আজ বলতে হবে, এই জিহাদিরা মধ্যপ্রাচ্যে একটা উঠতি শক্তি, ইরাকের এক-তৃতীয়াংশ তাদের দখলে৷ ওবামা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে বিমান হানা চালাচ্ছে, খোদ ভ্যাটিকান থেকে যার সমর্থন আসছে৷
বিজ্ঞাপন
জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক এই ‘ইসলামি রাষ্ট্র’৷
মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইসলামি রাষ্ট্রের' উপস্থিতি হবে শক্তিশালী এবং সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি – বলছেন পণ্ডিতরা৷ শুধু বোমা মেরে তাদের অগ্রগতি থামানো যাবে না৷ সেজন্য লাগবে জাতিসংঘের সনদ-পুষ্ট একটি আন্তর্জাতিক জোট ও তাদের সেনাবল৷
‘ইসলামিক স্টেট' নামধারী জিহাদি বাহিনীর লক্ষ্য হলো, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদের মধ্যবর্তী এলাকায় একটি আন্তঃ-সীমান্ত খলিফাৎ সৃষ্টি করা৷ গোড়ায় তাদের এই উচ্চাশার কথা শুনে লোকে হেসেছিল৷ আজ সেই ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর৷
আরব সমাজে যে সব সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত ফাটল দেখা দিয়েছে, নতুন খলিফাতের যোদ্ধারা তার সুযোগ নিচ্ছে৷ অপরদিকে তারা চরম সহিংসতা প্রদর্শন করে স্থানীয় মানুষজনকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের অন্যান্য শক্তি যে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধাগ্রস্ত, তারও সুযোগ নিয়েছে আইএস৷
নির্মম ও নৃশংস
ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদার লক্ষ্য ছিল পশ্চিমি সভ্যতার বিনাশ৷ সেক্ষেত্রে ইসলামি রাষ্ট্রের রাজ্যাঞ্চলীয় উচ্চাশা আছে; তারা অন্য ধরনের সামজিক কাঠামো গড়ে তুলতে আগ্রহী; এছাড়া সুদূর ১৯১৬ সালের সাইক্স-পিকো চুক্তি থেকে মধ্যপ্রাচ্যের যে বিভাজন শুরু, আইএস সেই বিভাজন মানে না৷
ইরাকে জিহাদিবিরোধী যুদ্ধ
চরমপন্থি ইসলামি সংগঠন আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে ইরাকে৷ সন্ত্রাসবাদী এ সংগঠনটির সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও তৎপরতা রয়েছে৷ দেখুন ইরাকে আইএস-বিরোধী যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু ছবি৷
ছবি: Reuters
টিকরিট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
সুন্নিদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে৷ বাগদাদ থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের শহর টিকরিটও এখন তাদের দখলে৷ সে এলাকায় ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuters
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইসিস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইসিস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷ ইরাকে নুসরা ফ্রন্টসহ বেশ কিছু সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহীদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ আর ইরাকে নুরি আল মালিকির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যপন্থি এবং মৌলবাদী সংগঠনের কর্মী রয়েছে৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদ্রোহীদের একাংশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন৷
ছবি: Reuters
ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানিয়েছেন, কংগ্রেস বিদ্রোহীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করলে তা সিরিয়া এবং ইরাকে দেয়া হবে৷ এই বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ যে আইসিস-এর কাছে যাবেনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই৷
ছবি: Reuters
কুর্দিরা চায় স্বাধীন কুর্দিস্তান
যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি সুন্নি এবং কুর্দিদের অংশিদারিত্বের সরকার গঠন করুন৷ ইরাকের কিছু অংশে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন রয়েছে৷ কুর্দিরা ‘পেশমেরগা’, অর্থাৎ কুর্দিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কুর্দিদের মূল লক্ষ্য ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: Reuters
ইরানের ভূমিকা
ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মধ্যে জড়াতে চায়না ইরান৷ কিন্তু শিয়া প্রধান দেশ ইরানের সরকার ইরাকের মালিকি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিস-বিরোধী যুদ্ধে মালিকি সরকারকে ড্রোন এবং অন্যান্য সমর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান সরকার৷
ছবি: Atta Kanare/AFP/Getty Images
এক হাজারেরও বেশি নিহত
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি মনে করেন, আইসিসকেও মদদ দিচ্ছে সৌদি সরকার৷ ইরাকে চলমান সংঘাতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ জন্য ইরাক সরকার এবং আইসিস-এর কঠোর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: Reuters
বাড়ছে শরণার্থী
আইসিসের হামলা শুরুর পর থেকে ইরাকের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১২ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ সিরিয়া সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ সিরীয় স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এখন আইসিসের দখল করে নেয়া শহরগুলো থেকে পালিয়ে ইরাকিরাও আসছে৷ ছবিতে খাজাইর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত শহর এরবিলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে মসুল থেকে আসা ইরাকিদের৷
ছবি: Getty Images
স্বেচ্ছাসেবীরাও নেমেছে যুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রী মালিকি জানিয়েছেন, রাশিয়া আর বেলারুশের কাছ থেকে পুরোনো যুদ্ধ বিমান কিনেছে ইরাক৷ আইসিসের বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ বাড়ছে সমরাস্ত্র৷ বাড়ছে যোদ্ধা৷ স্বেচ্ছাসেবীরাও যোগ দিচ্ছেন আইসিস বিরোধী যুদ্ধে৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
আইএস-এর অর্থ কিংবা অস্ত্রের কোনো অভাব নেই৷ গত গ্রীষ্মের অভিযানে তারা ইরাকি সামরিক বাহিনী এবং কুর্দ পেশমার্গা বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে৷ আইএস যোদ্ধাদের হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে মূলত শিয়া, খ্রিষ্টান এবং সংখ্যালঘু ইয়াজিদিরা৷ এবং এই সামরিক অভিযানের সঙ্গে চলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামিক স্টেটের ঝটিতি অভিযান৷
ইন্টারনেটে দেখানো হয়েছে বিরোধী-বিধর্মীদের ক্রুশবিদ্ধ করা কিংবা শিরচ্ছেদ করার নৃশংস দৃশ্য – যার উদ্দেশ্য হলো, এটা স্পষ্ট করে দেওয়া যে, ইসলামিক স্টেটের কাজ হল বিধর্মী নিধন – এবং সে কাজে তারা তাদের পূর্বসূরি আল-কায়েদার চেয়ে বেশি দড়, যার প্রমাণ: আল-কায়েদা স্বয়ং ইসলামি রাষ্ট্রকে অত্যধিক নির্মম বলে প্রত্যাখ্যান করেছে৷
দশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করেছিল৷ এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে কী পরিবর্তন এসেছে?
ছবি: DW/K. Zurutuza
সমস্যা আছেই
যুদ্ধ শেষে পুনর্গঠন কাজে বিভিন্ন দেশ থেকে ইরাকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতি হয় নি৷ এখনো পানি, বিদ্যুত সহ মৌলিক চাহিদার তীব্র সংকট রয়েছে সেখানে৷ রয়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের উচ্চহার৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
ইরাকি শরণার্থী
যুদ্ধের কারণে ইরাকের যেসব জনগণ পালিয়ে সিরিয়া চলে গিয়েছিল, তারা এখন ফিরতে শুরু করেছে৷ তবে জাতিসংঘের হিসেবে, এখনো প্রায় ১২ লক্ষ ইরাকি গৃহহীন অবস্থায় রয়েছে৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
অসংখ্য চেকপয়েন্ট
প্রতি পাঁচ ইরাকির একজনের বাস রাজধানী বাগদাদে৷ প্রতিদিন তাঁদের অসংখ্য চেকপয়েন্ট পার হতে হয়৷ জনগণের নিরাপত্তার জন্যই এগুলো বসানো হয়েছে৷ তবে এখনো কমেনি সহিংসতা৷ মঙ্গলবারও গাড়ি বোমা হামলায় কমপক্ষে ৫৪ জন নিহত হয়েছে৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
বাড়ছে নিহতের সংখ্যা
২০১২ সালে ৪,৫৬৮ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছে৷ তার আগের বছর সংখ্যাটা ছিল ৪,১৪৪৷ ‘ইরাক বডি কাউন্ট’ নামের একটি সংস্থা নিয়মিত মৃত্যুর হিসেব রেখে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
নারী শিক্ষার দুরবস্থা
সত্তরের দশকে ইরাকের মেয়েদের সবাই শিক্ষিত ছিল৷ এখন সেই হার ৪০’এ নেমে এসেছে৷ এছাড়া বেড়েছে শিশুদের বিয়ে দেয়ার ঘটনা৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
তেজস্ক্রিয়তার শিকার
হিরোশিমা, নাগাসাকি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়৷ তার চেয়েও বেশি সংখ্যক ইরাকি তেজস্ক্রিয়তার কারণে ক্যান্সার, লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে৷ এছাড়া বাড়ছে শিশু মৃত্যুর হার৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
ইরাকের আরব বসন্ত?
হাজার হাজার সুন্নি বিক্ষোভকারী গত ডিসেম্বর থেকে সুন্নি অধ্যুষিত ইরাকে নিয়মিত আন্দোলন করে আসছে৷ যার শুরু ২০১১ সালে আরব বিশ্বে ঘটে যাওয়া আরব বসন্তের সময়৷ উল্লেখ্য, ইরাকে বর্তমানে ক্ষমতায় শিয়াদেরই প্রাধান্য৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
7 ছবি1 | 7
সবচেয়ে বড় কথা: তাদের তরুণ রংরুটের ছড়াছড়ি – সিরিয়া ও ইরাকে তাদের রংরুট ভর্তির কেন্দ্রের সামনে লাইন লেগে থাকে৷ প্রথমত, আইএস-এর অর্থের কোনো অভাব নেই, তা অস্ত্র কেনার জন্যই হোক আর রংরুটদের হাতখরচা দেবার জন্যই হোক৷ ইরাকি সেনাবাহিনী বিপুল পরিমাণ সর্বাধুনিক মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালানোর ফলে আইএস-এর অস্ত্রের ছছল-বছল৷
উপসাগরীয় অঞ্চলের ধনি সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে অর্থ আসছে৷ চুরি-ডাকাতি-অপহরণ থেকে অর্থ আসছে৷ এছাড়া পূর্ব সিরিয়ার ৫২টি তেলের খনির মধ্যে ৫০টি আইএস-এর দখলে; উত্তর-পশ্চিম ইরাকেও বিশটি তেলের খনি তাদের দখলে৷ ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা একটি সীমান্তবিহীন বহুজাতিক আন্দোলন হলেও, তাদের কোনো সামাজিক ভিত্তি ছিল না৷ ইসলামি রাষ্ট্র কিন্তু একটি রাজ্যাঞ্চলীয় সত্তা হিসেবেই মাঠে নেমেছে৷
আরব রাষ্ট্র বলতে আমরা যা জানি এবং বুঝি, তার ‘নেমেসিস' বা কাল হিসেবে এই ইসলামিক স্টেট মুভমেন্টের জন্ম৷ তরুণ প্রজন্ম থেকে রংরুট সংগ্রহ করার অদ্ভুত ক্ষমতা তাদের৷ এবং যে কাতার কিংবা সৌদি আরবের কোটিপতিরা আইএস-কে অর্থ যোগাচ্ছেন, সেই সব দেশের সরকারবর্গ স্বদেশে ইসলামি রাষ্ট্রের ছোঁয়া লাগার আতঙ্কে আতঙ্কিত৷