আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তায় ‘বাংলাদেশে ইসলাম বিরোধীদের' প্রতিরোধের হুমকির বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে সরকার৷ তবে এই ভিডিও বার্তা সত্যিই আল-কায়েদার কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সরকারের মন্ত্রীরা৷
বিজ্ঞাপন
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আল-কায়েদার ভিডিও বার্তার তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে বলেছেন, আল-কায়েদার হুমকিতে সরকার ভীত বা বিচলিত নয়৷ যে কোনো জঙ্গিদের হুমকি মোকাবেলার সামর্থ্য সরকারের রয়েছে৷ তিনি বলেন, ভিডিও বার্তার সঙ্গে কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷
তিনি বলেন, যে সব দেশে আল-কায়েদার তত্পর, সেখানে স্থানীয়রা এতে ইন্ধন দেয়৷ কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, আল-কায়েদার হুমকি – কোনোটাই চায় না৷
এছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এই ভিডিও বার্তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির যোগাযোগ থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বলেছেন, তদন্তে সত্যতা মিললে জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সম্পর্ক প্রমাণিত হবে৷
আল-জাওয়াহিরি তাঁর বক্তব্যে সরাসরি হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াতে ইসলামীর নাম বলেননি৷ তবে বার্তাটির শুরুতে হেফাজতের সমাবেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের চিত্র দেখানো হয়েছে৷ একটি অংশে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়েছে৷
আল-কায়েদার ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে৷ আল-জাওয়াহিরি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে ‘ইসলামবিরোধী' ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ' আখ্যায়িত করেছেন৷
আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দাবি করেছেন, আল-কায়েদার ভিডিও বার্তায় যেসব কথা রয়েছে তার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের কথার মিল রয়েছে৷ এই ভিডিও বার্তার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে৷ তিনি বলেছেন, পুরো ভিডিও বার্তাটি বিশ্লেষণ করলে এর ভাষা এবং অবস্থান থেকেই জামায়াত-বিএনপির কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷
এদিকে হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামী আলাদা বিবৃতিতে বলেছে, আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷ জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, আল-কায়েদার সঙ্গে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই আসে না৷ উপরন্তু আমরা যে কোনো ধরনের জঙ্গিবাদকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা করি৷''
কাদের মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থিরা বলছেন ‘শহিদ৷’ এই শহিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় চলছে সহিংসতা৷ মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ে আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
ইসলামপন্থিদের কাছে ‘শহিদ’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কাদের মোল্লাকে মনে করছেন একজন ‘শহিদ৷’ যিনি ‘‘ইসলামি আন্দোলন করার কারণে’’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন৷ এই ‘শহিদের’ মৃত্যুতে তাই শুক্রবার বিভিন্ন জেলায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে জামায়াত-শিবির৷ মোল্লার জন্য পাকিস্তানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিটি সেখানকার৷
ছবি: Rizwan Tabassum/AFP/Getty Images
অনেকের কাছে ‘মিরপুরের কসাই’
তবে বাংলাদেশে অনেকেই কাদের মোল্লাকে মনে করেন ‘মিরপুরের কসাই,’ যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মোল্লার পরিবার আক্রান্ত
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মগবাজারে তার পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে৷ কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদপত্রের কাছে দাবি করেন, ‘‘কিছু ছাত্রলীগের নেতা পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায়৷’’ এসময় মোল্লা পরিবারের কয়েক সদস্যকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir Uz Zaman
ফরিদপুরে শেষ ঠিকানা
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
ফাঁসির রায় উদযাপন
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ তাদের আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়৷ সেই আপিলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয় মোল্লার৷ রায় কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই শাহবাগে আনন্দ মিছিল দেখা গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্যাপক সহিংসতা
এদিকে, শুক্রবার বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তি৷ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করে, সেতু ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে চালানো হচ্ছে নাশকতা৷ এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
ছবি: DW/M. Mamun
তবে সাঈদীর মতো নয়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহেদুল আনাম খান এবং শরীফ এ কাফি অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত তার সহিংস তত্পরতা নিয়ে কতদূর এগোতে পারবে তাও দেখার বিষয় আছে৷ কারণ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা যে মাত্রায় সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবার এখন পর্যন্ত তারা সেই মাত্রায় যেতে পারেনি৷ এর কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়েছে৷’’ তবে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: DW/M. Mamun
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ তবে মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না জার্মানি
বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷’’ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তিনি বলেন, ‘‘দেশের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব, ইসলাম ও দেশ প্রেমিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে এটি (জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তা) একটি নতুন ষড়যন্ত্র কি না, তা নিয়ে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন, উত্কণ্ঠিত৷'' বাংলাদেশ যে কোনো ধরনের উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়৷
ওদিকে বিএনপিকে জড়িয়ে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যকে ‘রাবিশ' বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)৷ তিনি বলেছেন, বিএনপিই বাংলাদেশে জঙ্গি দমন করেছে৷ তাই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট৷