আশ্রয়প্রার্থীদের সীমান্ত থেকেই ফিরিয়ে দেবে জার্মানি
৮ মে ২০২৫
অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অতি-ডানপন্থিদের উত্থান ঠেকাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশটির রক্ষণশীল নেতা ও নতুন চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস৷
এ বছরের ফেব্রুয়ারির পার্লামেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে অভিবাসনবিরোধী অতি-ডানপন্থি রাজনৈতিক দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি)৷ ক্রমশ তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে৷ এমন বাস্তবতায় এএফডি-র উত্থান ঠেকাতেই অভিবাসন ইস্যুতে আরো কঠোর হচ্ছে ম্যার্ৎসের সরকার৷
জার্মান সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়টি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এবং পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ককে আগেই অবগত করেছেন বলে জানিয়েছেন চ্যান্সেলর ম্যার্ৎস৷ ভেল্ট টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এটি ‘‘অস্থায়ী'' একটা ব্যবস্থা এবং ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনিয়মিত অভিবাসনের উচ্চ হার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত'' প্রয়োজনীয়৷
সীমান্তে বাড়ানো হচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তা
মঙ্গলবার গঠিত হওয়া জার্মান সরকারের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডব্রিন্ডট বলেছেন, সরকার সীমান্ত পুলিশকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আশ্রয়প্রার্থীসহ অনথিভুক্ত অভিবাসীদের প্রত্যাখ্যানে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷
তিনি আরো বলেন, সন্তানসম্ভবা নারী এবং শিশুসহ ‘‘দুর্বল মানুষদের'' ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা শিথিল থাকবে৷
এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের একটি নির্দেশিকাও বাতিল করেন ডব্রিন্ডট৷ ওই সময় ইউরোপমুখী অভিবাসন প্রবাহ শুরু হলে সিরিয়া ও আফগানিস্তানের অন্তত দশ লাখ মানুষকে স্বাগত জানিয়েছিল জার্মানি৷
জার্মান সংবাদমাধ্যম বিল্ড জানিয়েছে, জার্মানির সীমান্তে মোতায়েনরত ১১ হাজার কর্মকর্তার পাশাপাশি নতুন করে আরো দুই হাজার থেকে তিন হাজার কর্মকর্তাকে সীমান্তে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ডব্রিন্ডট৷
সংবাদমাধ্যম ডেয়ার স্পিগেল জানিয়েছে, সরকারের নতুন নির্দেশনা কার্যকর করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের দিনে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতে পারে৷
রাইনিশে পোস্ট সংবাদপত্রকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফেডারেল পুলিশ ইউনিয়নের প্রধান আন্দ্রেয়াস রসকফ বলেছেন, নতুন নির্দেশাবলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘‘শক্তি বাড়ানো... শুরু হয়েছে৷''
অভিবাসনে ‘‘মানবতা ও শৃঙ্খলা'' নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য বলেও জানান জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
তিনি বলেন, আশ্রয় চাইতে আসা সবাইকে প্রত্যাখ্যান করতে চায় না জার্মানি, তবে সংখ্যাটি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷
সমালোচকেরা বলছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করা বা ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন লঙ্ঘন হতে পারে এবং জার্মানির সঙ্গে থাকা ইইউর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার রীতি নেই৷
বিরক্ত সুইজারল্যান্ড ও প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্র
জার্মানির নতুন সরকারের এই পদক্ষেপে বিরক্তি প্রকাশ করেছে প্রতিবেশী দেশ সুইজারল্যান্ড৷ আক্ষেপ প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ড জানিয়েছে, নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে জার্মানি কোনো আলোচনা, পরামর্শ করেনি৷
সুইস ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস অ্যান্ড পুলিশ তাদের ‘এক্স' প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, ‘‘সুইজারল্যান্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে সীমান্তে পদ্ধতিগতভাবে পুশব্যাক বর্তমান আইনের লঙ্ঘন৷''
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘জার্মানি কোনো পরামর্শ ছাড়াই এই ব্যবস্থা নিয়েছে৷ এতে সুইজারল্যান্ড ব্যথিত হয়েছে৷''
পোস্টটিতে আরো বলা হয়েছে, জার্মান বিচারমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছিলেন সুইস বিচারমন্ত্রী বিট ইয়ান্স৷
এই দুটি দেশ সীমান্ত ভাগাভাগি করে এবং প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী এই সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করেন৷
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে চ্যান্সেলর ম্যার্ৎসকে সঙ্গে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ক৷ এ সময় তিনি জার্মানিকে ‘‘ইইউ'র বহিরাগত সীমান্তে মনোযোগ'' বাড়াতে এবং শেঙ্গেন অঞ্চল সংরক্ষণের আহ্বান জানান৷
ম্যার্ৎস অবশ্য বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, তার সরকারের নেয়া নতুন সিদ্ধান্তগুলো ‘‘এমনভাবে কার্যকর করা হবে, যাতে আমাদের প্রতিবেশীদের কোনো সমস্যা না হয়৷'' তিনি আরো বলেন, জার্মানি অন্যান্য ইইউ দেশগুলোর সঙ্গে ‘‘এই সমস্যাটি যৌথভাবে সমাধান'' করতে চায়৷
এএফডি-কে ঘিরে বাড়ছে উদ্বেগ
জার্মানির পার্লামেন্ট নির্বাচনে এএফডি ২০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছে৷ তারা ম্যার্ৎসের রক্ষণশীল সিডিইউ/সিএসইউ-এর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল৷ বর্তমান জনমত জরিপে তাদের সমর্থন আরো বেড়েছে, কোথাও কোথাও তারা এগিয়েও গেছে৷
এমন প্রেক্ষাপটে জার্মান ভোটারদের উদ্বেগ কমাতে ম্যার্ৎস বলেছেন, এএফডির উত্থান বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন৷
জোট সরকার গঠনে সিডিইউ/সিএসইউ এবং মধ্য-বামধারার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস (এসপিডি)-এর মধ্যে সম্পাদিত জোট চুক্তিতে বলা হয়েছে, আশ্রয়প্রার্থীসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া সীমান্তে আসা সব ব্যক্তিকে জার্মানিতে ঢুকতে দেয়া হবে না৷
যদিও এই সিদ্ধান্তটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে৷ এসপিডির কেউ কেউ উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে৷
চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘ইইউ'র বহিরাগত সীমান্তে কার্যকর সুরক্ষা প্রতিষ্ঠিত'' না হওয়া পর্যন্ত সীমান্তে তল্লাশি অব্যাহত থাকবে৷
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে জার্মানিতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি সহিংস ঘটনায় বিদেশি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এই বিষয়টিকে সামনে এনে নির্বাচনি প্রচারে অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণকে মূল বিষয়বস্তু করেছিলেন ম্যার্ৎস৷
এক পর্যায়ে তিনি অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পার্লামেন্টে আনা একটি প্রস্তাব অনুমোদনে এএফডির সমর্থনের উপর নির্ভর করেছিলেন৷ এতে অবশ্য দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন ম্যার্ৎস৷ প্রস্তাবটিও পাস করা সম্ভব হয়নি৷
গত সপ্তাহে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা বিএফভি জানিয়েছে, তারা এএফডি-কে ‘‘ডানপন্থি চরমপন্থি'' সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া একটি দীর্ঘ গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এমন বিশেষণ দেয়া হলেও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি৷
ডেয়ার স্পিগেল জানিয়েছে, প্রতিবেদনের প্রতিটি পর্যায়ে শত শত এএফডি সদস্যের বিবৃতি উল্লেখ করা হয়েছে৷ এতে প্রমাণিত হয় যে, দলটি অভিবাসী, শরণার্থী এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘‘নিরন্তর আন্দোলন'' চালিয়ে যাচ্ছে৷
এছাড়াও, এএফডি তাদের প্রচারে ‘‘রিমাইমাইগ্রেশন'' [কোনো অভিবাসীকে তার নিজ দেশে বা তিনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফেরত পাঠানো] স্লোগানটিকেও ব্যবহার করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এর অর্থ হলো জার্মানিতে অবস্থানরত বিদেশিদের একটি বড় অংশকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো৷
বিএফভি-এর এমন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে নতুন করে দাবি উঠেছে৷ ‘‘ডানপন্থি চরমপন্থি'' সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এএফডি৷ এমন বিশেষণের প্রতি আইনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে৷
জার্মানির সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ
২০১৫ সালে ইউরোপজুড়ে অনিয়মিত অভিবাসী প্রবাহের সময় প্রথমবারের মতো প্রতিবেশী অস্ট্রিয়ার সঙ্গে থাকা সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে জার্মানি৷ ২০২৩ সালে পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে থাকা সীমান্তেও একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি৷
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সীমান্ত ভাগ করা নয়টি দেশের সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে জার্মান সরকার৷ এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং শেঙ্গেনভুক্ত বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র৷ চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস এই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকে গ্রহণযোগ্য করতে অনিয়মিত অভিবাসন, ইসলামি সন্ত্রাসবাদ এবং আন্তঃদেশীয় অপরাধের কথা উল্লেখ করেছিলেন৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর অন্তত ৮০ হাজার অননুমোদিত প্রবেশ শনাক্ত করেছেন সীমান্ত কর্মকর্তারা৷
অনিয়মিত অভিবাসন আরো কমাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে থাকা চলমান সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়িয়েছে জার্মানি৷ ১২ ফেব্রুয়ারি দেশটির সদ্য সাবেক চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস জানিয়েছেন, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ থাকবে৷
কমেছে আশ্রয় আবেদন
ইউরোপীয় ইউনিয়নে চলতি বছর এ পর্যন্ত জমা হওয়া আশ্রয় আবেদনের হিসাবে জার্মানি এখন আর শীর্ষ দেশ নয়৷ বেশ কয়েক বছর পর এবার জার্মানিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে ফ্রান্স ও স্পেন৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বরাত দিয়ে ৭ এপ্রিল এ তথ্য জানিয়েছে জার্মানির দৈনিক ভেল্ট আম সনটাগ৷
এতে বলা হয়েছে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফ্রান্স এবং স্পেনে আশ্রয় চেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে৷
ইইউর পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাট-এর ফেব্রুয়ারির পরিসংখ্যানেও তেমন আভাস মিলেছে৷ দেখা গেছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানিতে ১২ হাজার ৭৭৫টি নতুন আশ্রয় আবেদন জমা হয়েছিল৷ সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৬৫টি আবেদন জমা পড়েছে ফ্রান্সে এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৯৭৫টি জমা হয়েছে স্পেনে৷
৭ এপ্রিল জার্মানির অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (বিএএমএফ) জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে জমা হওয়া প্রথমবারের মতো আশ্রয়ের আবেদনের সংখ্যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৪৫ শতাংশ কমেছে৷ আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে বরাবরের মতোই শীর্ষে রয়েছেন সিরিয়া, আফগান এবং তুরস্কের নাগরিকেরা৷
টিএম/এআই (ডিপিএ, এএফপি, রয়টার্স)
প্রথম প্রকাশ: ৮ মে ২০২৫ ইনফোমাইগ্রেন্টস
অভিবাসী বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস তিনটি প্রধান ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্বে একটি যৌথ প্লাটফর্ম৷ প্লাটফর্মটিতে রয়েছে জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স মিডিয়া মোন্দ, এবং ইটালিয়ান সংবাদ সংস্থা আনসা৷ এই প্রকল্পের সহ-অর্থায়নে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷