আশির দশকের আন্দোলন অনেক বেশি পরিপক্ক ও সম্ভাবনাময় ছিল
৫ আগস্ট ২০২৩বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারা পরিবর্তন হয়েছে৷ আগের মত এখন আর হরতাল-অবরোধ দেখা যাচ্ছে না৷ রাজনৈতিক মাঠে খুব বেশি সহিংসতাও নেই৷ হঠাৎ করেই রাজনৈতিক আন্দোলনে কেন এই পরিবর্তন? আগের আন্দোলনের থেকে বর্তমান সময়ের আন্দোলনের পার্থক্যটা কী? হরতাল-অবরোধের কার্যকারিতা কী শেষ হয়ে গেছে? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ৷
ডয়চে ভেলে : আগের আন্দোলন থেকে এবারের আন্দোলনের পার্থক্য কী?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : আগে বলে তো নির্দিষ্ট কিছু নেই৷ একেক সময় একেক ধরনের আন্দোলন হয়েছে৷ মুক্তিযুদ্ধের আগেও আন্দোলন হয়েছে, পরেও হয়েছে৷ মুক্তিযুদ্ধের পরে যেটা দেখেছি, তখন তো ধর্মপন্থি দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল৷ তখন যে দলগুলো ছিল তাদের প্রায় সবাই বিপ্লবের কথা বলত, সমাজতন্ত্রের কথা বলত৷ আওয়ামী লীগও এটা বলত, যারা সমালোচনা করত তারাও বলত৷ প্রথম সরকারের সময় যেটা ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম৷ যেটা পরে দুর্বল হয়ে যায়৷ জিয়াউর রহমানের সময়ও নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন হয়েছে৷ সেটা বেশি দিন হয়নি৷ এরপর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় আমরা দীর্ঘ একটা আন্দোলন দেখেছি৷ আমার ধারণা আশির দশকের আন্দোলন অনেক বেশি পরিপক্ক ও সম্ভাবনাময় ছিল৷ তখন আন্দোলন শুধু স্বৈরাচারের পতন না, সমাজিক একটা রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল৷ তখন শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, নারীরা একত্রিত হয়েছিল, পেশাজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল৷ তখনও দলীয় ভিত্তিতে কোন কিছু ভাগ হয়নি৷ তখন আন্দোলনের জনভিত্তি ছিল খুব শক্তিশালী৷ কিন্তু সেই সম্ভাবনাও কাজে লাগেনি৷ কারণ পরে যখন সবকিছু বাদ দিয়ে এক দফার আন্দোলন শুরু হয়৷ তখন তিন দলীয় জোটের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে সেটার বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে যে সংকট সেটা আর হত না৷ একানব্বই থেকে নতুন ধারা তৈরী হয়৷ তখন বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়েছিল৷ সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়েই আন্দোলন হচ্ছে৷ জনগনের অন্যান্য দাবি দাওয়ার চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার এ নিয়েই আন্দোলনটা হচ্ছে৷ ১৯৯৬ সালে বিএনপি ভোটার ছাড়া একটা নির্বাচন করেছিল৷ তখন দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছিল৷ হরতাল অবরোধ ছিল৷ পরে আপসরফা হিসেবে ওই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাশ হয়৷ সেই আন্দোলনে কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত ও জাতীয় পার্টি ছিল৷ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আর আন্দোলন হয়নি৷ কারণ দুই দলই তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল৷ এরপর পরিস্থিতি অন্যদিকে চলে যায়৷
আপনি যে আন্দোলনের কথা বললেন, সেখানে তো হরতাল-অবরোধ ছিল৷ এখন সেটা নেই কেন? হরতাল-অবরোধের কার্যকারিতা কী এখন আর নেই?
২০০৬ সালে অনেক হরতাল অবরোধ হয়েছিল৷ তখন বিএনপি নিজেদের মতো করে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরির চেষ্টা করেছিল৷ সেটার বিরোধিতায় সহিংসতাও হয়েছিল৷ এরপর আমরা ১/১১ এর ঘটনা দেখলাম৷ ২০০৮ সালে আবার নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হল৷ এরপরে যে আন্দোলন হচ্ছে সেটা গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকারের দাবিতে৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়৷ তখন তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতার পরে কোন সরকারই প্রমাণ করতে পারেনি দলীয় সরকারের অধীনে কোন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে৷ সেই থেকে নির্বাচনটা কে পরিচালনা করবে সেটাই একটা বড় ইস্যু৷ ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে সেটা একদলীয়৷ আর ২০১৮ সালে যেটা হয়েছে, সেটা কোন নির্বাচনই না৷ ২০১৩-১৪ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে কিন্তু হরতাল-অবরোধে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল৷ যেহেতু হরতালে মানুষের অভিজ্ঞতা তিক্ত, হরতালে শুধু সহিংসতা নয় অনেক ধরনের দুর্ভোগ হয়, মানুষেরও হরতালে আগ্রহ কমে আসছিল ফলে হরতালের আবেদনটা আর নেই৷
বর্তমানে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের যে ধারা তাতে সফলতার সম্ভাবনা কতটুকু?
অশান্তি বা সহিংসতাই যে পরির্তন আনতে পারে তা কিন্তু না৷ আন্দোলনে মানুষ কতটা জমায়েত হবে বা মানুষকে কতটা আকর্ষণ করতে পারবে সেটার উপরই নির্ভর করে৷ পাকিস্তান আমলে যেটা হয়েছিল, মানুষকে অনেক বেশি সম্পৃক্ত করা গেছে৷ যে কারণে কিন্তু গণঅভ্যুত্থান করা গেছে৷ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও কিন্তু মানুষকে অনেক বেশি আকর্ষণ করা গেছে৷ সেখানে হরতাল একটা মাধ্যম হতে পারে৷ মূল কথা হল, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আন্দোলনে কতটা যুক্ত হচ্ছে৷ সেটার উপরই নির্ভর করে কতটা সফল হবে৷ বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীন থাকার কথা, বর্তমান সরকার কিন্তু সফলতার সঙ্গে সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই দলীয়করণ করে ফেলেছে৷ যার ফলে পুলিশ, র্যাব, আইন আদালত কোন কিছুই আর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না৷
বর্তমানে যে আন্দোলন হচ্ছে, এর মধ্যে বিদেশিদের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এটা কিন্তু আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার৷ এখানে বিদেশিদের ভুমিকা থাকে এবং নানানভাবে সেটা কাজও করে৷ এর আগে নব্বইয়ের দশকেও যত আন্দোলন হয়েছে, সেখানেও আমরা বিদেশিদের তৎপরতা দেখেছি৷ সবসময় যে কাজ করে তা নয়, যেমন ২০০৬ সালে কাজ করেনি৷ তখনও কিন্তু নানা ধরনের তৎপরতা দেখেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১/১১ এসেছে৷ বর্তমানে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে এখন একটা বাক বদল হচ্ছে৷ একটা টালমাটাল অবস্থা চলছে৷ তার মধ্যে বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি হয়েছে৷ এখন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা হচ্ছে তারা চীনকে মোকাবেলা করতে চায়৷ ভারতের উপর তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে পারছে না৷ ফলে বাংলাদেশ তার কাছে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ আবার চীন তার বাণিজ্যিক স্বার্থে অবস্থান নিচ্ছে৷ এবার চীনের যে ভুমিকা সেটা আগে কখনও এতটা খোলামেলা অবস্থান নিতে দেখা যায়নি৷ রাশিয়ার ক্ষেত্রেও তাই৷
ভারত তো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ বর্তমান সরকার ২০১৪, ২০১৮ সালে যে নির্বাচন করল সেখানে তো ভারতের সমর্থন একটা বড় ভিত্তি ছিল৷ সরকার যদিও বলছে, আমরা বিদেশিদের কথা শুনি না৷ কিন্তু আমরা যেটা দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি দেওয়ার পর ক্রসফায়ার, গুম, বিরোধীদের উপর দমন পীড়ন অনেকটাই কমেছে৷ এটা বড় ধরনের কোন পরির্বতনের জন্য নির্ধারক নাও হতে পারে৷ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের নিজেদের এজেন্ডাই মুখ্য৷ সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা না৷ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের কৌশলগত স্বার্থ হাসিল করা৷ সেটার জন্য তারা চাপ দিচ্ছে৷ এর ফল কী হবে সেটা তো আর এখনই বলা যাবে না৷
বর্তমান আন্দোলন তো এখনো অহিংস অবস্থায় আছে৷ ভবিষ্যতে কী এটা সহিংসতার দিকে যেতে পারে?
এটা সরকারের উপর নির্ভর করবে৷ এমনিতেও বাংলাদেশের মানুষ সংঘাত পছন্দ করে না৷ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তো একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে বা সমাধানে আসতে হবে৷ এখন যদি কোন সমাধান না হয় তাহলে অস্থিরতার মধ্যে তো নানা ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে৷ তবে বলা মুশকিল কোন ধরনের সংহিসতা হবে৷ দ্রব্যমূল্যসহ নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে এটাও একটা৷ এই পরিস্থিতি মানুষের সামাজিক জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলছে৷
আগে কী কখনও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হয়েছে?
প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বলে তো একটা কথা আছে৷ সফল হওয়া মানে কী? সরকারের পরিবর্তন? সামরিক শাসনের মাধ্যমেও তো সরকারের পরিবর্তন হয়৷ যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের কথা বলি, তাহলে জনগণের অংশগ্রহণ একটা বড় বিষয়৷