কাতারের সঙ্গে পারস্য উপসাগরীয় কয়েকটি দেশের চলমান দ্বন্দ্বের কারণে আল জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেলের নাম আলোচনায় উঠে এসেছে৷ চ্যানেলটি বন্ধ করার শর্ত দিয়েছে আরব রাষ্ট্রগুলো৷
বিজ্ঞাপন
চলতি মাসের পাঁচ তারিখে সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়৷ এরপর সেই সম্পর্ক উন্নয়নে ১৩ দফা শর্ত দেয় চার আরব রাষ্ট্র৷ এর মধ্যে আল জাজিরা বন্ধের দাবিও রয়েছে৷ চ্যানেলটি সন্ত্রাসবাদ প্রসারে ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ ঐ রাষ্ট্রগুলোর৷ তবে কাতার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ কুয়েতের মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার এই দাবিগুলো কাতারকে জানায় ঐ চার আরব দেশ৷ ১০ দিনের মধ্যে এসব শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছে৷
তবে এসব শর্তকে ‘বেশ উসকানিমূলক’ বলে মন্তব্য করেছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গাব্রিয়েল৷ সোমবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বয়কট উঠিয়ে নেয়ার শর্ত হিসেবে চার আরব রাষ্ট্র কাতারকে যে ১৩ দফা দাবি দিয়েছে তা ‘বেশ উসকানিমূলক’, কারণ কয়েকটি দাবি দোহা’র সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে৷ অবশ্য কয়েকটি দাবি আলোচনার যোগ্য বলেও মনে করেন তিনি৷
সৌদি ক্ষমতাকেন্দ্রে তারুণ্য
সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ মহম্মদ বিন সালমান ‘এমবিএস’ নামেও পরিচিত৷ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁর উত্থান সবার নজর কেড়েছে৷ এই তরুণ নেতা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো কি জানা আছে?
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
বাদশাহর আস্থাভাজন
অশীতিপর বাবা বাদশাহ সালমান কার্যত দেশের ক্ষমতা প্রিয় ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও তিনি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি আরামকো ও দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ উপ প্রধানমন্ত্রী পদও তাঁর দখলে ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saudi Press Agency
ঝুঁকি নিতে ভয় পান না
প্রচণ্ড পরিশ্রমী বলে পরিচিত মহম্মদ বিন সালমান সৌদি শাসকগোষ্ঠীর এতকালের ধীরস্থির ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এতদিনের নানা প্রথা ভেঙে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন৷ তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে দেশে এমন নেতারই প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/abaca/Balkis Press
পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন
এতকালের সংযম ভেঙে ফেলে সৌদি আরব গোটা অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ ইরানের প্রতি বৈরি মনোভাব, ইয়েমেনে সেনা অভিযান থেকে শুরু করে কাতারকে একঘরে করে ফেলার সিদ্ধান্তের পেছনেও মহম্মদ বিন সুলতানের স্বাক্ষর স্পষ্ট৷ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার স্থপতিও তিনি৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
রাজপরিবারে উত্থান
সৌদি রাজপরিবারের জটিল ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে বাদশাহর ঠিক পরে শীর্ষ স্থানে পৌঁছানোর মতো অসাধ্যসাধন করেছেন ‘এমবিএস’৷ শুধু তাই নয়, এতকাল মনোনীত ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মহম্মদ বিন নায়েফ (বামে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উপাধি খুইয়েও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Saudi Press Agency
ব্যতিক্রমী জীবন
সৌদি রাজপরিবারের সন্তানরা সাধারনত বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, কমপক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যান৷ মহম্মদ বিন সালমান সেই পথে না গিয়ে দেশে থেকেই আইন নিয়ে পড়েছেন এবং বাবার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন৷ বাদশাহ সালমান যখন নিজে ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তখনও তিনি বাবার রাজসভার দায়িত্বে ছিলেন৷
ছবি: Getty Images
পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরতা
সৌদি অর্থনীতি এতকাল তার বিশাল পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে ছিল৷ মহম্মদ বিন সালমান অর্থনীতির খোলনলচে বদলে ২০৩০ সালের মধ্যে সেই পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ শুরু করেছেন৷ ভরতুকিসহ অনেক সুযোগসুবিধা বন্ধ করে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ali Jarekji
ধর্মীয় অনুশাসন
সৌদি আরবের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এখনো কোনো বড় সংঘাতে যাননি মহম্মদ বিন সালমান৷ তবে দেশের বিশাল যুবসমাজের কথা ভেবে তিনি সংগীতের জলসা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন৷ সেইসঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের তত্ত্বাবধায়ক পুলিশের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Hilabi
7 ছবি1 | 7
গাব্রিয়েল বলেন, কোন দাবিগুলো কাতার গ্রহণ করতে পারবে আর কোনগুলো সমস্যামূলক, তা নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনও রবিবার এমন আভাস দেন৷ মঙ্গলবার কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টিলারসনের বৈঠক হওয়ার কথা৷
চ্যানেলটি কি বন্ধ হবে?
পুরোপুরি না হলেও তাদের সম্পাদকীয় নীতিমালায় পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক৷ মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ সুলতান সুদ আল কাশেমি বলেন, ‘‘এর আগে আল জাজিরাকে ঘিরে পারস্য উপসাগরীয় দেশ ও মিশরের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কে বেশ কয়েকবার চিড় ধরেছিল৷ ২০০২ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে সৌদি আরবের নেয়া শান্তি পরিকল্পনা বিষয়ে আল জাজিরার কভারেজ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সৌদি আরব৷ ফলে কাতার থেকে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল দেশটি৷ এছাড়া ২০১৪ সালে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে ‘নাক গলানো’ বন্ধের অঙ্গীকার করেছিল৷’’ আল জাজিরা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কাতারের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো কাতারের উপর চাপ দিয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি৷
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল আল জাজিরা৷ আরব রাষ্ট্রের চ্যানেলগুলোর মধ্যে আল জাজিরাই প্রথম তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার করে৷ সেখানে সৌদি আরবে জন্ম নেয়া লাদেন সৌদি আরবের সমালোচনা করে দেশটিতে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছিলেন৷ এতে সেই সময় ক্ষিপ্ত হয়েছিল সৌদি আরব৷
মুসলমানদের জন্য সেরা ১৫টি দেশ
প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০১৬-১৭’৷ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি মুসলিমবান্ধব দেশগুলোর নাম৷ সেখানে বাংলাদেশও আছে৷ দেখুন...
ছবি: Getty Images/AFP/M. Al-Shaikh
দশম স্থানে ইন্দোনেশিয়া
৩৬ পয়েন্ট নিয়ে ইন্দোনেশিয়া আছে দশ নম্বরে৷ ইসলামি বিনিয়োগে দেশটি আছে নয় নম্বরে৷ এছাড়া হালাল কসমেটিক্স এবং হালাল ওষুধ বেশি পাওয়া যায় এমন দেশগুলোর মাঝে ইন্দোনেশিয়া আছে অষ্টম স্থানে৷
ছবি: SUDIARNO/AFP/Getty Images
নবম স্থানে জর্ডান
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি ৩৭ পয়েন্ট নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার ঠিক আগে আছে৷ ইসলামি বিনিয়োগে দেশটি আছে নয় নম্বরে৷
ছবি: Reuters
অষ্টম স্থানে কাতার
কাতারের মোট পয়েন্ট ৪৩৷ হালাল ও ইসলামি বিনিয়োগ আর বেশি ইসলামি মিডিয়া আছে এমন দেশগুলোর তালিকার শীর্ষ দশে আছে দেশটি৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
কুয়েত সপ্তম
কুয়েতের মোট পয়েন্ট ৪৪৷ ইসলামি বিনিয়োগে ষষ্ঠ এবং বেশি ইসলামি মিডিয়া আছে এমন দেশগুলোর তালিকার শীর্ষ দশে আছে এই দেশটি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Al-Zayat
ষষ্ঠ স্থানে পাকিস্তান
সেরা মুসলিমবান্ধব দেশগুলোর তালিকায় মোট ৪৫ পয়েন্ট নিয়ে পাকিস্তান আছে ষষ্ঠ স্থানে৷ হালাল খাবার বেশি পাওয়া যায় এমন দেশগুলোর তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে দেশটি৷ বেশি ইসলামি বিনিয়োগে পাকিস্তান আছে সপ্তম স্থানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Akber
ওমান পঞ্চম
পাকিস্তানের চেয়ে তিন পয়েন্ট বেশি নিয়ে ওমান আছে পঞ্চম স্থানে৷
ছবি: J. Sorges
চতুর্থ স্থানে সৌদি আরব
সৌদি আরবের মোট পয়েন্ট ৬৩৷ তারা আছে চতুর্থ স্থানে৷
ছবি: Reuters/File Photo/A. Jadallah
বাহরাইন সৌদি আরবের চেয়ে এগিয়ে
সৌদি আরবের চেয়ে তিন পয়েন্ট বেশি নিয়ে বাহরাইন আছে তৃতীয় স্থানে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Al-Shaikh
দ্বিতীয় স্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত
মোট ৮৬ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় সেরা মুসলিমবান্ধব দেশ হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত৷
ছবি: picture-alliance/DPPI/A. Francolini
সবার সেরা মালয়েশিয়া!
হ্যাঁ, তালিকায় সবার ওপরে আছে মালয়েশিয়া৷ তাদের মোট পয়েন্ট ১২১!
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kahnert
এবং বাংলাদেশ
২৬ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ আছে ১৫ নম্বরে৷ ১৫টি সেরা মুসলিমবান্ধব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের আগে আছে শুধু ইরান, সুদান, ব্রুনেই এবং সিঙ্গাপুর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
11 ছবি1 | 11
খোলা চিঠি
সোমবার এক খোলা চিঠিতে আল জাজিরা জানিয়েছে, আল জাজিরা বন্ধের চেষ্টার অর্থ হচ্ছে অত্র অঞ্চলে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে নীরব করার চেষ্টা, এবং সকলের তথ্য পাওয়ার স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করা৷ এটা অবশ্যই ঘটতে দেয়া উচিত নয়৷ ‘‘আমরা সততার সঙ্গে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব৷ সত্যের সন্ধানে আমরা সাহসি মনোভাব দেখিয়ে যাব৷ এবং আমরা মানুষের তথ্য জানার অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে যাব,’’ খোলা চিঠিতে লিখেছে আল জাজিরা৷
সাফল্যের পেছনে সৌদি আরব?
ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত এক চিঠিতে আয়ান রিচার্ডসন লিখেছেন, সৌদি আরবের একটি সিদ্ধান্তের কারণে আল-জাজিরা সাফল্য পেয়েছে৷ নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি বিবিসি আরবি টিভি চ্যানেলের ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে লিখেছেন৷ তিনি বলেন, বিবিসি টিভির কন্টেন্ট নিয়ে সৌদি আরবের আপত্তি থাকায় তারা তাদের মালিকানাধীন স্যাটেলাইট থেকে বিবিসিকে সরিয়ে দিয়েছিল৷ ফলে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ আর এর সুবিধা পেয়েছিল আল জাজিরা৷ কারণ, বিবিসির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় দেড়শ’ সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, ভিডিও এডিটরসহ অন্যান্য কলাকুশলীদের নিয়োগ দিয়েছিল আল জাজিরা৷ এ কারণেই সাফল্য পেয়েছিল আল জাজিরা৷
আল জাজিরার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিক্ষোভ
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখ উল্লেখ করায় ২০১৪ সালের নভেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিবাদ হয়েছিল৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ আনা হয়েছিল ঐ টিভির চ্যানেলটির বিরুদ্ধে৷