জানতে ফেসবুকে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ' নামের একটি গ্রুপে ঢুঁ মারা হলেও তাতে কোনো কিছু পাওয়া যায় নি৷