হেফাজতে ইসলামে আবারও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন মাওলা জুনায়েদ বাবুনগরী৷ পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানী৷ তার প্রভাব পড়েছে হেফাজতের মূল কেন্দ্র চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায়৷
বিজ্ঞাপন
হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে তা-ই নির্ধারণ করে দেয় হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ কোন দিকে থাকবে৷ হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানীকে নিয়েই এখন সংকট তৈরি হয়েছে৷ তিনি তার বাবার মাদ্রাসা এবং হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রাখতে গিয়ে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠছে৷ তার প্রভাবে গত জুন মাসে বাবুনগরীকে মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালকের (মুঈনে মুহতামিম) দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে৷ বাবুনগরী অবশ্য এখনো হেফাজতের মহাসচিব পদে আছেন৷
মাওলানা শফীর ছেলে আনাস মাদানী হেফাজতের প্রচার সম্পাদক৷ তিনি একই সঙ্গে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক৷ কিন্তু অভিযোগ আছে, তার পিতা অসুস্থ হওয়ায় তিনি মাদ্রাসা এবং হেফাজতের মধ্যে তার প্রভাব বাড়াতে থাকেন৷ বাবুনগরীকে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেয়ার পর তিনি কয়েকজন শিক্ষককে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেন এবং তার বিরোধী ছাত্রদের নানাভাবে কোণঠাসা করেন৷
হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রায় ২০ হাজার ছাত্র আছে৷ তারাও শিক্ষকদের অনুসারী হিসেবে নানা ভাগে বিভক্ত৷ গত ৯ জুলাই অবশ্য মাওলানা আহমেদ শফি তার ছেলে এবং বাবুনগরীকে নিয়ে এক টেবিলে বসে তাদের মিলিয়ে দেন৷ কিন্তু বাবুনগরী মাদ্রাসায় তার পদ ফিরে পাননি৷
মাদানীর ভূমিকাকে কেউ ভালো চোখে দেখছেনা: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
এই সময়ে আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের নানা অভিযোগ ওঠে, যার শিকার হন মাদ্রাসার ছাত্ররাও৷ তারাই বুধবার মাদ্রাসায় ব্যাপক বিক্ষোভ দেখায়৷ তারা ভাঙচুরও করে৷ আনাস মাদানীর অনুসারী এক শিক্ষক তাদের হাতে প্রহৃতও হন৷ বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সুরা সদস্যরা বৈঠক করে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার শিক্ষক পদ থেকে বহিষ্কার করেন৷
ছাত্ররা মোট পাঁচ দফা দাবি দিয়েছে৷ দাবিগুলো হলো: মাওলানা আনাস মাদানীকে অনতিবিলম্বে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করতে হবে, ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও সবধরনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে, আল্লামা আহমদ শফী অক্ষম হওয়ায় মহাপরিচালকের পদ থেকে সম্মানজনকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপদেষ্টা বানাতে হবে, উস্তাদদের পূর্ণ অধিকার ও নিয়োগ-বিয়োগকে শূরার কাছে পূর্ণ ন্যাস্ত করতে হবে, বিগত শূরার হাক্কানি আলেমদেরকে পুনর্বহাল ও বিতর্কিত সদস্যদের পদচ্যূত করতে হবে৷ এর মধ্যে প্রথম দাবি আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রদের শান্ত রাখা হয়েছে৷ কিন্তু অন্যান্য দাবির ব্যাপারেও তারা অনড় রয়েছে বলে জানা গেছে৷
বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে এখন মাওলানা বাবুনগরীর অনুসারীরাই মাদ্রাসা এবং হেফাজতে প্রাধান্য বিস্তার করছে৷
মাদানীকে নানা সমস্যার কারণে সর্বসম্মতিক্রমে বহিষ্কার করা হয়েছে: মজলিশে সূরার সদস্য নোমান ফয়েজি
হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘‘আনাস মাদানী কিছু ছাত্রের ভর্তি প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়ে আসছিলেন৷ তাদের ভর্তি ফর্ম আটকে রেখেছিলেন৷ কয়েকজন শিক্ষককে অন্যায়ভাবে অব্যাহতিও দেন৷ তার এই ভূমিকাকে কেউ ভালো চোখে দেখছে না৷’’ তিনি বলেন, ‘‘ছাত্ররা যে পাঁচ দফা দাবি দিয়েছে তা যৌক্তিক এ কারণেই আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে৷’’
তার মতে, আনাস মাদানী শফী হুজুরের ছেলে হলেও মাদ্রাসা চলে মাদ্রাসার নিয়মে৷ তারপরও তিনি শিক্ষতায় অনেক জুনিয়র হয়েও এমন কাজ করেছেন, যাতে শিক্ষক, ছাত্র এবং এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ৷
তাকে বহিষ্কারের পিছনে মাওলামা বাবুনগরীর কোনো হাত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না তার কোনো ভূমিকা নেই৷’’
বুধবারের ছাত্র বিক্ষোভের পর মাদ্রাসার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলে জানান মাদ্রাসার মজলিশে শূরার সদস্য আল্লামা নোমান ফয়েজি৷ তিনি বলেন, ‘‘আনাস মাদানীকে নানা সমস্যার কারণে সর্বসম্মতিক্রমে বহিস্কার করা হয়েছে৷গত জুন মাসে মাওলানা বাবুনগরীকেও শফি হুজুরের মতামতের ভিত্তিতে বাদ দেয়া হয়েছিল৷” তিনি দাবি করেন, হেফাজতের কোনো বিষয় এর ভিতরে নেই৷’’
এ নিয়ে কথা বলার জন্য মাওলানা বাবুনগরী ও আনাস মাদানীর সঙ্গে যোগাযোগর চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি৷
গতবছর জুনের ছবিঘরটি দেখুন...
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা
কওমি মাদ্রাসা বেসরকারি ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকার কামরাঙ্গির চরে এমনই এক মাদ্রাসা জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া৷ সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়ে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন মুস্তাফিজ মামুন৷
ছবি: DW/M. Mamun
সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে প্রচলিত দু’ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদ্রাসা একটি৷ উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে বাংলাদেশেও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়৷ দীর্ঘকাল ধরে কওমি মাদ্রাসা সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়াই সাধারণ জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়ে আসছিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে ইসলামি এ শিক্ষা ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/M. Mamun
১৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি৷ তবে বেসরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাদ্রাসার একটি ক্লাসরুম
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
সহশিক্ষায় বাধা নেই শিশুদের
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা স্বীকৃত নয়৷ তাই মহিলাদের শিক্ষার জন্য আলাদা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ তবে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সহশিক্ষার কোনো বাধা নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর একাংশ পরিচালিত হয় স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে৷ ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ (বেফাক) নামের এই শিক্ষা বোর্ড কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্লাস হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সেশন পরিচালনা হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী৷ সাধারণত বেফাক আওতাধীন মাদ্রাসাগুলোর নতুন সেশন শুরু হয় আরবি ক্যালেন্ডারের শাওয়াল মাসের ১০ তারিখ থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়া ও শোয়ার জায়গা একটাই
ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গাও৷ সাধারণত কওমি মাদ্রাসাগুলিতে পাঠদান এবং শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা একই হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্বক্ষণের সঙ্গী একজন শিক্ষক
কওমি মাদ্রাসার প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি একজন শিক্ষকও থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
রুটিনমাফিক জীবন
কওমি মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় পরিচালিত৷ তাই শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রুটিনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হিফজুল কোরান (বানানভেদে কোরআন)৷ এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করে থাকেন৷ তবে হিফজুল কোরান শেষ হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অন্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষারো সুযোগ আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্ব্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস
জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এটি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শ্রেণি৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এই শ্রেণিকেই মাস্টার্স-এর সমমান বলে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়াশোনার মূল মাধ্যম আরবি
কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের হাদিস সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত পড়ানো হয়৷ এ বিষয়ে পড়ানোর মূল মাধ্যম আরবি ভাষা৷ হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যা আরবি ভাষাতেই সম্ভব, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
আছে উর্দু এবং ফারসি ভাষাও
বাংলাদেশের কাওমি মাদ্রাসাগুলোয় প্রাথমিক স্তরে আরবির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি পড়ানো হলেও উচ্চস্তরে আরবি ছাড়াও পড়ানো হয় উর্দু এবং ফারসি ভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব ছাত্রদের জন্য ফ্রি খাবার
কওমি মাদ্রাসাগুলোয় গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে৷ তবে সামর্থবানদের থাকা ও খাওয়ার জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
মেঝেতেই খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা
শিক্ষা কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার নেই কওমি মাদ্রাসাগুলোয়৷ ইসলামি সুন্নত অনুসরণে পাঠদান কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সম্পন্ন হয় মেঝেতেই৷